খাসিয়া সম্প্রদায়ের গর্ব তরুণ ফুটবলার স্টারলিং

এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়া কাপ-২০২৩-এর বাছাই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলে আছেন স্টারলিং লাংবাংছবি: সংগৃহীত

দেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী খাসিয়া পরিবারের সন্তান স্টারলিং লাংবাং (১৭)।

মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের দুর্গম এওলাছড়া পুঞ্জিতে (খাসিয়াদের গ্রামকে স্থানীয়ভাবে পুঞ্জি বলা হয়) তাঁদের বাড়ি। শৈশব থেকেই ফুটবলের প্রতি তাঁর প্রচণ্ড ঝোঁক। স্টারলিং এখন বাহরাইনে অনুষ্ঠানরত ‘এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়া কাপ-২০২৩’-এর বাছাই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলে রয়েছেন।

১০ সেপ্টেম্বর থেকে বাহরাইনে এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়ান কাপ-২০২৩–এর বাছাইপর্বের প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। স্বাগতিক বাহরাইন, কাতার, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বাংলাদেশ বি গ্রুপে খেলছে। প্রথম ম্যাচে বাহরাইনের সঙ্গে গোলশূন্য ড্র করেছে বাংলাদেশ। ১২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় ম্যাচে লাল–সবুজের দল ২-১ গোলে হারায় ভুটানকে।

তবে মিডফিল্ডার স্টারলিং দুটির ম্যাচের কোনোটিতে খেলার সুযোগ পাননি। তিনি আশায় আছেন, আজ যদি সুযোগ পান। আজ তৃতীয় ম্যাচে বাংলাদেশ সময় রাত নয়টায় কাতারের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ। শেষ ম্যাচ নেপালের সঙ্গে। সফরে খেলার সুযোগ পান না–পান জাতীয় দলে ডাক পাওয়াও অনেক বড় প্রাপ্তি স্টারলিংয়ের জন্য।

এএফসি অনূর্ধ্ব-২০ এশিয়া কাপ-২০২৩-এর বাছাই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ দলের সঙ্গে স্ট্রেচিংয়ে মগ্ন স্টারলিং লাংবাং
ছবি: সংগৃহীত

স্টারলিংয়ের আগে দেশের আর কোনো খাসিয়া ছেলে ফুটবলে জাতীয় দল কিংবা বয়সভিত্তিকে খেলার সুযোগ পেয়েছেন কি না, মনে করা কঠিন। তবে খাসিয়াদের স্থানীয় আন্তপুঞ্জি উন্নয়ন সংগঠন কুবরাজের সাধারণ সম্পাদক ফ্লোরা বাবলি তালাং জানান, স্টারলিংয়ের আগে এমন সুযোগ কেউ পাননি। কুলাউড়া ফুটবল খেলোয়াড় কল্যাণ সমিতির সভাপতি জাহাঙ্গীর আলমও একই কথা বলেছেন। স্টারলিংয়ের জন্য তাঁরা গর্বিত।

এওলাছড়াপুঞ্জির বাসিন্দা বাবলা নায়াং ও সাবিত্রী লাংবাং দম্পতির তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে স্টারলিং সবার ছোট। শ্রীমঙ্গলের আলিয়াছড়াপুঞ্জিতে খ্রিষ্টান মিশনারি বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শিক্ষা শেষে কুলাউড়ার লক্ষ্মীপুর মিশন বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। এরপর বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে টিকে যাওয়া।

প্রথমে বরিশাল বিকেএসপিতে ভর্তি হয়েছিলেন স্টারলিং। সেখানে ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া হয়েছে। এরপর খুলনা বিকেএসপিতে স্থানান্তর। সেখানে লেখাপড়ার সময় ঢাকায় বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) এলিট একাডেমিতে তাঁকে বাছাই করা হয়। টানা ছয় মাসের প্রশিক্ষণ চলে। এলিট একাডেমির হয়ে বাংলাদেশের পেশাদার ফুটবল লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে খেলার সুযোগ হয়েছে তাঁর।

১৭ বছর বয়সী স্টারলিং লাংবাংকে নিয়ে মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের দুর্গম এওলাছড়ার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী খাসিয়াদের অনেক স্বপ্ন
ছবি: সংগৃহীত

স্টারলিং এবারের মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট (এসএসসি) পরীক্ষার্থী। বৃহস্পতিবার থেকে পরীক্ষা শুরু হয়েছে। কিন্তু বাহরাইনে থাকায় স্টারলিংয়ের পরীক্ষায় অংশ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। খেলার জন্য জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা জলাঞ্জলি দিয়েছেন তিনি। তবে প্রথম কয়েকটি বিষয়ে পরীক্ষা দিতে না পারলেও দেশে ফিরে বাকিগুলো দিতে চান।

স্টারলিংয়ের মেজ ভাই জনি লাংবাং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর শেষ করেছেন। বর্তমানে আইপিডিএস নামের একটি বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করেন। জনি ও স্টারলিংয়ের বড় ভাই এওলাছড়াপুঞ্জিতে মা–বাবার সঙ্গে পান চাষ করেন। দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। বাকি দুই বোন লেখাপড়া করছেন। আজ সকালে মুঠোফোনে যোগাযোগ করলে জনি লাংবাং প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বন-পাহাড়ের মানুষ। পুঞ্জির কাছে খেলার মাঠ আছে। স্টারলিং ছোটবেলায় পুঞ্জির অন্যান্য ছেলের সঙ্গে ফুটবল খেলত। লেখাপড়ার চেয়ে ফুটবলেই তার (স্টারলিং) নেশা বেশি ছিল।’

বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-২০ দলের সঙ্গে অনুশীলনে স্টারলিং লাংবাং
ছবি: সংগৃহীত

ভাইকে নিয়ে জনি আরও বলেন, ‘স্টারলিং ফুটবল ভালোবাসে বলেই এসএসসি পরীক্ষা না দিয়ে বাহরাইনে যাওয়ার সুযোগ নিয়েছে। এখন এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে বাংলাদেশ দল চূড়ান্ত পর্বে উঠতে পারলে এটাই হবে ওর কাছে বড় পাওয়া (আজ বাংলাদেশ কাতারকে হারাতে পারলে চূড়ান্ত পর্বে ওঠার সম্ভাবনা থাকবে)।’

বাহরাইন থেকে ফোনে স্টারলিং আজ প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘জাতীয় দলের সঙ্গে এই প্রথম সফর করেছি। খুবই ভালো লাগছে। এটাই আমার প্রথম বিদেশ সফর। বিদেশে এসে সবচেয়ে ভালো লাগছে, প্রথমবারের মতো বয়সভিত্তিক দলে সুযোগ পাওয়া। এই আনন্দ আসলে আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। চেষ্টা করব দেশের ফুটবলে জায়গা করে নিতে, খাসিয়াদের সম্মান বাড়াতে।’

বাংলাদেশ দলের ম্যানেজার বিজন বড়ুয়া খুশি স্টারলিংকে নিয়ে। বাহরাইন থেকে তিনি বলেন, ‘ছেলেটির মধ্যে অনেক সম্ভাবনা আছে। এখন পর্যন্ত দুটি ম্যাচে সুযোগ না পেলেও কোচ নিশ্চয়ই ওকে বিবেচনায় নেবেন। আর এই সফরে ও মাঠে না নামলেই–বা কি, এই যে দলের সঙ্গে আছে, ভিন্ন পরিবেশ, ভিন্ন অভিজ্ঞতা হচ্ছে, এটাই ওর জীবনের পাথেয়। দেশের খাসিয়া সম্প্রদায়ের জন্য ছেলেটি অনেক সম্মান নিয়ে আসতে পারে আগামী দিনে।’