ঢাকায় প্রথম ফুটবল খেলার আনন্দ

বিজয়ী জারা গ্রিন ভয়েস কিশোর বাংলা ক্লাবের ফুটবলাররা স্বপ্ন দেখে বড় ফুটবলার হওয়ার।ছবি: প্রথম আলো

ফুটবল নিয়ে মানুষের স্বপ্নগুলো লুট হতে দেখে জালাল হোসেনের নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায়। সৈয়দ শামসুল হকের জন্মস্থান কুড়িগ্রামে বসেই নূরলদীনের মতো বলতে থাকেন, ‘জাগো, বাহে, কুনঠে সবাই।’

জালাল হোসেনের ডাকে ঠিকই জেগে উঠেছে কুড়িগ্রাম সদরের কৃষ্ণপুর ডাকুয়াপাড়া ফুটবল একাডেমি। স্থানীয়ভাবে যেটি ‘ফুটবলের জমিদারবাড়ি’ বলে পরিচিত। এই একাডেমির একঝাঁক ফুটবলার এবারের পাইওনিয়ার লিগ মাতিয়েছে জারা গ্রিন ভয়েস কিশোর বাংলা ক্লাবের জার্সিতে। পুরো লিগে টানা ৯ ম্যাচ অপরাজিত (৮ জয়, ১ ড্র) ছিল দলটি। লিগে প্রতিপক্ষের জালে সর্বোচ্চ ৬৩ গোল দিয়ে নিজেরা খেয়েছে মাত্র ৮ গোল। বসুন্ধরা কিংস অ্যারেনায় গত ৮ জুলাই অনুষ্ঠিত ফাইনালে টাইব্রেকার নামের লটারি–ভাগ্যে বরিশাল ফুটবল একাডেমির কাছে হেরে রানার্সআপ হয়েছে। দলটির এমন সাফল্যের পেছনের কারিগর জালাল হোসেন, যিনি একই সঙ্গে কোচ ও ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক।

স্বপ্ন চোখে কিশোর ফুটবলাররা...জারা গ্রিন ভয়েস কিশোর বাংলা–তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল কোয়ার্টার ফাইনালের আগে
ছবি: শামসুল হক

শুধু জারা গ্রিন ভয়েস কিশোর বাংলা ক্লাব নয়, আরও অনেক ক্লাবের ফুটবলারই প্রথমবার পাইওনিয়ার লিগে খেলতে এসে স্বপ্ন দেখছে বড় ফুটবলার হওয়ার। তবে প্রথমবার পাইওনিয়ারে খেলার রোমাঞ্চ যেমন ছিল, তেমনি ছিল অনেক না পাওয়ার কষ্ট। বিশেষ করে মাঠ নিয়ে অসন্তুষ্টির কথা শোনা গেছে অনেক ফুটবলারের কণ্ঠে। প্রান্তিক জুনিয়র ক্লাবের ফুটবলার সাখাওয়াতুন্নবী মানিক বলছিল, ‘উত্তরার মাঠে ঘাস নেই, বালুর মধ্যে খেলেছি। গোপীবাগ ব্রাদার্স ইউনিয়নের মাঠেও একেবারে অল্প ঘাস। এমন মাঠে খেলতে গিয়ে আমাদের অনেকে চোটে পড়েছিল। পল্টনের মাঠ ভালো নয়। এই মাঠটা ছোট।’

আরও পড়ুন
ক্লাবগুলো ঠিক না হলে আমাদের কী করার আছে? সবাই চায় বেশি বয়সী খেলোয়াড় নিয়ে জিততে। ক্লাবগুলোকে সৎ হতে হবে। চূড়ান্ত পর্বে সব মাঠেই গিয়ে দেখেছি, খেলোয়াড়দের মেধা আছে, কিন্তু ছেলেদের আমরা যথাযথ পরিচর্যা করছি না। এখানেই বড় ঘাটতি।
মহিদুর রহমান, পাইওনিয়ার লিগ কমিটির ডেপুটি চেয়ারম্যান ও বাফুফে সদস্য
কিশোরদের এই উচ্ছ্বাস কেন হারিয়ে যায়?
ছবি: প্রথম আলো

পাইওনিয়ারে খেলতে আসা বেশির ভাগ ফুটবলারের গল্প যেন একই। শুধু ফুটবল ভালোবেসে, খেলার টানে সব কষ্ট সইতে রাজি এই কিশোরেরা। জারা গ্রিন ভয়েস ক্লাবের কথাই ধরা যাক। ঢাকায় দীর্ঘমেয়াদে আবাসিক ক্যাম্প করানোর সামর্থ্য ছিল না ক্লাবটির। এ জন্য পাইওনিয়ারে নাম নিবন্ধনের পর ঢাকার বিভিন্ন সংগঠকের কাছে বিনা মূল্যে আবাসন ব্যবস্থা পেতে অনুরোধ করেন জালাল হোসেন। সবাই যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলেন, তখন সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন ব্রাদার্স ইউনিয়নের কর্মকর্তা ও সাবেক ফুটবলার আমের খান। তিনি গোপীবাগে লিটল ফ্রেন্ডস ক্লাবে জারা গ্রিন ভয়েস ক্লাবের ফুটবলারদের বিনা মূল্যে আবাসিক ক্যাম্পের ব্যবস্থা করেন। জারা গ্রিন ভয়েস ক্লাবের আর্থিক অবস্থা এমই খারাপ ছিল যে, একজন বাবুর্চিও রাখতে পারেনি। ছিল না কোনো ম্যানেজার। ফুটবলাররাই বাজার–সদাই করত। নিজেদের রান্না নিজেরাই করত। স্যাঁতসেঁতে গুদামঘরের মতো কক্ষে গাদাগাদি করে থাকত। এমনকি জায়গার অভাবে রান্নাঘরেও শুতে হয়েছে অনেক ফুটবলারকে!

জারা গ্রিন ভয়েস ক্লাবের বেশির ভাগ ফুটবলার সুবিধাবঞ্চিত পরিবারের। কারোর বাবা অটোরিকশাচালক, কারোর বাবা কাঠমিস্ত্রি, আবার কারোর বাবা চা–দোকানি। তাদেরই একজন কোয়ার্টার ফাইনালে ম্যাচসেরা হওয়া মিডফিল্ডার পাপ্পু হোসেন। নির্মাণশ্রমিক অসুস্থ বাবা স্বপ্ন দেখছিলেন, ছেলে একদিন ঢাকায় ফুটবল খেলবে। ঢাকায় খেলার সুযোগ পেয়ে তাই খুশি পাপ্পু ‘এর আগে বসুন্ধরা কিংস অনূর্ধ্ব-১৪ একাডেমি কাপে খেলেছিলাম ঢাকায় এসে। কিন্তু ওই টুর্নামেন্ট খুব অল্প সময়ে শেষ হয়ে গিয়েছিল। ম্যাচগুলো হতো কম সময়ের। কিন্তু পাইওনিয়ারে খেলে আসল ফুটবলটা উপভোগ করতে পারছি।’ হাতে ধরা ম্যাচসেরার পুরস্কারের চেয়েও পাপ্পুর কাছে বড় ঢাকার মাঠে খেলার সুযোগ ‘স্যারেরা এখানে খেলতে এনেছেন, এর চেয়ে বড় পুরস্কার আর কিছু হতে পারে না।’

কিশোর ফুটবলারদের যত্ন নেওয়ার কথা ভাবে না কেউ।
ছবি: প্রথম আলো
ভালো ফুটবলের জন্য ভালো মাঠের বিকল্প নেই। কিন্তু পাইওনিয়ার লিগ অনেক সময় ভালো মাঠে আয়োজন করা সম্ভব হয় না। কারণ, ঢাকায় মাঠের স্বল্পতা আছে। তারপরও বলব, পাইওনিয়ার লিগটাকে আরও গুরুত্ব দিয়ে ভালো মাঠের ব্যবস্থা করা উচিত। এই লিগের আরও যত্ন নিতে হবে। নইলে নতুন প্রজন্ম থেকে মেধাবী ফুটবলার বেরিয়ে আসবে না।
বিজন বড়ুয়া, পাইওনিয়ার লিগ কমিটির সাবেক ডেপুটি চেয়ারম্যান ও বাফুফে সদস্য

তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের মিডফিল্ডার হৃদয় বাসফোরও এই প্রথম ঢাকায় খেলেছে। বাবা দিনাজপুরের বিরামপুর শহরের ফুটপাতে জুতা সেলাই করেন। বিরামপুর পাইলট উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে যখন বড় ভাইয়েরা ফুটবল খেলত, পাশে দাঁড়িয়ে দেখত হৃদয়। বুট ছিল না বলে কেউ তাকে খেলতে নিত না। শেষ পর্যন্ত এক বড় ভাই বুট উপহার দিলে ফুটবল খেলার শুরু হৃদয়ের। পাইওনিয়ারে খেলতে এসেই বাফুফের কোচদের নজরে পড়ে হৃদয়। কোয়ার্টার ফাইনালে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল হারলেও হৃদয়কে বয়সভিত্তিক ক্যাম্পের জন্য ডেকেছেন বাফুফের কোচেরা। দিনাজপুর থেকে উঠে আসা হৃদয়ের স্বপ্ন একদিন জাতীয় দলে খেলার ‘প্রথম যেদিন খোকন স্যার (কোচ ইমদাদুল হক) আমাকে ঢাকায় খেলার খবরটা দেন, সেদিন খুব খুশি হয়েছিলাম। বাবা চান, আমি যেন বড় ফুটবলার হই, জাতীয় দলে খেলি। ফুটবল খেলে বাবার কষ্ট দূর করতে চাই।’

এর আগেও ঢাকায় এসেছিল প্রান্তিক জুনিয়র ক্রীড়াচক্রের স্ট্রাইকার সুজন হোসাইন। বাফুফের এলিট একাডেমির বাছাইয়ে বাদ পড়ে সেবার মন খারাপ হয় সুজনের। কিন্তু এবারের লিগে এরই মধ্যে ১৩ গোল করে বিভিন্ন ক্লাবের নজরে পড়েছে যশোর শামস–উল হুদা একাডেমির ফুটবলার। সুজন এখন স্বপ্ন দেখছে ঢাকার ক্লাবে খেলার, ‘দ্বিতীয় বিভাগের কয়েকজন কোচ আমার সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। লিগে যেভাবে খেলেছি, আশা করি দ্বিতীয় বা তৃতীয় বিভাগে খেলার সুযোগ পাব।’

আজকের কিশোর হবে আগামী দিনের ফুটবল তারকা। এই পাইওনিয়ার লিগ খেলার পরই পাপ্পু, সুজনদের মতো উঠতি ফুটবলাররা স্বপ্নের ছবিগুলো আঁকতে শুরু করেছে নতুন রঙে।