অপ্রতিরোধ্য স্লটকে থামিয়ে আজ ‘চে গুয়েভারা’ হওয়ার সুযোগ গার্দিওলার
২০১৮ সালে বিবিসির বিখ্যাত ফুটবল সাংবাদিক গিয়েম বালাগ একটি বিশেষ প্রতিবেদন লিখেছিলেন পেপ গার্দিওলাকে নিয়ে। সেই প্রতিবেদনে গার্দিওলার সঙ্গে আর্জেন্টিনার কিংবদন্তি বিপ্লবী চে গুয়েভারার তুলনা নিয়ে বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছিলেন বালাগ। দীর্ঘ সেই প্রতিবেদনে গার্দিওলার জীবনের নানা দিকও তুলে এনেছিলেন এই সাংবাদিক। যদিও গার্দিওলাকে চে গুয়েভারার সঙ্গে তুলনা মূলত বালাগ করেননি, করেছিলেন আর্জেন্টিনার বিশ্বকাপজয়ী কোচ সিজার লুইস মেনত্তি। লড়াকু মানসিকতা ও ফুটবলকে বদলে দেওয়ার জন্যই গার্দিওলাকে এ নাম দিয়েছিলেন মেনত্তি। আর বালাগ সেই কথাটারই ব্যাখা দিয়েছিলেন।
সেই প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর মাঝখানে পেরিয়ে গেছে ছয় বছরের বেশি। বিপ্লবী গার্দিওলাকে মাঠের বাইরে খুব বেশি পাওয়া না গেলেও, মাঠের ভেতর গার্দিওলার বিপ্লব আরও দীর্ঘায়িত হয়েছিল। প্রিমিয়ার লিগের রেকর্ড বইও তিনি তছনছ করে দিয়েছেন।
গত মৌসুম পর্যন্ত অব্যাহত ছিল ফুটবল মাঠে গার্দিওলার বিপ্লবী কার্যক্রম। যা চলতি মৌসুমে এসে ধাক্কা খেয়েছে ব্যাপকভাবে। চোট ও টানা সাফল্যের ক্লান্তি যেন নাক পর্যন্ত ডুবিয়ে দিয়েছে গার্দিওলাকে। ফলে সন্দেহাতীতভাবেই গার্দিওলা এখন নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে খারাপ সময়টা পার করছেন। পাশাপাশি পেশাদার ক্যারিয়ারে প্রথমবারের মতো আক্ষরিক অর্থেই অলৌকিক কোনো পাথরবাটির খোঁজে আছেন স্প্যানিশ এই কোচ।
গার্দিওলা যখন বিপ্লবের সন্ধানে মরিয়া, তখন অন্য রকম এক বিপ্লব নিয়ে প্রিমিয়ার লিগকে চমকে দিয়েছেন আর্নে স্লট। মৌসুম শুরুর আগে যাকে কেউ আলোচনাতেও রাখেননি, সেই মানুষই এখন লিভারপুলকে স্বপ্ন দেখাচ্ছেন শিরোপা জয়ে। স্লট লিভারপুলে এসেছেন ইয়ুর্গেন ক্লপের জায়গায়। শুধু এ তথ্যটুকুই বলে দিচ্ছে স্লটের ওপর কী সীমাহীন চাপ ছিল! লিভারপুলকে একাই বদলে দিয়েছিলেন ক্লপ। তাঁর হাত ধরেই একে একে হারানো সব রাজত্ব উদ্ধার করে ‘অল রেড’রা।
শুধু ফলে নয়, খেলার ধরনেও লিভারপুলকে অন্য এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন এই জার্মান কিংবদন্তি। তবে গত মৌসুমের মাঝপথে তাঁর আকস্মিক বিদায়ের ঘোষণা লিভারপুল–সমর্থকদের হতাশায় ডুবিয়ে দিয়েছিল। অখ্যাত স্লটের আগমনের ঘোষণাও দল ও সমর্থকদের মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব তৈরি করতে পারেনি। ক্লপকে রাজসিক বিদায় জানাতে লিভারপুল তখন এতটাই ব্যস্ত ছিল যে স্লটকে নিয়ে আলাদা করে ভাবার সময়ই হয়নি। সম্ভবত লিভারপুলে সবচেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিটিও ছিলেন স্লট।
কারণ, ক্লপ নিজে ছাড়া আর কেউ চাননি তিনি ক্লাব ছেড়ে যান। কে জানে, আসার আগেই লিভারপুল থেকে পাওয়া এই শীতল অভ্যর্থনা স্লটকে তাতিয়ে দিয়েছিল কি না।
স্লট নিজেও অবশ্য জানতেন যে এটা তাঁর জন্য অগ্নিপরীক্ষার মতো। এক-দুই ম্যাচের ব্যর্থতাতেই ‘ক্লপ ফেরাও’ স্লোগানে কেঁপে উঠতে পারে অ্যানফিল্ডের গ্যালারি।
ফলে প্রথম ম্যাচ থেকেই জয় এনে দেওয়ার আর কোনো বিকল্প ছিল না স্লটের কাছে। যদিও সে লক্ষ্যে নিজের পছন্দের কোনো খেলোয়াড় কেনার সুযোগও দেওয়া হয়নি তাঁকে। এ যেন ছিল আগুন ছড়িয়ে রাখা পথে হাঁটার মতো ব্যাপার। সেই পথে হেঁটে স্লট গন্তব্যে যেতে পারবেন কি না, তা এখনই বলার সুযোগ নেই। কিন্তু শুরুটা যে অসাধারণভাবে হয়েছে, তা স্বীকার করতেই হবে।
এখন সেই স্লটের হাত ধরেই লিভারপুল স্বপ্ন দেখছে একাধিক শিরোপা জয়ের। এরই মধ্যে প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষে থাকার পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগেও সবার ওপরে অবস্থান করছে লিভারপুল। শুধু ম্যাচই জিতছে না; বরং প্রতিপক্ষের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে দাপটের সঙ্গে।
ওপরের কথাগুলো থেকেই বোঝা যাচ্ছে, মৌসুমের প্রথমভাগে দুই বিপরীত দাঁড়িয়ে আছেন গার্দিওলা ও স্লট। তবে আজ রাতে এক বিন্দুতে মিলবেন তাঁরা। অ্যানফিল্ডে রাত ১০টায় মৌসুমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক লিগ ম্যাচে মুখোমুখি হবে তাঁদের দল সিটি-লিভারপুর। প্রিমিয়ার লিগে ১২ ম্যাচ শেষে লিভারপুলের চেয়ে ৮ পয়েন্টে পিছিয়ে আছে সিটি।
মৌসুমের এ পর্যায়ে পয়েন্টের এত বড় পার্থক্য অবিশ্বাস্যই বটে। লিভারপুলের অবশ্য সিটির মুখোমুখি হওয়ার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর হতেই পারত না। এই ম্যাচে জিতলে ১৩ ম্যাচ শেষে সিটির চেয়ে ১১ পয়েন্টে এগিয়ে যাবে লিভারপুল। এরপর নিজেদের পায়ে নিজেরা কুড়াল না মারলে লিভারপুলের কাছ থেকে শিরোপা কেড়ে নিতে রীতিমতো অসম্ভব কিছু করে দেখাতে হবে অন্য দলগুলোকে।
সিটির বিপক্ষে এই ম্যাচে জিতলে ১৩ ম্যাচ শেষে সিটির চেয়ে ১১ পয়েন্টে এগিয়ে যাবে লিভারপুল।
যে ম্যাচটা স্লটের জন্য শিরোপা দৌড়ে এগিয়ে যাওয়া, সেটাই গার্দিওলাকে দিতে পারে নতুন এক লাইফলাইন। সে জন্য অবশ্য লিভারপুলের বিপক্ষে জয়ের কোনো বিকল্প নেই। যদিও শেষ ৬ ম্যাচের ৫টিতে হার এবং ১টিতে ড্রতে করা সিটির জন্য কাজটা মোটেই সহজ হবে না। এমনকি প্রিমিয়ার লিগে শেষ তিন ম্যাচের তিনটিতেও হেরেছে সিটি।
পাশাপাশি আরেকটি দুঃসংবাদ হচ্ছে সিটিকে এই ম্যাচ খেলতে হবে লিভারপুলের মাঠ অ্যানফিল্ডে। এই মাঠ এমনিতেই প্রতিপক্ষের আতঙ্কের জন্য নাম। এই মাঠ থেকে ম্যাচ জিতে ফিরতে হলে যেকোনো দলকেই সামর্থ্যের বেশি কিছুই করে দেখাতে হয়। সব মিলিয়ে সিটির জন্য কাজটা তাই হিমালয়ের চূড়ায় ওঠার মতোই কঠিন এক কাজ। যেখানে নিজেদের দুরবস্থার পাশাপাশি চোখ রাঙাচ্ছে প্রতিপক্ষে দুর্দান্ত ছন্দও।
সাম্প্রতিক সময়ে পরিসংখ্যান, সামর্থ্য ও ছন্দ পক্ষে না থাকলেও সিটিকে হালকাভাবে নেওয়ার সুযোগ নেই। গার্দিওলা বলেছেন, তাঁর আবার নতুন করে নিজেকে প্রমাণ দিতে হবে। আর এ প্রমাণের কাজটা তিনি যদি লিভারপুল ম্যাচ থেকে শুরু করেন, তবে সেটি সিটি সমর্থকদের জন্য দারুণ এক সুসংবাদই হবে। অন্যদিকে স্লটের জন্যও পরীক্ষাটা সহজ নয়। সাফল্যের ধারাবাহিকতা ধরে রেখে চ্যাম্পিয়নদের বিপক্ষে দলকে জয় এনে দেওয়ার বিষয়টি তো আছেই। পাশাপাশি নিজের ‘আদর্শ’ গার্দিওলার বিপক্ষে নিজের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর সুযোগটাও নিশ্চয় হাতছাড়া করতে চাইবেন না তিনি।