ইস্তাম্বুলের অলৌকিক রাত: ছয় মিনিটের ম্যাজিকে লিভারপুলের অসম্ভবকে সম্ভব করার গল্প
চ্যাম্পিয়নস লিগ তো বটেই, অনেকের কাছে ম্যাচটি ক্লাব ফুটবলের ইতিহাসেই অন্যতম সেরা। বলা হচ্ছে, ২০০৪–০৫ মৌসুমে লিভারপুল–এসি মিলানের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের কথা। অবিশ্বাস্য সে ম্যাচটিকে ফুটবল বিশ্ব মনে রেখেছে, ‘মিরাকল অব ইস্তাম্বুল’ নামে। ইস্তাম্বুলে সেদিন ম্যাচের ৪৪ মিনিটের মধ্যে ৩–০ গোলে পিছিয়ে পড়েছিল লিভারপুল। কিন্তু বিরতির পর ভোজবাজির মতো বদলে যায় সব। ৫৪ থেকে ৬০—এই ছয় মিনিটের মধ্যে ৩ গোল করে অবিশ্বাস্যভাবে ম্যাচে সমতা ফেরায় লিভারপুল। এরপর টাইব্রেকারে গিয়ে রাফায়েল বেনিতেজের দল ফাইনাল জিতে নেয় ৩–২ গোলে। সেদিন ৩ গোলে পিছিয়ে পড়েও কীভাবে লিভারপুল প্রত্যাবর্তনের অবিশ্বাস্য গল্প লিখেছিল, তা উঠে এসেছে দলটির তখনকার অধিনায়ক কিংবদন্তি স্টিভেন জেরার্ডের ‘জেরার্ড মাই অটোবায়োগ্রাফি’ বইয়ে। আজ আরও একটা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল সামনে রেখে লিভারপুলের সেই রূপকথার মতো প্রত্যাবর্তনের গল্প।
দ্বিতীয়ার্ধে যা ঘটেছিল, কী লিখেছেন জেরার্ড
অবিশ্বাস্য! লিভারপুল ৩-০ ব্যবধানে পিছিয়ে। কাকা ও ক্রেসপোয় বিধ্বস্ত। আমাদের সমর্থকেরা গাইছে ‘ইউ উইল নেভার ওয়াক অ্যালোন’।
সব খেলোয়াড় একে অন্যের দিকে বিস্ময় আর গর্ব নিয়ে তাকালাম। আমি চিৎকার করে বললাম, ‘তারা এখনো আমাদের ওপর থেকে বিশ্বাস হারায়নি। তাই আমরাও হাল ছাড়তে পারি না। চলো তাদের উল্লাস করার মতো কিছু দেওয়া যাক। তারা অনেক টাকা খরচ করেছে। তারা আমাদের নামে ধরে গান গাইছে আর আমরা ৩ গোল খেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেছি। যদি আমরা একটা গোল দিতে পারি, তারা আরও বেশি শক্তিশালী হয়ে আমাদের পাশে থাকবে। সেটা আমাদের আরও একটা দেওয়ার জন্য সাহস দেবে। চলো এগিয়ে যাই।’
অধিনায়ক হিসেবে ঘুরে দাঁড়ানোয় নেতৃত্ব দেওয়াটা আমার দায়িত্ব ছিল। যখন টানেল দিয়ে ঝড়ের মতো ছুটে আসছিলাম, চোখ ছিল মিলান খেলোয়াড়দের দিকে। ওদের বিভ্রান্ত মনে হলো। কারণ, ওরা যখন মাঠে ফিরছিল, শুধুই লিভারপুল সমর্থকদের চিৎকার শোনা যাচ্ছিল। এমনকি আমাদের প্রতি সমর্থনের গর্জন শুনে আমি নিজেও ধাক্কা খেয়েছিলাম। মিলানের সমর্থকেরাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল।
লিভারপুলের হাতে ছিল মাত্র ৪৫ মিনিট—তিনটা গোল করতে হবে। খেলা আবার শুরু হতেই আমি দলকে চিৎকার করে বললাম, ‘ঝাঁপিয়ে পড়ো!’
সঙ্গে সঙ্গে আমরা এটাও টের পেলাম যে চ্যালেঞ্জটা কত বিশাল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই শেভচেঙ্কো একটা ফ্রি-কিক নিল, তবে জার্জি (ডুডেক) সেটা হাত মুষ্টিবদ্ধ করে ফিরিয়ে দিল। আমি যেটাকে বলি ‘ক্যামেরা সেভ’, মানে টেলিভিশনে ভালো দেখায় এমন সেভ। ওটা কোনো দুর্দান্ত ফ্রি-কিক ছিল না। যেকোনো গোলকিপারই ওটা ঠেকাতে পারত।
মিলানের সেই সুযোগ মিস করার পর পরিস্থিতি একটু শান্ত হয়ে এল, আমি ওদের খেলোয়াড়দের দিকে তাকালাম। ওরা যেন কিছুটা বদলে গেছে। আত্মতুষ্টি চলে এসেছে শরীরী ভাষায়। যেন ভাবছিল, কাজ শেষ হয়ে গেছে। এমনকি একটা গোল যদি খেয়েও বসে, মালদিনি আর ওর সঙ্গীরা পরিষ্কারভাবেই বিশ্বাস করছিল যে ৩-১ ব্যবধানে ওরা ম্যাচটা বের করে আনবেই।
ডিডি (দিয়েতমার হামান) নামায় আমি ম্যাচ নিয়ন্ত্রণের মূল কাজ থেকে কিছুটা মুক্তি পেলাম, আরও বেশি করে আক্রমণে উঠছিলাম। ওর মাঠে নামাটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি বেনিতেজ আবার ইস্তাম্বুলের একাদশ বেছে নেওয়ার সুযোগ পেত, সে অবশ্যই ওকে শুরু থেকেই খেলাত—সে দ্বিতীয়ার্ধে দুর্দান্ত খেলেছে। প্রথমার্ধে মিলান আমাদের এত সমস্যায় ফেলেছিল শুধু একজন হোল্ডিং মিডফিল্ডার না থাকায়।
ডিডি আমার পেছনে পাহারায় ছিল, আর আমি ঝাঁপিয়ে পড়লাম মিলানের ওপর। সময় হয়েছে ওদের বাঁকা হাসিটা মুছে দেওয়ার, কিছু ঝুঁকি নেওয়ার। আমি ওপরে উঠতে শুরু করলাম।
৫৪ মিনিটে জিঞ্জার (রিস) বল পেল বাঁ দিকে, আমি মিলানের ডি বক্সের দিকে ছুটতে শুরু করলাম। কিন্তু রিসের ক্রসটা কাফু আটকে দিল। আমি থেমে গেলাম, তারপর আবার ছুটলাম। একটা জুয়া খেললাম। মনে হলো বলটা আবার আসতে পারে। জিঞ্জার বাজিমাত করল, কাফু আবার ক্লোজ করতে যাওয়ার আগেই দারুণভাবে বলটা পাঠাল বক্সে। আমি ছিলাম গোল থেকে ১২ গজ দূরে, আর সামনে মাত্র এক গজ ফাঁকা জায়গা। রিসের বলটা দ্রুতগতিতে আসছিল। সেই গতিই ব্যবহার করলাম। দিদা (মিলানের গোলকিপার) হাত বাড়াল, কিন্তু বলটা তার ওপর দিয়ে চলে গেল—গোল! দারুণ এক হেড! ওই মৌসুমে আমার একমাত্র হেডে করা গোল এবং ওই চ্যাম্পিয়নস লিগে লিভারপুলের একমাত্র হেডে গোল।
আর সবই হলো ডিডি আর জিঞ্জারের জন্য। ডিডি যদি বেঞ্চের মধ্যে থাকত, আমি কখনো এতটা সামনে উঠতাম না। রাফাকেও কৃতিত্ব দিতে হয় যে সে কৌশল পাল্টে ফেলেছিল। আমি দৌড়ে গেলাম লিভারপুল সমর্থকদের দিকে, তাদের উৎসাহ দিতে হাত নেড়েছিলাম। জানতাম ওরা কেমন প্রতিক্রিয়া দেখাবে। ঠিক তাই-ই হলো। শব্দের তীব্রতা বেড়ে গেল।
মিলান নিশ্চয়ই পাল্টা কিছু করবে। ওদের দলে বিশ্বজয়ী সব খেলোয়াড়—কাকা, মালদিনির মতো তারকারা। কিন্তু তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর আগেই আমাদের ওদের চেপে ধরতে হতো।
দুই মিনিট পর ডিডি বল পেল এবং সেটা পাস দিল প্রায় ২৫ গজ দূরে থাকা ভ্লাডিকে (ভ্লাদিমির শ্মিৎসার)। মিলান ওকে বিপদ মনে করছিল না বলেই মনে হলো—তাই হয়তো ওকে আটকাতে সিডর্ফ ঠিকভাবে পা–ও বাড়াল না। ভ্লাডি যখন শটটা নিল, আমি ভাবলাম, দিদা তো সহজেই ঠেকাতে পারবে। খুব একটা কঠিন শট ছিল না। কিন্তু দিদা ঝাঁপ দিয়েও পারল না, বলটা গড়িয়ে জালে ঢুকে গেল।
ভ্লাডিকে অভিনন্দন জানিয়ে আমি দলকে চিৎকার করে বললাম, ‘চলো, এবার তৃতীয়টা দেওয়া যাক!’ সেই মুহূর্ত থেকেই আমি নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলাম—লিভারপুল এই ইউরোপিয়ান কাপ ফাইনাল হারবে না। কোনোভাবেই না। মিলান শেষ। ওদের মাথা নুয়ে গেছে। কেউ কিছু বলছে না। কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। মিলান এখন শুধু হাঁটছে—মৃত মানুষের মতো। চলো, ওদের কবর দেওয়া যাক।
কাররা (জেমি ক্যারাঘার), দুর্ভেদ্য কাররা, আমার বন্ধু আর লিভারপুলের মহান সৈনিক, তিন মিনিট পর আবার এক আক্রমণে নেতৃত্ব দিল। বলটা পৌঁছে দিল বারোসের কাছে, বক্সের কাছাকাছি। আমি পেছন থেকে দৌড়ে যাচ্ছিলাম। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করছিলাম—বারোস যেন আমাকে দেখে। যদি দেখে, তাহলে আমি সরাসরি গোলের সামনে থাকব। আমি চিৎকার করলাম। বারোস শুনল আমাকে, আমার প্রার্থনা শুনল এবং একেবারে নিখুঁত স্পর্শে বলটা পাঠাল আমার কাছে।
লিভারপুলে থাকার সময় বারোসকে অনেকেই স্বার্থপর বলত, বলত ও শুধু নিজের জন্য খেলে, মাথা নিচু করে রাখে। কিন্তু সেদিন, ইস্তাম্বুলের রাতে, ও দেখিয়েছিল অবিশ্বাস্য দূরদর্শিতা। যেভাবে আমি দৌড়েছিলাম, সেটা এত বিশেষ ছিল যে বারোস সেটা না দেখে পারত না। ওর পাসটা এল, আমি শট নেওয়ার জন্য আমার বাঁ পা পেছনে টানলাম, আর ঠিক তখনই—ধাঁই করে, গাত্তুসো আমার পেছনের পায়ে ধাক্কা দিল।
আমি পড়ে গেলাম। যদি দাঁড়িয়ে থাকতে পারতাম, তাহলে হোঁচট খেয়েও এগিয়ে যেতাম। কারণ, আমি জানতাম—আমি গোল করতাম। ওটা তখন শুধু আমার আর দিদার লড়াই হতো আর সেখানে একজনই বিজয়ী হতো।
আমি মরিয়া ছিলাম ফাইনালে আরও একটা গোল করার জন্য। কিন্তু গাত্তুসো আমার পায়ে মেরে দিল। ‘পেনাল্টি!’ সবাই চিৎকার করল। আমি মাথা তুলে দেখলাম রেফারি মেজুতো গঞ্জালেসকে ঘিরে রেখেছে মিলানের অনেক খেলোয়াড়। দাবি করছে, আমি অভিনয় করেছি—যা একেবারে বাজে কথা। আর কাররা রেফারিকে বলছে, এটা লাল কার্ডের অপরাধ।
আমার তখন মাথায় এল, আচ্ছা, রাফা যেন কাকে পেনাল্টি নিতে বলেছিল? আমি না, এটা জানতাম। রাফা বেনিতেজ প্রতিটি ম্যাচে একজন নির্দিষ্ট পেনাল্টি-শুটার ঠিক করে দেয়। যদি সে মিস করে, রাফাই দায় নেয়। সেই ম্যাচে নির্ধারিত পেনাল্টি-টেকার ছিল জাবি (আলোনসো)। নিঃসন্দেহে শান্ত একজন। জাবি কাররার কাছ থেকে বল নিয়ে তা পেনাল্টি স্পটে রাখল।
আমি মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম, ‘বলটা যেন জালে জড়ায়!’ জাবি নিচু করে জোরে শট নিল। আমি লাফাতে শুরু করলাম উদ্যাপন করতে গিয়ে। ধুর! দিদা বাঁচিয়ে দিল! ব্যস, আমরা তো শেষ! কিন্তু না, বলটা তখনো মাঠে। জাবি সবার আগে প্রতিক্রিয়া দেখাল। বলটা ফলো করল আর বাঁ পায়ে গুঁতা মেরে জালে পাঠাল। গো-ও-ও-ল!
আমি জাবির জন্য স্বস্তি অনুভব করেছিলাম। যদি লিভারপুল ৩-২ গোলে হেরে দেশে ফিরত, তাহলে জাবির জীবনের জন্য সেটা এক বিশাল ট্র্যাজেডি হয়ে থাকত।
লিভারপুল সমর্থকেরা তখন কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাত, কে জানে? জাবি চরিত্রে খুবই শক্ত, সে হয়তো সামলে নিত; কিন্তু আমি খুশি যে একজন ভালো মানুষ আর দুর্দান্ত খেলোয়াড়কে তেমন কিছুর ভেতর দিয়ে যেতে হয়নি। কে চায়, চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে মিস করা একটি পেনাল্টি তার জীবনবৃত্তান্তে থাকুক!
যখন আমরা জাবির পেছনে ছুটছিলাম, স্বস্তি, আনন্দ—সব ধরনের আবেগ যেন একসঙ্গে উপচে পড়ছিল। কী অবিশ্বাস্য প্রত্যাবর্তন! ছয় মিনিট—যা কাঁপিয়ে দিল পুরো দুনিয়াকে। ছয় মিনিট—যা ভেঙে দিল মিলানের হৃদয়। ছয় মিনিট—যা মুছে দিল ওদের সব বিদ্রূপ। আমাদের প্রত্যাবর্তনের এই আকস্মিক ধাক্কা শেষ করে দিয়েছিল ইতালিয়ানদের। যদি গোলগুলো কিছুটা বিরতিতে হতো, তাহলে হয়তো মিলান আবার গুছিয়ে নিতে পারত, নিজেদের সংগঠিত করতে পারত, ধীরে ধীরে ফিরে আসার চেষ্টা করতে পারত। কিন্তু মুহুর্মুহু তিনটি গোল ওদের ধ্বংস করে দিল।
মিলানের খেলোয়াড়েরা যেন গাড়ি দুর্ঘটনার শিকার—এদিক–ওদিক হেলে পড়ছে, দিশাহীন। কার্লো আনচেলোত্তি চেষ্টা করল ওর দলকে আবার জীবিত করে তুলতে।
মেজুতো গনসালেস যখন নির্ধারিত সময়ের শেষ বাঁশি বাজাল, আমার শরীরটা একেবারে ভেঙে পড়েছিল। কাফ মাসলে ভয়ংকর ক্র্যাম্প। লিভারপুলের একজন ম্যাসাজ থেরাপিস্ট আমার পায়ে কাজ শুরু করল।
সামনে অপেক্ষমাণ অতিরিক্ত ৩০ মিনিট আমার জন্য ছিল আজীবন কারাদণ্ডের মতো। একমুহূর্তের জন্য সন্দেহ আমাকে ঘিরে ধরেছিল। আমি চুপচাপ পিঠের ওপর ভর দিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। তারপর ভাবলাম, সবকিছু উজাড় করে দাও। আবার। আরেকবার। বারবার।
অতিরিক্ত সময় শুরু হলো আর মিলানের হয়ে বদলি নামা সার্জিনিয়ো আবার আসছে আমার দিকে—যেন হিংস্র আগ্রাসী উদ্দেশ্যে আর আগুনের গতিতে। ও কিসে চড়েছে? কোনো মোটরবাইকে নাকি? আমি খেলছিলাম যেন স্মৃতির ওপর ভর করে। একদম ক্লান্ত, শক্তিহীন, মাথা কাজ করা বন্ধ—শুধু শরীর কোনোভাবে নিজের স্বাভাবিক প্রবৃত্তি অনুসরণ করে যাচ্ছিল এবং চ্যালেঞ্জ সামলে যাচ্ছিল।
লিভারপুলের সবাই নিজেদের উজাড় করে দিয়ে খেলছিল। মিলান যেন গোল করতে না পারে—এটাই ছিল অঙ্গীকার। আমাদের তথাকথিত হালকা ওজনের খেলোয়াড়েরা—গার্সিয়া আর ভ্লাদির মতো খেলোয়াড়েরা—সেদিন সিংহের মতো লড়েছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থায়। সবাই লড়ছিল, বন্ধুত্বের বন্ধন আমাদের এক করে রেখেছিল।
কাররা সে সময় মাঠে সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছিল। বল আটকানোর জন্য নিজের শরীরকে সে যেন আগুনের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। এমনকি ক্র্যাম্পে জর্জরিত হয়েও ব্লক করে যাচ্ছিল। জয়ের যে অদম্য আকাঙ্ক্ষা, তা যেন কাররার প্রতিটি রক্তকণায় মিশে গিয়েছিল।
আমি তাকে দেখলাম পোস্টে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে, ক্র্যাম্প কমাতে পায়ের পেছনের অংশ টানছে। পরে কাররা বলেছিল, ‘ক্র্যাম্প নিয়ে খেলা মানে ভাঙা পা নিয়ে খেলার চেয়েও খারাপ।’ আসলে আমরা সবাই শূন্য অবস্থায় দৌড়াচ্ছিলাম। শুধু অন্তরের সাহস আর হার না মানা মানসিকতার ওপর ভর করে। আমার ইচ্ছা করছিল কোনো একটা পোস্টের কাছে গিয়ে দাঁড়ানোর, যেন পায়ের ব্যথাটা একটু কমানো যায়। সার্জিনিয়ো নামের এক ব্রাজিলীয় ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করছিলাম।
ভেতরে ভেতরে ভেঙে পড়েছিলাম, তবু দলের বিশ্বাস দৃঢ় রাখতে আমাকে শক্ত মনের পরিচয় দিতে হয়েছিল। শক্ত থাকতে হচ্ছিল। অধিনায়কের ভূমিকা পালন করতে হচ্ছিল। আমি সবাইকে বারবার উজ্জীবিত করছিলাম। সব অস্থিরতার মধ্যেও আমি মিলানের প্রতি, বিশেষ করে শেভচেঙ্কোর প্রতি, আমার শ্রদ্ধা জানাতে চেয়েছিলাম—যে স্ট্রাইকারদের রাজা আর মানুষ হিসেবেও এক সত্যিকারের রাজপুত্র। যখন আমি তাকে ট্যাকল করলাম, আমিই তাকে হাত ধরে তুললাম। অতিরিক্ত সময়ের প্রথমার্ধ শেষ হলে যখন আমরা প্রান্ত বদল করছিলাম, আমি ওর পাশে গিয়ে বললাম, ‘শুভকামনা।’ আমি শেভচেঙ্কোর বন্ধু নই, কিন্তু সেই সুনামি তহবিল সংগ্রহ করার ম্যাচে ও আমার অধিনায়ক ছিল, তখন আমাদের মধ্যে কিছু কথা হয়েছিল। শেভচেঙ্কো দারুণ।
শেভচেঙ্কো দুনিয়ার সেরা ফরোয়ার্ডদের একজন। আর যখন বলটা ম্যাচের শেষ দুই মিনিট বাকি থাকতে ওর পায়ে এল, মাত্র দুই গজ দূরত্বে, আমি ভাবলাম—‘শেষ। এবার সত্যি শেষ।’ শেভচেঙ্কো তো মিস করবেই না। কিন্তু যা ঘটল, আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। সেই অভাবনীয় রাতে আতাতুর্ক স্টেডিয়ামে উপস্থিত কেউই বুঝতে পারল না আসলে কী ঘটেছিল। শেভচেঙ্কো ভেবেছিল হেডে সে গোল করে ফেলেছে। কিন্তু জার্জি ঠেকিয়ে দিয়েছিল। শেভচেঙ্কো আবার মনে করল ফিরতি বলটা এবার ঢুকেই যাবে। কিন্তু জার্জি আবার বাঁচাল।
সেই মুহূর্তগুলোতে যেন কোনো অশরীরী শক্তি লিভারপুলকে রক্ষা করছিল। আমি সত্যিই এটা বিশ্বাস করি। যখন জার্জি সেই অবিশ্বাস্য ডাবল সেভটা করল, আমি অনুভব করলাম—ওপরের কেউ একজন আমাদের পাশে আছেন। আমার মনে হচ্ছিল ওপরে কেউ আমাদের পাশে ছিল। মিলান অনুভব করেছিল যে ঈশ্বর ও ভাগ্য তাদের ছেড়ে চলে গেছে। মানসিকভাবে ইতালীয়রা পুরো ভেঙে পড়েছিল আর পেনাল্টি শুট-আউটে যাওয়ার জন্য সেটাই ছিল সবচেয়ে খারাপ মানসিক অবস্থা।
পাঠকের জন্য তথ্য
৩-৩ সমতার পর অতিরিক্ত সময়ে আর গোল হয়নি। ম্যাচ গড়ায় টাইব্রেকারে। সেখানে মিলানের হয়ে গোল মিস করেছেন সার্জিনিয়ো, পিরলো ও শেভচেঙ্কো। গোল করেন টমাসন ও কাকা। অন্যদিকে লিভারপুলের রিস গোল মিস করলেও গোল করেন হামান, সিসে ও ভ্লাদিমির। ৩-২ গোলে জিতে ২০০৪-০৫ মৌসুমের চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফি পায় লিভারপুল।সেই হারের প্রতিশোধ অবশ্য দুই বছর পরেই নিয়েছিল মিলান। ২০০৬–০৭ মৌসুমে লিভারপুলকে ২–১ গোলে হারিয়ে সপ্তমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগে জেতে মিলান। সেটিই চ্যাম্পিয়নস লিগে মিলানের সর্বশেষ ট্রফি। ‘মিরাকল অব ইস্তাম্বুলের’ পর লিভারপুলকে চ্যাম্পিয়নস ট্রফির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৪ বছর। ইয়ুর্গেন ক্লপের অধীন ২০১৮–১৯ মৌসুমে টটেনহামকে ২–০ গোলে হারিয়ে ষষ্ঠ চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতে লিভারপুল।