৪০ লাখ পাউন্ডের কাইসেদোর দাম যেভাবে ১১ কোটি পাউন্ড

প্রিমিয়ার লিগ রেকর্ড ট্রান্সফার ফিতে চেলসিতে যোগ দিয়েছেন মইসেস কাইসেদোছবি: চেলসি

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ৪০ মিলিয়ন পাউন্ডে ইকুয়েডরিয়ান ক্লাব ইন্দেপেনদিয়েন্তে দেল ভালে (আইদিভি) থেকে ব্রাইটনে আসেন মোইসেস কাইসেদো। আড়াই বছর পর সেই কাইসেদোকে ব্রাইটন চেলসির কাছে বিক্রি করেছে ১১ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ডে। আড়াই বছরের পুরোটাও তিনি ব্রাইটনে খেলেননি। কেনার পর তাঁকে ধারে বেলজিয়ান ক্লাব বিয়ারশটে পাঠিয়ে দেয় ক্লাবটি। ক্লাবে সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের সংকটের কারণে গত বছরের জানুয়ারিতে তাঁকে লোন থেকে ফেরায় ব্রাইটন।

ধার থেকে ফেরার মাত্র দেড় বছরের মধ্যে সেই কাইসেদোকে এখন ব্রাইটন বিক্রি করল বিশ্বের তৃতীয় সর্বোচ্চ দামি খেলোয়াড় হিসেবে। নেইমার ও এমবাপ্পের পরই এখন ২১ বছর বয়সী কাইসেদোর অবস্থান। প্রশ্ন হচ্ছে, এক বছর আগেও ফুটবল–দুনিয়ায় স্বল্প পরিচিত কাইসেদো কীভাবে নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেলেন। আর কেনই–বা চেলসি তাঁর জন্য এত টাকা খরচ করল। শুধু চেলসিই নয়, লিভারপুলও রেকর্ড ১১ কোটি পাউন্ডে তাঁকে কেনার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু কাইসেদো চেলসি ছাড়া অন্য কোনো ক্লাবে যেতে রাজি না হওয়ার কারণে শেষ পর্যন্ত তাঁকে স্টামফোর্ডের ব্রিজের ক্লাবটির কাছেই বিক্রি করেছে ব্রাইটন।

আরও পড়ুন

বিশ্বব্যাপী বিভিন্ন দেশ থেকে কম দামে খেলোয়াড় কিনে তাঁদের প্রস্তুত করে বেশি দামে বিক্রি করার কারণে আগেই বিশেষ পরিচিত ছিল ব্রাইটনের। এই প্রবণতা ব্রাইটনের ডিএনএতেই আছে। সে প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই কাইসেদোর ব্রাইটন থেকে চেলসিতে যাওয়া। কিন্তু কাইসেদো যে নগদ লাভ ব্রাইটনকে দিয়ে যাচ্ছেন, তা অবিশ্বাস্য। সম্ভবত এ ধরনের প্রকল্পের এটিই সবচেয়ে বড় সফলতা। কিন্তু কাইসেদোর জন্য এই পথটা পাড়ি দেওয়া মোটেই সহজ ছিল না।

মা-বাবার দশ সন্তানের মধ্যে সবচেয়ে ছোট কাইসেদোর জন্ম ইকুয়েডরের শহর সান্তো ডমিঙ্গোর দরিদ্র পরিবারে। রাজধানী কুইটো থেকে ১০০ মাইল পশ্চিমের এই শহরে তাঁর বাবা ছিলেন একটি রিকশার মালিক। কিন্তু বাবার আয়ে সংসার ঠিকঠাকভাবে চলত না। যে কারণে তাঁর মাকে অন্যের ঘরে কাজ করে বাড়তি টাকা আয় করতে হতো।

মায়ের সঙ্গে কাইসেদো
ছবি: চেলসি

শৈশবে কাইসেদোকে সবাই ডাকতেন ‘এল নিনো মোই’ নামে। ফুটবল পায়ে নিয়ে তাঁর শুরুটা হয় স্থানীয় কোচ ইভান গুয়েরার হাত ধরে। পরিবারের পক্ষে খরচ দেওয়া সম্ভব না হওয়ায় কাইসেদোর বাসভাড়া ও খাবারের টাকাটা তাঁর কোচই দিতেন। এভাবেই ১৩ বছর বয়সে আইদিভির একাডেমিতে তাঁর অনুশীলন পর্ব শুরু হয়। বয়সভিত্তিক দল পেরিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে মূল দলে অভিষেক হয় কাইসেদোর। আর ১৭ পেরোনের আগেই ইউরোপিয়ান পরাশক্তিদের আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসেন এই মিডফিল্ডার।

কাইসেদোকে কেনার জন্য চেষ্টা করেছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, নিউক্যাসল ইউনাইটেড, ওয়েস্ট হাম, এভারটন, এসি মিলান, আরবি লাইপজিগ ও ক্লাব ব্রুগা। কিন্তু আইদিভির সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক থাকায় অগ্রাধিকার পেয়েছে ব্রাইটনই। এর আগে ২০১৮ সালের আগস্টে স্ট্রাইকার বিলি আর্ককে কিনেছিল তারা। তাই বাকিদের পেছনে ফেলে ৪০ লাখ পাউন্ডে কাইসেদোকে পেয়েছিল তারাই।

আরও পড়ুন

কেনার পর অবশ্য কাইসেদোকে খুব বেশি সময় দলে রাখেনি ব্রাইটন। আগস্টে কারাবাও কাপের একটি ম্যাচ খেলিয়েই তাঁকে ধারে বিয়ারশটে পাঠায় তারা। মূলত কাইসেদোকে যেন বেঞ্চে কাটাতে না হয়, সে জন্যই তাঁকে ধারে পাঠানো হয়েছিল। ধারে খেলতে যাওয়ার অভিজ্ঞতা নিয়ে কাইসেদো বলেছিলেন, ‘আমি সেখানে নিয়মিত খেলেছিলাম এবং সেটাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সেটা আমাকে ম্যাচ ফিটনেস ধরে রাখতে সাহায্য করেছে এবং জাতীয় দলেও আমি জায়গা ধরে রাখতে সক্ষম হই।’

সেখান থেকে জানুয়ারিতে ফিরে আসার পর ফেব্রুয়ারিতে টটেনহামের বিপক্ষে এফএ কাপে প্রথম ম্যাচ খেলেন কাইসেদো। আর প্রিমিয়ার লিগে তাঁর অভিষেক হয় আর্সেনালের বিপক্ষে তাদের মাঠে। ৯ এপ্রিলের এই ম্যাচে ২-১ গোলে জয়ের পথে একটি অ্যাসিস্টও করেন এই তরুণ। আর কাইসেদো নিজের গোলের খাতা খোলেন ৭ মে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে। সেদিন ৪-০ গোলের স্মরণীয় জয়ে প্রথম গোলটি আসে কাইসেদোর কাছ থেকেই। এরপর তাঁকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। ব্রাইটনের হয়ে সব মিলিয়ে খেলেছেন ৫৩টি ম্যাচ। ২ গোলের পাশাপাশি ৩টি অ্যাসিস্টও আছে তাঁর। তবে এই পরিসংখ্যানে ডিফেন্সিভ মিডে খেলা কাইসেদোর গুরুত্ব বোঝা যাবে না।

তাঁকে নিয়ে আইদিভির কোচ মিগুয়েল অ্যাঞ্জেল রামিরেজ বলেছেন, ফুটবল নিয়ে তাঁর বোঝাপড়া দারুণ। বলে প্রথম স্পর্শ ও নিয়ন্ত্রণও চমৎকার। ম্যাচকে সে দারুণভাবে এগিয়ে নিতে পারে। ডিপ লায়িং মিডফিল্ডার হিসেবে কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাঁকে তুলনা করা যায় তাঁর আদর্শ এনগালো কান্তের সঙ্গে। মিডফিল্ডার হলেও মাঠে বৈচিত্র্যময় ভূমিকা পালন করতে পারেন কাইসেদো। ১৮ বছর বয়সে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়া এই মিডফিল্ডারকে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কোচ দায়িত্ব দিয়েছিল লিওনেল মেসিকে মার্ক করার। সেদিন আর্জেন্টিনার ১-০ গোলের জয়ে মেসি গোল করেছিলেন বটে, তবে সেটি পেনাল্টি থেকে। অর্থাৎ কাইসেদো তাঁর কাজটা ঠিকঠাকই করেছিলেন।

আরও পড়ুন

ব্রাইটনে নতুন দিন ফিরিয়ে আনা কোচ গ্রাহাম পটারই মূলত কাইসেদোর ভেতর থেকে তাঁর সেরাটা বের করে এনেছিলেন। তাঁকে ফিরিয়ে আনা নিয়ে পটার বলেছিলেন, ‘তরুণ খেলোয়াড় হিসেবে মইজেসের দারুণ সম্ভাবনা আছে। এতে কোনো সন্দেহ নেই যে সে আমাদের সেরা খেলোয়াড় হবে।’ ব্রাইটনে পটারের সেই কথার সত্যতা প্রমাণে খুব বেশি সময় লাগেনি কাইসেদোর। পটার তাঁকে অ্যালেক্সিস ম্যাক আলিস্টারের সঙ্গে ডাবল পিভট (ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার) হিসেবে বাঁ পাশে ব্যবহার করে দারুণ সাফল্য পান। এমনকি পটারের পরিবর্তে আসা রবার্তো দি জেরবির অধীনেও দারুণ নৈপুণ্য প্রদর্শন করেন কাইসেদো।

বল পায়ে গতিময়তা, দুর্দান্ত পাসিং ও দারুণ প্রাণশক্তি কাইসেদোকে তাঁর সমসাময়িক অন্যদের চেয়ে আলাদা করে চিনিয়েছে। এ ছাড়া ট্যাকেলিংয়ের দক্ষতা ও প্রতিপক্ষের খেলা নষ্ট করার ক্ষেত্রেও বিশেষ দক্ষতা আছে কাইসেদোর। তাঁর ডাচ সতীর্থ জোয়েল ভেল্টম্যান বলেছেন, ‘যেটা আমি পছন্দ করি তা হলো সে জানে বল কোথায় আসবে। একজন মিডফিল্ডারের এটা সত্যিই দারুণ।’

কাইসেদো এখন চেলসির
ছবি: চেলসি

এর মধ্যে গত জানুয়ারিতেও তাঁকে নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিল চেলসি-আর্সেনালের মতো ক্লাব। সে সময় ব্রাইটন চেলসির ৫ কোটি ৫০ লাখ পাউন্ড এবং আর্সেনালের ৭ কোটি পাউন্ডের (প্রথমে ৬ কোটি পাউন্ডের প্রস্তাব দিয়েছিল আর্সেনাল) প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। সে সময় ব্রাইটন ছাড়তে না পেরে সরাসরি অসন্তুোষও প্রকাশ করেছিলেন কাইসেদো। কিন্তু ক্লাব ছাড়ার সুযোগ না হলেও নিজের ছন্দ ঠিকই ধরে রাখেন এই মিডফিল্ডার।

এর মধ্যে মার্চে অবশ্য ২০২৭ সাল পর্যন্ত চুক্তিও নবায়ন করেন কাইসেদো। কিন্তু গ্রীষ্মের দলবদলের শুরু থেকেই তাঁকে নেওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে মাঠে নামে চেলসি। শেষ দিকে লিভারপুলও ১১ কোটি পাউন্ডের প্রস্তাব নিয়ে লড়াইয়ে নামলে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়। কিন্তু কাইসেদো সাফ জানিয়ে দেন, তিনি চেলসিতেই যাবেন। কারণ, তাদের কথা দিয়েছেন। কাইসেদোর এমন দৃঢ় অবস্থানের মূল্য দিয়েছে চেলসিও। ইতিহাসের তৃতীয় সেরা দামি খেলোয়াড় হিসেবে তাঁকে কিনে নিয়েছে তারা।

আরও পড়ুন

তাঁর সম্পর্কে ব্রাইটনের বর্তমান কোচ জেরবি বলেছেন, ‘আপনার কাছে মইজেসের (কাইসেদো) মতো খেলোয়াড় থাকলে আপনি তাকে সব সময় বিক্রি করতে পারবেন। আমি চেয়েছিলাম সে আমাদের সঙ্গে থাকুক। আমি ক্লাবের রাজনীতি সম্পর্কে জানি এবং তরুণ খেলোয়াড়েরা কী চায়, তা–ও জানি। সে চ্যাম্পিয়নস লিগ, ইউরোপা লিগে খেলতে চায়। শিরোপার জন্য লড়তে চায়।’ আর কাইসেদোর মান নিয়ে জেরবির মত, ‘কাইসেদো সব জায়গায় খেলতে পারে। সে একজন শীর্ষ পর্যায়ের খেলোয়াড়।’

তবে বাস্তবতা হচ্ছে এত দিন আন্ডারডগ হিসেবেই সব স্বীকৃতি ও প্রশংসা পেয়েছেন কাইসেদো। এখন দামের কারণে চলে এসেছেন পাদপ্রদীপের আলোয়ও। এর আগেও তুমুল সম্ভাবনা ও উচ্চ দামে ক্লাব বদলে ব্যর্থতায় আড়ালে চলে গেছেন অনেকে। এখন কাইসেদো কোন পথে যাবেন, সে উত্তর সময়ের হাতেই তোলা রইল।