হতে চেয়েছিলেন ফুটবলার, হয়ে গেলেন জেমস বন্ড
‘বন্ড, জেমস বন্ড।’
ইয়ান ফ্লেমিংয়ের কালজয়ী চরিত্রের কালজয়ী সংলাপ। সিনেমার পর্দায় বেশ কয়েকজন অভিনেতাকে দেখা গেছে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিসের এই বিশ্বখ্যাত এজেন্টের চরিত্রে। কিন্তু আজ আমরা যে ভদ্রলোকের কথা বলব, তিনি বাকি সবার চেয়ে একটু আলাদা।
সিনেমার ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে জনপ্রিয় এই সংলাপ প্রথম শোনা গিয়েছিল তাঁর মুখে। লম্বায় ৬ ফুট ২, জাতে স্কটিশ। জেমস বন্ড সিনেমার যাঁরা ভক্ত, তাঁরা এরই মধ্যে চিনে ফেলেছেন ভদ্রলোককে।
যাঁরা চেনেননি আরও একটু জেনে নিন, দ্য আনটাচেবলস ছবিতে অভিনয়ের জন্য ইনি চলচ্চিত্রের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার অস্কার জিতেছিলেন ১৯৮৭ সালে। পিপল ম্যাগাজিনের জরিপে ৬৯ বছর বয়সেও হয়েছিলেন শতাব্দীর সবচেয়ে আবেদনময়ী পুরুষ!
৯০ বছর বয়সে ২০২০ সালে পরপারে চলে যাওয়ার আগেই জেমস বন্ডের সাতটা সিনেমা ছাড়াও তিনি উপহার দিয়েছেন দ্য হান্ট ফর রেড অক্টোবর (১৯৯০), দ্য রাশা হাউস (১৯৯০), দ্য রক (১৯৯৬) ও এনট্রাপমেন্ট (১৯৯৯)-এর মতো বক্স অফিস কাঁপানো অনেক ছবি। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ভদ্রলোকের চেহারাটা ভেসে উঠেছে চোখের সামনে? শন কনারি।
অস্কারজয়ী পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ একবার বলেছিলেন, ‘পৃথিবীর ইতিহাসে শুধু সাতজন সুপারস্টার অভিনেতা আছেন। শন কনারি তাঁদের একজন।’ এই কথার পর কনারিকে নিয়ে আর কিছু বলার থাকে না। কিন্তু তাহলে আর হঠাৎ তাঁকে নিয়ে গল্প ফাঁদা কেন! তার মানে কিছু কথা আছে।
ধরুন যদি বলি, অভিনেতা নয়; আসলে কনারির হওয়ার কথা ছিল দুর্দান্ত ফুটবলার! বিশ্বাস করবেন না জানি। তাহলে বাসবিকে সাক্ষী আনতে হবে। বাসবিকে চিনেছেন তো? ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডকে ইউরোপিয়ান কাপ (এখনকার চ্যাম্পিয়নস লিগ) জেতানো কিংবদন্তি কোচ স্যার ম্যাট বাসবি। ইনিও স্কটিশ।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, কনারির বয়স তখন ২২–২৩। ‘বনিরিগ রোজ’ নামে স্কটল্যান্ডের স্থানীয় ক্লাবে রাইট উইঙ্গার হিসেবে খেলেন। কিন্তু শখ অভিনয় করা। একটা ব্রেক খুঁজছেন সিনেমায়।
বাসবি ইউনাইটেডে বেশ কয়েকটা মৌসুম কাটিয়েছেন। তাঁর দলটা প্রথমবার ইংলিশ প্রথম বিভাগ লিগ (এখনকার প্রিমিয়ার লিগ) জেতে ১৯৫১-৫২ মৌসুমে। ১৯৫৩-৫৪ মৌসুম শুরুর আগে দলবল নিয়ে বাসবি প্রাক্মৌসুম সফরে গেলেন স্কটল্যান্ডে। সেই সফরেই মাঝেমধ্যে বাসবি বিকেলে বের হতেন স্থানীয় বিভিন্ন ক্লাবের খেলা দেখতে। উদ্দেশ্য, যদি হঠাৎ কাউকে চোখে লেগে যায়।
সত্যি সত্যি একদিন লেগে গেল। বনিরিগ রোজ-এর একটা ম্যাচ দেখতে গিয়ে বাসবির চোখে পড়ল কনারিকে। পুরো ম্যাচটা মাঠে বসে দেখলেন তিনি। তারপর ম্যাচ শেষে তাকে ডেকে আনলেন কনারিকে। ‘তুমি আমার দলের হয়ে খেলো, সপ্তাহে ২৫ পাউন্ড করে দেব’—আকস্মিক প্রস্তাবটা পেয়ে দারুণ রোমাঞ্চিত কনারি।
কিন্তু জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিতে গিয়ে ভাবনায় পড়ে গেলেন তিনি। ‘ফুটবলার হলে ৩০ পেরিয়ে একসময় আমাকে অবসরের কথা ভাবতে হবে। কিন্তু অভিনয়টা হয়তো আমি সারা জীবন করে যেতে পারব’—ঠিক এ কথাই নাকি মনে এসেছিল তাঁর সেই সময়। ফিরিয়ে দিলেন বাসবির প্রস্তাব।
কী হতো, যদি সেদিন বাসবির প্রস্তাবটা গ্রহণ করতেন কনারি? এক মৌসুম পরই আবারও ইংলিশ লিগ জেতে ইউনাইটেড। তারপর আরও কয়েকবার। কনারি হয়তো সেই দলের অংশ হতেন। বাসবির সেই দলে ১৯৫৬ সালে যোগ দিয়েছিলেন কিংবদন্তি স্যার ববি চার্লটন (তখন অবশ্য কিংবদন্তি হননি), কনারি তাঁর সতীর্থ হতেন। কে জানে, ক্যারিয়ারটা যদি দীর্ঘ করতে পারতেন, হয়তো জেতা হতো ইউনাইটেডের হয়ে ১৯৬৭-৬৮ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগও! হতে পারতেন ইংল্যান্ডের হয়ে ১৯৬৬ বিশ্বকাপজয়ী খেলোয়াড়ও!
কিন্তু তখন ট্রেরেন্স ইয়াং কাকে নিয়ে ডক্টর নো বানাতেন? লা সের্কেলের পুকার টেবিলে বসে ধূম্রশলাকা ঠোঁটে কে বলতেন,‘বন্ড, জেমস বন্ড!’
