এই দলটাই কি ইউরোপে সবচেয়ে বিরক্তিকর ফুটবল খেলে
ক্রিকেটে যতটা স্পষ্ট বোঝা যায়, ফুটবলে ততটা নয়। ব্যাটসম্যানদের মন্থর ব্যাটিংয়ে কখনো কখনো সমর্থকদের বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বাজে ফিল্ডিংয়েও হতে পারে। কিন্তু ফুটবলে ব্যাপারটা বোঝা একটু কঠিন। সহসাই কোনো দলের খেলায় বিরক্তির উদ্রেক হয় না, দেখতে দেখতে মনে হয়। আর সেটা যদি হয় মৌসুমজুড়ে, তখন সহ্য করতে না পেরে কেউ কেউ বলেও বসতে পারেন, আরে, এমন বিরক্তিকর দল তো আর দেখিনি!
ইউরোপিয়ান ফুটবলের পাঁড়ভক্তরা এবারের মৌসুমে চোখের সামনেই তেমন এক দলকে দেখছেন। শীর্ষ লিগগুলোর মৌসুম যেহেতু অর্ধেক পথ পার হয়ে গেছে তাই কেন বিরক্তিকর, সেসব তথ্য–উপাত্তও যথেষ্ট জমা হয়েছে। দলটিকে দেখে মজা করে এটাও বলা যায়, ওদের খেলার ধরন আলাদা। একদমই নিজস্ব ঢঙের খেলা।
মাদ্রিদ শহরের যে পাঁচটি দল স্পেনের শীর্ষ লিগে (লা লিগা) খেলে, হেতাফে তাদের একটি। লা লিগায় সর্বশেষ ২১ মৌসুমের মধ্যে ২০ মৌসুমে খেলেছে তারা। ২০১৫–১৬ মৌসুমে দ্বিতীয় বিভাগে নেমে গেলেও কোচ হোর্হে বোরদালাসের অধীন পরের মৌসুমে শীর্ষ পর্যায়ে ফিরে আসে হেতাফে। ২০২১ সালে বোরদালাস ভ্যালেন্সিয়ায় যোগ দিলেও ২০২৩ সালে আবারও ফিরে আসেন হেতাফেতে। অবনমন হওয়া থেকে বাঁচান ক্লাবটিকে। এ মৌসুমেও পয়েন্ট তালিকায় ১৪তম অবস্থানে থেকে লড়াই করছে হেতাফে। তবে সে লড়াইয়ের ধরন একদম আলাদা। অনেকের চোখে হয়তো সেই ধরনটা খুবই বিরক্তিকর।
কেমন, সেটা বুঝতে হয় পরিসংখ্যান দেখে। লা লিগা (২১) ও কোপা দেল রে (৪) মিলিয়ে হেতাফে এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত খেলেছে ২৫ ম্যাচ। আশ্চর্যের বিষয়, ইউরোপের শীর্ষ পাঁচ লিগের মধ্যে হেতাফে একমাত্র দল হিসেবে এখনো ৫০০০ পাসও খেলতে পারেনি। একমাত্র দল হিসেবে পাসিংয়ে সফলতার হার ৭০ শতাংশের নিচে। নিজেদের ডিফেন্সিভ থার্ডে মাত্র ৫১৮ পাস খেলতে পেরেছে! এটা কত কম, সেটা বোঝাতে আরেকটি তথ্য উপস্থাপন করা যায়। এই একই মৌসুমে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের সাতটি দল হেতাফের তুলনায় ওই পজিশনে চার গুণ বেশি পাস খেলেছে। শীর্ষ পাঁচ লিগ বিবেচনায় ফাউলের সংখ্যায়ও হেতাফে অন্যদের চেয়ে এগিয়ে, যেমনটা ছিল গত মৌসুমে এবং তার আগের মৌসুমেও।
সমর্থকদের ভেতর প্রচলিত একটি ধারণা হলো, ফুটবল মাঠের খেলা। সেটা বাতাসে খেললে খেলাটা বিরক্তিকর হয়ে ওঠে। ইংল্যান্ডের খেলা নিয়ে একসময় এমন একটা সমালোচনা ছিল। প্রিমিয়ার লিগে চেলসিকেও একসময় এমন নিন্দা শুনতে হয়েছে। মানে, বাতাসে ভাসানো লম্বা পাসে খেলার চেষ্টা। ক্রস থেকে হেডে গোল দেওয়া কিংবা বল দখলের চেষ্টা। তাতে খেলাটা আর ঘাসে থাকে না, যেটা দেখতে ভালো লাগে।
কিন্তু হেতাফের খেলায় এবার সেসব নেই। বাতাসে ভাসিয়ে খেলায় ক্লাবটি বাকিদের টেক্কা দিয়েছে—বাতাসে ৮৮৯ বার বল দখলের লড়াই করেছেন ক্লাবটির খেলোয়াড়েরা, যা অন্য দলগুলোর চেয়ে ১১২ বার বেশি। ৭৪ বার থ্রো করে তারা প্রতিপক্ষের পেনাল্টি বক্সে বল ফেলেছে, যেটাও অন্য দলগুলোর চেয়ে বেশি।
বোরদালাসের হেতাফের খেলাটা আসলে শরীরনির্ভর। যেটা বলতে পারেন ‘ডিরেক্ট ফুটবল’—চোখের জন্য অতটা জুতসই নয়। এই ছকের খেলা আনন্দ দেওয়ার জন্য নয়, বড় দলগুলোর দুর্বলতা বের করে তাদের হতাশ করার জন্য। লা লিগায় এবার এখন পর্যন্ত গোল করায় যৌথভাবে দ্বিতীয় সর্বনিম্ন (১৭) হেতাফে।
কিন্তু এটাও সত্য যে শুধু আতলেতিকো মাদ্রিদের ডিফেন্সিভ রেকর্ডই তাদের চেয়ে ভালো। আতলেতিকো লিগে এ পর্যন্ত ২১ ম্যাচে ১৪ গোল হজম করেছে, হেতাফে ১৭। গত সপ্তাহে বার্সেলোনাকে ঘরের মাঠে ১–১ গোলে আটকেও দেয় বোরদালাসের দল। কাতালান ক্লাবটির বিপক্ষে পাঁচ বছর ধরে ঘরের মাঠে অপরাজিত রইল হেতাফে।
এভাবে খেলা হেতাফের জন্য নতুন নয়। তবে প্রশ্নও উঠেছে এ মাসে। যেমন ধরুন, কোপা দেল রে–তে চতুর্থ স্তরের দল পন্তেভেদ্রার বিপক্ষে ম্যাচের দ্বিতীয় মিনিটে গোল পেয়েও শেষ পর্যন্ত ওই এক গোলের (১–০) জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছে হেতাফে। ফাউল করেছে ১৬টি, বল দখলে রেখেছে মাত্র ১৬ শতাংশ সময় এবং মাঠ ছেড়েছে ৯ জন নিয়ে। আরেকটু খোলাসা করে বললে, হেতাফের এই গোলবিমুখ হওয়ার পেছনে অন্য কারণও আছে। কোচ বোরদালাসের সবচেয়ে আস্থাভাজন সেন্টার ফরোয়ার্ড আসলে ফরোয়ার্ডই নয়!
নাইজেরিয়ান ২১ বছর বয়সী ক্রিস্টানতাস উচে আসলে ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। স্পেনের তৃতীয় বিভাগের দল সেউতায় খেলেছেন এক মৌসুম। হেতাফে গত বছর ফেব্রুয়ারিতে তাঁকে নিয়ে আসার পর গত আগস্টে অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের মাঠে অভিষেক ম্যাচেই গোল করে দলের হার এড়ান। এর পর থেকেই আক্রমণভাগের নেতৃত্বে উচে। পরিসংখ্যান বলছে, এবার লা লিগায় আক্রমণভাগের অন্য যেকোনো খেলোয়াড়ের চেয়ে বেশি ‘ডিফেন্সিভ রিকভারিজ’ করেছেন উচে।
হেতাফে এ মৌসুমে খেলা তৈরি করে মাত্র সাতবার আক্রমণ করতে পেরেছে, যেটাকে বলা হয় ‘বিল্ডআপ অ্যাটাক’। প্রতিপক্ষের বক্সে শট নেওয়ার আগে অন্তত ১০টি পাসে সে পর্যন্ত যাওয়ার হিসাবে এই সাতটি আক্রমণ। অন্য দলগুলোর সঙ্গে তুলনায় ব্যাপারটা ঠিক কোন পর্যায়ে, তা বুঝে নিতে পারেন ম্যানচেস্টার সিটির হিসাব দেখে। মৌসুমের এ পথ পর্যন্ত ১৭০টি বিল্ডআপ অ্যাটাক করেছে পেপ গার্দিওলার দল।
হেতাফের আক্রমণভাগ নিয়ে আরেকটি পরিসংখ্যান দেখলে চোখ কপালে উঠতে পারে। তাদের আক্রমণভাগের তিন খেলোয়াড় উচে, রদ্রিগেজ ও ইলদ্রিম নিজেদের মধ্যে মোট ৩৪০ বার বাতাসে ভেসে আসা বল দখলের চেষ্টা করেছেন, যা রিয়াল মাদ্রিদ (৩১৪) ও জিরোনার (৩৩২) গোটা দলের চেয়ে বেশি।
বোরদালাসকে খেলার এমন ধরন নিয়ে কথাও শুনতে হয়েছে। বিলবাও ফরোয়ার্ড ইনাকি উইলিয়ামস ‘সময় নষ্ট করা’র জন্য হেতাফের সমালোচনা করেছিলেন। বোরদালাস উত্তরে বলেছিলেন, ‘ক্লাব ও ভক্তদের জন্য খেলি আমরা। অন্যদের মতামতকে আমি শ্রদ্ধা করি। তবে নিজেদের ভক্তদের বলছি, এসব কানে তোলার প্রয়োজন নেই। তার বদলে দেখুন, এই দলটা কত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ এবং সৎ। বাজেটে অনেক বড় বড় দলকে হারানোর চেষ্টা করছে। এটাই ফুটবল। খেলোয়াড়দের আমি এটাই বলি।’