পেলে, কিংবদন্তি শব্দটা যাকে নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা জানায়

কিংবদন্তি ফুটবলার পেলেফাইল ছবি

পেলে মারা গেলেন। অথচ ফুটবল ইতিহাসের সবচেয়ে রোমান্টিক লেখক এদুয়ার্দো গালিয়ানো বলতেন পেলের খেলা দেখে অবিশ্বাসীরাও অমরত্বে বিশ্বাস করতে বাধ্য হতো।

গালিয়ানোর সকার আন্ডার শ্যাডো অ্যান্ড সান থেকে পেলেকে নিয়ে অধ্যায়টাই তুলে ধরা যাক, ‘তাঁকে নিয়ে শত শত গান লেখা হয়েছে। ১৭ বছর বয়সে তিনি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন এবং ফুটবলের রাজা হয়েছিলেন। তাঁর বয়স ২০ হওয়ার আগেই ব্রাজিলের সরকার তাঁকে ‘জাতীয় সম্পদ’ আখ্যা দিয়ে অরপ্তানিযোগ্য ঘোষণা করে। তিনি ব্রাজিল দলের হয়ে তিনটি এবং স্যান্টোস ক্লাবের হয়ে দুটি বিশ্ব শিরোপা জয় করেন। তাঁর হাজার গোল পূর্ণ হওয়ার পরও তিনি গণনা থামাননি। তিনি ৮০টি দেশে ১৩ শ’র বেশি ম্যাচ খেলেন ক্লান্তিহীনভাবে।

তিনি একবার যুদ্ধও থামিয়ে দিয়েছিলে। নাইজেরিয়া ও বায়াফ্রা তাঁর খেলা দেখার জন্য যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করেছিল।

তাঁর খেলা দেখার জন্য যুদ্ধবিরতিসহ আরও অনেক কিছুই করা যুক্তিযুক্ত। পেলে যখন ছুটে চলতেন, তিনি প্রতিপক্ষদের ফাঁক গলে এগিয়ে যেতেন, যেভাবে মাখনের পেট চিরে এগিয়ে চলে গরম ছুরি। যখন তিনি থামতেন, তাঁর পায়ের ইন্দ্রজালে প্রতিপক্ষ মোহাবিষ্ট হয়ে যেত।

তিনি যখন শূন্যে লাফাতেন দেখে মনে হতো অদৃশ্য সিঁড়ি বেয়ে তিনি ওপরে উঠছেন। যখন তিনি ফ্রি–কিক নিতেন মানবদেয়াল তৈরি করা প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়রা গোলপোস্টের দিকে মুখ করে থাকতেন, যাতে গোলটা দেখা থেকে তাঁরা বঞ্চিত না হন।

আরও পড়ুন

তিনি এক অজপাড়াগাঁয়ের দরিদ্র ঘরে জন্মান এবং তিনি ক্ষমতা ও সৌভাগ্যর এমন শিখরে পৌঁছান, যেখানে কালোদের প্রবেশাধিকার ছিল না।

মাঠের বাইরে তিনি একমুহূর্ত সময় অপচয় করতেন না এবং তাঁর পকেট গলে কোনো দিন একটা ফুটোপয়সাও পড়তে দেখা যায়নি। তবে আমরা যাঁরা তাঁর খেলা দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি, তাঁদের ভাগ্যে জুটেছে অপারসৌন্দর্যের অনিঃশেষদান। মুহূর্তগুলো এতটাই চিরভাস্মর যে সেগুলো আমাদের অমরত্বের অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে বাধ্য করায়।’ (ফুটবল ইতিহাসের খণ্ডচিত্র-প্রথমা প্রকাশনী, ২০২২, অনুবাদক-লেখক)

গালিয়ানোর পর আসলে ফুটবল নিয়ে কিছু বলা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু পেলের ব্যাপার তো! সাত সমুদ্র তের নদী দূরে বসেও তিনি যে আত্মার আত্মীয়। অনেক দিন ধরেই খবরটা শুনব এই প্রস্তুতি ছিল। কিন্তু ৮২ বছর বয়সী লোকটা যখন চলে গেলেন সে সময় অঝোর ধারায় হাউমাউ করে কেঁদে দিলাম। শীতের রাতে বাসায় ফেরার পথে মনে হচ্ছিল রাস্তার কুকুরগুলো যেন প্রাচীন নেকড়ে দেবতার দিকে নৈবেদ্য দিয়ে মাথা উঁচু করে ঘাউ-উ-উ করে ডাকছে। বিদায় জানাচ্ছে কোনো বন্ধুকে।

আরও পড়ুন

আধুনিক যুগের প্রাণিবিজ্ঞানীরা দাবি করেন, আমাদের মতো এই পৃথিবীর অন্যান্য সহপ্রাণীরাও বল নিয়ে খেলতে ভালোবাসে। পেলের খেলা দেখে সারমেয়কুল মানুষের মতোই স্তব্ধ হয়ে যেত কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। তবে পেলের অমরত্ব হয়ে উঠার প্রতীক জুলে রিমে ট্রফিটি উদ্ধার করেছিল এক সারমেয়-পিকেলস। ওর বংশধররা শোকে কিংবা নীরবতায় পেলেকে বিদায় দেওয়াটা কল্পনা হলেও অবাস্তব না–ও হতে পারে। আমরা এই দুনিয়ার কতটুকুই জানি।

পেলে নিজেই তো তাঁর বড় প্রমাণ। মানুষ যে তাঁর শরীরের সীমাবদ্ধতাকে ওইভাবে উতরে যেতে পারে, তা পেলের কারিকুরি দেখেই বিশ্বাস করতে হতো। সদ্য সমাপ্ত বিশ্বকাপের মধ্যেও অন্তর্জালে ছড়িয়ে পড়া এক ভিডিওতে দেখা যায় এহেন কোনো কসরত নেই পেলে না করেছেন। বাকিরা তাঁর দেখানো পথেই শুধু হেঁটেছেন। অন্তর্জাল ঘাটলে পেলের গোলসংখ্যা, পদক সংখ্যা আর লাখ লাখ কাব্য পাওয়া যাবে। সেগুলো থাক। আমার আত্মীয় পেলের কথা বলি।

আরও পড়ুন

সেই ক্লাস ফাইভে থাকতে ব্রাজিলের কালোমানিক নামক এক গল্প পড়ে আত্মীয়তার শুরু। কবিতার মতো, ছন্দের মতো পেলের গল্প করতেন আমার ক্রীড়ামোদি মা। শিশুদের জন্য তাঁর ভালোবাসা, খেলার প্রতি তাঁর প্রেমের ব্যাপারগুলো আমার মতো আরও হাজার ছোট মনে আত্মীয়তার বন্ধন করে দিয়েছিল এই অবিশ্বাস্য ব্রাজিলিয়ানের সঙ্গে। বড় হয়ে জানলাম এই আত্মীয়তা গোটা দুনিয়ার সঙ্গেই। বাইবেলের কিং সোলেমনের মতো হয়তো মানুষ ছাপিয়ে সব প্রাণীর সঙ্গেই।

আত্মীয় না হলে কি এই রকম কান্না আসে! মনে হয়, জীবন থেকে কি একটা নেই হয়ে গেল! খুব নিকট মানুষের বিয়োগ ছাড়া কি এই অনুভূতি সম্ভব! ফুটবলারদের এই অবিশ্বাস্য ক্ষমতাটা ঈর্ষণীয়। তাঁরা এই জায়গাটা নিয়ে নেন। আর পেলে তো ফুটবলের রাজাই। এমন এক রাজা, যার রাজত্বে আমরাও সবাই রাজা হওয়ার অনুভূতি পাই। বাংলাদেশের সামাজিক মাধ্যম কেঁদে ভাসিয়ে দেয় গোটা দুনিয়ার সঙ্গে সঙ্গে হিম শীতের গভীর রাতে।

আরও পড়ুন

পেলের যুদ্ধ থামানোর গল্পটা তো গালিয়ানোই বললেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান একবার নাকি পেলেকে পাশে দেখিয়ে বলেছিলেন, আমি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিগ্যান আর আমার পাশে যিনি দাঁড়ানো তাঁকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার কিছু নেই।

রাজা পেলে, কিংবদন্তি পেলে।

তবে সাংবাদিকতার পাঠ্যবইয়ে বলা হয় কিংবদন্তি শব্দটা নাকি যত্রতত্র ব্যবহার করা অনুচিত। আমরা অযাচিতভাবে এই বিশেষণ দিয়ে ফেলি।

পেলে মারা যাওয়ার পর আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর এল, ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে আর নেই।

এক বয়োকনিষ্ঠ সহকর্মী খবরটা দিতে গিয়ে বললেন, ব্রাজিল শব্দটা রাখার মানে নেই। আমি একমত হলাম। এরপর আমাদের মনে হলো, ফুটবলারই বলতে হবে কেন? পেলে নামটাই তো যথেষ্ট। এরপর মনে হলে, এখানে কিংবদন্তি শব্দটাকেই অকিঞ্চিৎকর লাগছে। মনে হচ্ছে এই ভারী শব্দটাও পেলের ওজন বইবার মতো যথেষ্ট নয়।

আরও পড়ুন

মাও সে–তুং যেমন বলতেন, ‘কিছু কিছু মৃত্যু আছে পাখির পালকের মতো হালকা। আবার কিছু কিছু মৃত্যু পর্বতের চেয়েও ভারী।’ পেলে যেন দুনিয়ার সব পর্বতের চেয়ে আমাদের ভারী করে দিয়ে পাখির পালক চেপে উড়ে গেলেন।

আর আমরা নিশ্চিত হলাম, পেলের বিশেষণ দিতে কিংবদন্তি শব্দটা যথেষ্ট নয়। এই পর্বত, এই মহাবিশ্বের আত্মার আত্মীয়কে আসলে কিংবদন্তি শব্দটা নিজেই নতজানু হয়ে শ্রদ্ধা জানায়।