নেইমারের বাড়তি ওজন: সাধারণ মানুষের কী ভাবনা আর বিশেষজ্ঞরাইবা কী বলছেন

চোটের কারণে মাঠের বাইরে থাকার পর সম্প্রতি আল হিলালে ফিরেছেন নেইমার। ছবিটি সৌদি আরবে নামার পর তোলাআল হিলাল

চোট কাটিয়ে চার মাস পর আল হিলালে ফিরেছেন নেইমার। গত বছর ৩ অক্টোবর সৌদি ক্লাবটির হয়ে সর্বশেষ ম্যাচ খেলেন ব্রাজিল তারকা। ক্লাবে ফিরলেও নেইমারকে আপাতত স্কোয়াডে অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ নেই আল হিলালের। গত বছরের অক্টোবরে ব্রাজিলের ম্যাচে নেইমার চোটে পড়ার পর তাঁকে বাদ দিয়ে এ মৌসুমে আল হিলাল বিদেশি খেলোয়াড়ের কোটা পূরণ করেছে। কিন্তু অনুশীলন করতে তো বাধা নেই! গত শুক্রবার তাই আল হিলাল সতীর্থদের সঙ্গে অনুশীলন করেন নেইমার। আর অনুশীলনে নেইমারের ছবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ার পর তাঁর ফিটনেস নিয়েও হচ্ছে সমালোচনা।

আরও পড়ুন

বেশির ভাগের দাবি, নেইমারের ওজন অতিরিক্ত বেড়েছে। স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম ‘মার্কা’র যুক্তি, অনুশীলনে নেইমারের ছবি যে অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা হয়েছে, সেই ছবি দেখে মনে হতে পারে তাঁর ওজন অতিরিক্ত বেড়েছে। কিন্তু অন্য অ্যাঙ্গেল থেকে তোলা ছবি দেখে অতটা মনে হয় না। তবে এটাও সত্য ৩২ বছর বয়সী একজন ফুটবলারের ওজন ও ফিটনেস যেমন হওয়া উচিত—নেইমার সেই অবস্থায় নেই। নেইমারের একটু স্থূল শরীরের ছবি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে রঙ্গ–তামাশাও করছেন সমর্থকেরা। এদিকে তাঁর এই ওজন বাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছে ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম ‘ও গ্লোবো’।

আল হিলালে ফেরার পর ক্লাবটির অনুশীলনে যোগ দিয়েছেন নেইমার। সেই অনুশীলনেরই একটি ভিডিও ক্লিপ থেকে ছবিটি নেওয়া হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেইমারের এই ছবিটিই তাঁর বাড়তি ওজন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে
ভিডিও থেকে নেওয়া

বাঁ হাঁটুর লিগামেন্টে চোট পাওয়ার পর গত চার মাস নেইমার কীভাবে কাটিয়েছেন, সেটি আগেই জানিয়ে রাখা ভালো। এমনিতে পুনর্বাসন প্রক্রিয়া মেনে চলার ধকল তো ছিলই। তার বাইরে সময়টা ভালো কেটেছে নেইমারের। কন্যাসন্তানের বাবা হয়েছেন, সময় দিয়েছেন পরিবার ও বন্ধুদের। বড়দিন পালন, নতুন বছর বরণের পাশাপাশি নিজের ৩২তম জন্মদিনও ধুমধাম করে মানগারাতিবায় নিজের বাড়িতেই উদ্‌যাপন করেছেন নেইমার। শৈশবের ক্লাব সান্তোসের খেলাও দেখেছেন মাঠে বসে। এ ছাড়া নিজের প্রমোদতরি ভাসিয়ে দিয়ে গভীর সমুদ্রে ঘুরতে বেরিয়েছেন।

আরও পড়ুন

নেইমার এখনো চোট সারিয়ে পুরোপুরি খেলার মতো অবস্থায় ফিরে আসেননি। তাঁর পায়ে অস্ত্রোপচার করা ব্রাজিল জাতীয় দলের মেডিকেল স্টাফ এর আগে জানিয়েছিল, এ চোট থেকে তাঁর পুরোপুরি সেরে উঠতে কমপক্ষে ৬ থেকে ৮ মাস লাগবে। ‘ও গ্লোবো’ এ নিয়ে ফুটবলের বাইরের অঙ্গনে বিশেষজ্ঞের সঙ্গেও কথা বলেছে। ব্রাজিলের জাতীয় জুডো দলের ট্রেনারের (২০১২–২১) দায়িত্ব পালন করা ওয়াগনার জাক্কানির সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলেছে সংবাদমাধ্যমটি। তার মতে, কোনো রকম ঝুঁকি ছাড়া এসব চোট পুরোপুরি সেরে উঠে খেলার মতো অবস্থায় ফিরতে প্রায় ১০ থেকে ১২ মাস সময় লাগে। এমন সময় পাওয়া গেলে একই চোট ফিরে আসার সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যায় বলে মনে করেন জাক্কানি। ব্রাজিলিয়ান জুডোতে পরিচিত মুখ জাক্কানি এটাও জানিয়েছেন, নেইমার এ সময়ের মধ্যে তাঁর খানিকটা স্ফীত পেটের মেদও ঝরিয়ে ফেলতে পারবেন।

আল হিলালে ফিট হয়ে ওঠার চেষ্টায় মগ্ন নেইমার
আল হিলাল

ছিপছিপে গড়ন থেকে নেইমারের শরীরে খানিকটা মেদ জমার ব্যাখ্যাও দিয়েছেন জাক্কানি। অস্ত্রোপচারের পর অ্যাথলেটদের ওজন বেড়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক বলেই মনে করেন তিনি। কারণ, অস্ত্রোপচার করানোর পর খেলোয়াড়েরা বিশ্রামে থাকেন, অনুশীলনের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রিত খাবার–দাবার থেকেও বিরত থাকেন। তবে জাক্কানি স্বীকার করেছেন, নেইমারের বর্তমান ফিটনেস দেখে তিনিও বেশ অবাক হয়েছেন। ভেবেছিলেন ছবিটি বুঝি এডিটিংয়ের কারসাজি!

জাক্কানি বলেছেন, ‘এটা (ওজন বেড়ে যাওয়া) স্বাভাবিক। কিন্তু একজন পেশাদার অ্যাথলেটের কাছে আমরা এটা আশা করতে পারি না। (নেইমারকে দেখে) যদি আমি বিস্মিত হতে পারি—যে জানে অ্যাথলেটদের পূর্ণ ফিটনেসে আসার প্রক্রিয়া—তাহলে একবার সমর্থকদের কথা ভাবুন, যাঁরা এই প্রক্রিয়া সমন্ধে জানেন না। হ্যাঁ, বর্তমান অবস্থা থেকে নিজেকে পুরো ফিটনেসে আসার প্রক্রিয়াটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সীমানাটা কী? এতে (অতিরিক্ত ওজন) পুনর্বাসন প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।’

আরও পড়ুন

জুডোয় তিনবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং টানা তিন অলিম্পিকে (২০১২, ২০১৬ ও ২০২০) ব্রোঞ্জজয়ী ব্রাজিলের জুডোকা মায়রা আগুয়ার টোকিও অলিম্পিকের (২০২০) আগে বাঁ হাঁটুতে চোট পেয়েছিলেন। জাক্কানির পরামর্শে পরে ফিট হয়ে টোকিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন মায়রা।

নেইমারকে নিয়ে জাক্কানি বলেছেন, ‘নেইমারের দল তাকে অবশ্যই এ (ওজন কমানোয়) ব্যাপারে সাহায্য করবে। আর অ্যাথলেটদের ক্ষেত্রে এসব পরিস্থিতিতে তারা মানসিকভাবে ভালো থাকলে অবশ্যই সুস্থ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াও দ্রুততর হবে। কিন্তু ব্যাপার হলো আমরা নেইমারকে এমন পরিস্থিতিতে দেখতে চাই না। কারণ, এসব বিতর্ক তৈরি করে...পার্টিতে যাওয়া, সমুদ্রবিহার...নিজের যত্নটা তো নিতে হবে। তার ব্যাপারটাও (পার্টিপ্রীতি) না হয় বোঝা গেল। এমন হতেই পারে। কিন্তু তার একটা সীমা থাকা চাই।’

নেইমার কবে মাঠে ফিরবেন সেটি এখনো নিশ্চিত নয়
আল হিলাল

ফিজিওলজিস্ট আন্দ্রে লোপেজ মানুষের নড়াচড়া সম্পর্কিত বিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন। ব্রাজিল ফুটবল কনফেডারেশনে (সিবিএফ) কোচদের কোর্সের শিক্ষকও তিনি। লোপেজের মতে, শুধু ছবি দেখে নেইমারের শারীরিক অবস্থা বিশ্লেষণ করা সম্ভব নয়। ব্রাজিল তারকার খেয়ালখুশিমতো জীবনযাপনকে তাঁর ওজন বাড়ার একমাত্র কারণ হিসেবে দেখেন না লোপেজ। নেইমার ঠিক এই মূহূর্তে নিয়ন্ত্রিত খাবার বিধিমালা অনুসরণ করছেন কি না, সেটাও একটা প্রশ্ন।

আরও পড়ুন

লোপেজ বিষয়টি ব্যাখ্যা করলেন এভাবে, ‘আমাদের মস্তিষ্ক আদিম প্রবৃত্তিসম্পন্ন। সে (মস্তিষ্ক) সবচেয়ে বেশি শক্তি যেখানে, সেখান থেকেই খাবার নিতে চাইবে। কারণ, বেঁচে থাকাটাই তার লক্ষ্য। শরীরের যতটুকু প্রয়োজন, সে অনুসারে শক্তিও ধারাবাহিকভাবে খরচ করতে হয়। আর উচ্চমানের অ্যাথলেটদের প্রচুর ক্যালোরির প্রয়োজনও হয়। কারণ, তারা এটা পোড়ায়ও বেশি। কিন্তু এই কাজটা (ক্যালরি পোড়ানো) যখন থেমে যায়, ধরুন চোট কিংবা অন্য কোনো কারণে অনুশীলনও থামিয়ে দিলে মস্তিষ্কের ভাবনাকেও নতুন করে সাজানো প্রয়োজন। শরীরকে বলতে হয়, হাজার হাজার ক্যালোরির আর প্রয়োজন নেই। কারণ, পূর্ণমাত্রায় অনুশীলন চলাকালীন যে পরিমাণ ক্যালোরির প্রয়োজন হতো, মস্তিষ্ক তখনো সেটাই দাবি করে (শরীরের কাছে)।’

নেইমারের মানের অ্যাথলেটের এ মুহূর্তে শরীরে মেদ লাগার ব্যাখ্যাও করেছেন লোপেজ, ‘যারা স্বাস্থ্যসচেতন, তাদের ক্ষেত্রেও এটা (মোটা হওয়া) হতে পারে। এটা গুরুত্বপূর্ণ যে শরীরনির্ভর কর্মকাণ্ড পুরোপুরি বন্ধ না করে মস্তিষ্ককে নতুন করে ভাবনার সময় দেওয়া। নেইমারকে সাহায্য করতে তার আশপাশে সেরা সব পেশাদার লোকদের অভাব নেই। এ জন্য তাকে দোষ দেওয়া যায় না। কারণ, এসব বিষয় জনপ্রিয় সব মতামত ছাপিয়ে আরও অনেক গভীরে নিহিত।’

একই চোটে বার বার পড়তে না চাইলে জীবনযাপনের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে নেইমারকে
আল হিলাল

ব্রাজিলের পুষ্টিবিদ রোবের্তা লিমা পেশাদার তায়কোয়ান্দো, জুডো, বিচ ভলিবল ও ট্রায়ালথনে কাজ করেছেন। তাঁর যুক্তি, শারীরিক কাজকর্ম পুরোপুরি বন্ধ না করে নেইমারের উচিত চোটের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত নয়, এমন সব মাংসপেশি নিয়ে কাজ করা, ‘এ সময়ে ওজন বাড়ার কারণগুলো বহুমাত্রিক। ক্যালোরি খরচ কমে যাওয়া, দুশ্চিন্তা থেকে খিদে বেড়ে যাওয়া এবং সামনে কোনো লক্ষ্য না থাকায় স্বাভাবিকভাবেই ব্যাপারটা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। কিন্তু এরপরও কর্মক্ষম থাকার ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। মেদ বাড়তে দেওয়া যাবে না।’