ক্লপের অভাব বুঝতেই দিচ্ছেন না স্লট

লিভারপুল কোচ আর্নে স্লটএএফপি

গত মে মাসের কথা। লিভারপুলের অ্যানফিল্ড রোডের বাতাসে বাজছিল বিদায় রাগিনী। পুরো শহর বিষণ্নতায় আচ্ছন্ন। কারণ, লিভারপুলে শেষ সময় পার করছিলেন ইয়ুর্গেন ক্লপ। সাম্প্রতিক সময়ে পৃথিবীর অন্য কোনো শহরকে একজন কোচের বিদায়ে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখা যায়নি। ক্লপকে লিভারপুলবাসী এতটাই ভালোবেসে ছিলেন! বিদায়বেলায় ক্লপ যখন ভক্তদের পাঠানো চিঠিগুলো পড়ছিলেন, তখন ক্লপের সঙ্গে চোখ ভিজেছিল অন্যদেরও।

আরও পড়ুন

গোটা লিভারপুল তখন মুখর ক্লপ নামে, একই সময়ে পর্দার আড়ালে অন্য একটি ঘটনা ঘটছিল। লিভারপুলে ক্লপের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন আর্নে স্লট নামের এক ডাচ কোচ। টাক মাথার আপাতনিরীহ–দর্শন মানুষটি তেমন আলোচনায় ছিলেন না। ক্লাব কিংবা শহর, এমনকি অ্যানফিল্ডের গ্যালারিতেও ছিল না স্লট নামে কারও অস্তিত্ব। পরে নিজের বিদায়বেলায় ক্লপকেই ‘স্লট, স্লট’ বলে স্লোগান ধরতে হয়েছিল। ক্লপকে মনে করিয়ে দিতে হয়েছিল, তিনি–ই ক্লাবের শেষ কোচ নন। দায়িত্ব নিতে অন্য একজন এরই মধ্যে প্রস্তুত।

তবে ক্লপের সেই স্লোগানে লিভারপুল সমর্থকেরা ঠোঁট মিলিয়েছেন সামান্যই। একজন কোচকে বরণে কতটা শীতল আবহ তৈরি হতে পারে, সেটা স্লটের বরণ দেখে সে সময় বোঝা গিয়েছিল। এটুকু হলেও মানা যেত, কিন্তু দৃষ্টিকটুভাবে অপ্রয়োজনীয় কিছু সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছিল স্লটকে। অনেকেই বলতে শুরু করলেন, স্লট হতে যাচ্ছেন লিভারপুলের সবচেয়ে বড় ফ্লপ। কেউ কেউ তো মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই স্লটের শেষ দেখে ফেলেছিলেন।

আরও পড়ুন

এসবের মধ্যে স্লট অনেকটা নীরবেই দায়িত্ব নেন লিভারপুলের। অবহেলার সবচেয়ে সেরা উত্তরটি দেওয়ার প্রস্তুতি তাঁর ছিল। ফলটা এখন দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। যে ক্লপের বিদায়ে অনেকে লিভারপুলের দাপটের শেষ দেখে ফেলেছিলেন, প্রায় ৫ মাসের ব্যবধানে স্লট যেন ক্লপের অভাবই বোধ করতে দিচ্ছেন না! এমনকি লিভারপুল সমর্থকদের মুখে একবারের জন্যও শোনা যায়নি ‘গেটব্যাক ক্লপ’ স্লোগান কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘হ্যাশট্যাগ কামব্যাক ক্লপ’। অথচ ৫ মাস আগেই এমন দৃশ্যকে ভবিতব্য ধরে নিয়েছিলেন কেউ কেউ।

লিভারপুলে ক্লপকে ঘিরে এমন কিছুর সম্ভাবনা মোটেই বাড়াবাড়ি ছিল না। হারতে হারতে দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া দলটিকে জাদুকরি ছোঁয়ায় সাফল্য এনে দিয়েছিলেন ক্লপই। প্রায় তিন দশক পর লিগ শিরোপা জেতানোর পাশাপাশি এনে দিয়েছিলেন ইউরোপ–সেরার খেতাবও। মাঠের সাফল্যের পাশাপাশি ক্লপের ব্যক্তিত্বও সহজে প্রভাবিত করার মতো। তারকা বানানোর চেয়ে তারকা গড়ে তোলাতেই ছিল তাঁর সব মনোযোগ। সব মিলিয়ে জার্মানির ব্ল্যাক ফরেস্ট থেকে উঠে আসা এই কোচকে ভালো না বাসার কারণ ছিল না। ফলটা হলো, তাঁর বিদায়ের সময় লিভারপুল শহরের বিষণ্নতায় ডুবে যাওয়া।

আরও পড়ুন

মাঠের বাইরে লিভারপুলবাসীর জন্য ক্লপের আদর্শ চিরন্তন হলেও মাঠে অল্প সময়েই জার্মান কোচের অভাব ঘুচিয়ে দেন স্লট।

সামগ্রিকভাবে স্লট ও ক্লপের কোচিং–দর্শনে বেশ কিছু মিল আছে। যে কারণে ক্লপের তৈরি করা দলকে সামনে এগিয়ে নিতে বেগ পেতে হচ্ছে না স্লটকে। কিন্তু এরপরও খেলার ধরনে ক্লপের সঙ্গে স্লটের সুক্ষ্ম কিছু পার্থক্য আছে। বলের দখল পেলে স্লট ও ক্লপ দুজনই আক্রমণে যেতে পছন্দ করেন। কিন্তু স্লট চেষ্টা করেন বক্সের ভেতর ঢুকে কোনো ধরনের ভারসাম্য নষ্ট না করতে কিংবা জটিলতা তৈরি না করতে। যেখানে বেশিরভাগ সময় ক্লপের প্রচেষ্টা থাকত আক্রমণগুলো বৈচিত্র্য আনায়। এর ফলে দুর্দান্ত সাফল্য পেলেও নানারকম কারিকুরিতে বলের দখলও হারানোর আশঙ্কাও তৈরি হতো। এমনকি নিজেদের রক্ষণে ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কাও থাকত।

ক্লপের মতো স্লটও আক্রমণাত্মক কোচ, কিন্তু দ্বিতীয়জন এখানে খানিকটা কৌশলী। স্লটের দলকে অনেক সময় ম্যাচের প্রয়োজনে খেলার গতি কমিয়ে আনতে দেখা যায়। যা প্রতিপক্ষের মধ্যে বিভ্রান্তি তৈরির পাশাপাশি বলের দখল না থাকার সময়ও লিভারপুলকে বিশেষ সুবিধা দেয়।

স্লটের এমন কৌশলী অবস্থানের কারণে এখন একের পর এক ম্যাচ জিতে মাঝমৌসুমে একাধিক শিরোপা জয়ের স্বপ্ন দেখছে লিভারপুল। এরই মধ্যে সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে লিভারপুলের ডাগআউটে দাঁড়িয়ে ২৫ ম্যাচের ২১টিতেই জিতেছেন স্লট।

শিরোপা জিতেই মৌসুমকে পূর্ণতা দিতে চাইবেন স্লট
এএফপি

স্লটের এমন সফলতায় ক্লাবের ইতিহাসে তৃতীয়বারের মতো প্রতিপক্ষের মাঠে অপরাজিত থেকে বড়দিনের ছুটিতে যাওয়ার কীর্তি গড়ল লিভারপুল। ১৮৯৩–৯৪ ও ১৯৮৭–৯৯ সালে একই কীর্তি গড়েছিল দলটি। এই ২১ জয়ে ১৩৫ বছরের পুরোনো রেকর্ডও স্পর্শ করেছেন স্লট। ১৮৮৮–৮৯ মৌসুমে প্রেস্টন কোচ উইলিয়াম সাডলের পর দ্বিতীয় কোচ হিসেবে দ্রুততম ২১ ম্যাচ জিতেছেন স্লট। এর মধ্যে অবশ্য ছোট–বড় এমন আরও কিছু রেকর্ড ভেঙেছেন এই লিভারপুল কোচ।

তবে স্লট নিশ্চয় শুধু রেকর্ড ভেঙেই সন্তুষ্ট থাকবেন না। দারুণভাবে শুরু হওয়া মৌসুমটাকে তিনি শিরোপা জিতেই পূর্ণতা দিতে চাইবেন। সেটি যে খুবই সম্ভব সে ইঙ্গিতও এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। স্লটের লিভারপুল যদি সেই কাজটা এখন ঠিকঠাক করতে পারে, তাহলে যাঁরা সেই প্রাপ্তিতে সবচেয়ে বেশি খুশি হবেন, ক্লপ নিশ্চিতভাবে তাঁদের অন্যতম। তাতে সার্থক হবে বিদায়বেলায় ক্লপের ‘স্লট, স্লট’ বলে দেওয়া স্লোগানও।