ব্রাদার্সের ‘ছায়া কোচ’ ওতাবেক

ওতাবেক ভালিজোনভছবি: ইনস্টাগ্রাম

অনেক বছর আগে বাংলাদেশের ফুটবলে কোচ–খেলোয়াড় দুই ভূমিকাতেই এসেছিলেন ইরানের নাসের হেজাজি। সত্তরের দশকে এশিয়ার সেরা গোলকিপারদের একজন হেজাজি ইরানের হয়ে খেলেছিলেন ১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনা বিশ্বকাপে। ক্যারিয়ার শেষ করেই মোহামেডানে এসেছিলেন হেজাজি। ১৯৮৭ মৌসুমে বেশির ভাগ ম্যাচেই হেজাজির ভূমিকা ছিল শুধুই কোচের। পুরো লিগে হেজাজি মোহামেডানের গোলবার সামলেছিলেন একটি ম্যাচেই, সেটি আবাহনীর বিপক্ষে। লিগের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে নিয়মিত গোলকিপার ছাইদ হাছান কাননের বদলে হেজাজি খেলেছিলেন মাত্র ২১ মিনিট। আর ওই ২১ মিনিট গোলবারে দাঁড়িয়েই মোহামেডানের কৌশল ঠিক করেছিলেন।

হেজাজির প্রসঙ্গ হঠাৎ আসার কারণ ওতাবেক ভালিজোনভ। উজবেকিস্তানের এই ফুটবলার বাংলাদেশের ফুটবলে পরিচিত মুখ। টিম বিজেএমসি দিয়ে শুরু করে ব্রাদার্স আর শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাব ঘুরে এ মৌসুমে আবারও ফিরেছেন গোপীবাগের তাঁবুতে। এই ওতাবেক ভালিজোনভ ৩৪ বছর বয়সেই পেশাদার ফুটবলার হিসেবে খেলার ফাঁকে করে ফেলেছেন এএফসির সব কটি কোচিং লাইসেন্স কোচ। এএফসি আর উয়েফার অধীনে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’—এই তিনটি কোচিং লাইসেন্সের পাশাপাশি আছে ‘প্রো’ লাইসেন্স। এই ‘প্রো’ ফুটবল কোচিংয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি। ওতাবেক ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ লাইসেন্স করার পর ‘প্রো’ লাইসেন্স করার পথেও এগিয়ে গেছেন অনেক দূর। কোর্সের কার্যক্রম শেষ করে তিনি এখন পরীক্ষার অপেক্ষায়। আগামী বছর সেই পরীক্ষায় পাস করলেই এএফসি ‘প্রো’ লাইসেন্স পেয়ে যাবেন। এই মৌসুমে তিনি ব্রাদার্সের অধিনায়কত্ব করছেন।

আরও পড়ুন
২০১০ সালে উজবেকিস্তানের শীর্ষ পর্যায়ের দল পিএফকে নুরাফশোন দলের সঙ্গে ওতাবেক (সামনের সারিতে ডান দিক দিয়ে দ্বিতীয়)
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

তাহলে ব্রাদার্স খেলোয়াড়ের ভূমিকায় পুরোদস্তুর এক কোচেরও সেবা পাচ্ছে? ওতাবেক অবশ্য ব্যাপারটি সেভাবে দেখতে চান না। উজবেকিস্তানের শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবলারদের ফেডারেশন থেকেই কোচিং কোর্স করার সুবিধা দেওয়া হয়, যে সুবিধাটা সব দেশেই আছে। ওতাবেকের কথা, ‘আমি উজবেকিস্তানের সর্বোচ্চ পর্যায়ে খেলা ফুটবলার হিসেবে ফেডারেশনের দেওয়া সুবিধাটা নিয়েছি। নিজের ভবিষ্যতের জন্যই নিয়েছি। আমি খেলা ছাড়ার পর কোচ হিসেবেই ফুটবলের সঙ্গে থাকতে চাই। ব্রাদার্সে কোচ আছে। কিছুদিন ফয়সাল মাহমুদ দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন এসেছেন গাম্বিয়ার ওমর সিসে। যেহেতু কোচিং নিয়ে কিছু জ্ঞান আছে, আমি তাদের সাহায্য করি। এর মানে এই না যে, জোর করে করি।’

২০১২ সালে উজবেকিস্তান অনূর্ধ্ব–২৩ দলের হয়ে ইংল্যান্ড সফরে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচে ওতাবেক
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

২০১৭–১৮ মৌসুমে প্রথম বাংলাদেশে খেলতে এসেছিলেন ওতাবেক। দেশের ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে হারিয়ে যাওয়া ক্লাব টিম বিজেএমসির হয়ে। দুর্ভাগ্যক্রমে ওই মৌসুমেই টিম বিজেএমসি দ্বিতীয় স্তরে নেমে যায়। ওতাবেক ২০১৯–২০ মৌসুমে যোগ দেন ব্রাদার্সে। কিন্তু কোভিডের কারণে ২০২০ সালের লিগ বন্ধ হয়ে যায় পাঁচ রাউন্ড পরই। লকডাউনের ওই সময়টাতে স্ত্রী–পুত্র নিয়ে ঢাকায় বন্দী জীবনযাপন করেছেন ওতাবেক। উজবেকিস্তান যাওয়ার ফ্লাইট বন্ধ ছিল অনেক দিন। চার মাস পর কিরগিজস্তান হয়ে দেশে ফেরার সুযোগ মিলেছিল। ২০২১ সালে শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবে নাম লেখান। সেখানে ২০২৩ পর্যন্ত খেলেছেন। শেখ জামাল ধানমন্ডির ঘরের ছেলেই হয়ে উঠেছিলেন। সেই ক্লাবও ছাড়তে হয়েছে টাকাপয়সা নিয়ে ঝামেলার কারণে। এবার ব্রাদার্সে খেলার পাশাপাশি দলের নীতিনির্ধারণেও তাঁর ভূমিকা থাকছে। সেটি তাঁর সমৃদ্ধ সিভির কারণেই।

আরও পড়ুন

ব্রাদার্সে খেলোয়াড় হিসেবে নিজের ভূমিকাই তাঁর কাছে প্রধান। কোচিং জ্ঞানটা কাজে লাগান তিনি বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে। তা নেপথ্যে থেকেই, ‘কোচের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, সে যে–ই হোন না কেন। আমি ফয়সাল মাহমুদকে তাঁর কাজে সাহায্য করেছি মাত্র। ওমর সিসেকেও করি। অনেক সময় কিছু পরিকল্পনা সাজাতে সাহায্য করি তাঁদের। উজবেকিস্তানে কোচিং কোর্সে যেসব শিখেছি, তা কোচের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নিই। এর বেশি কিছু না। আমি কোচ হব খেলা ছাড়ার পর, সেটিরই পূর্বপ্রস্তুতি হয়ে যাচ্ছে। জিনিসটা আমি এভাবেই দেখি।’

বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে কয়েক মৌসুম শেখ জামাল ধানমন্ডি ক্লাবের হয়ে খেলেছেন ওতাবেক
ছবি: ইনস্টাগ্রাম

উজবেকিস্তানে ২০০৭–০৮ মৌসুমে সুযোগ করে নিয়েছিলেন পিএফসি নববাহুর ক্লাবে। সেখান থেকে ঘুরেফিরে খেলেছেন এফসি শুরতান গুজার, এফকে অ্যান্ডিজন, পিএফকে নুরাফশোন ও এফসি মোগার্দিয়ানায়। ২০০৮ সালে তাঁর অভিজ্ঞতা হয়েছিল ব্রাজিলের বিশ্বকাপজয়ী তারকা রিভালদোর বিপক্ষে খেলার। সেবার রিভালদো হঠাৎ করেই খেলতে এসেছিলেন উজবেক লিগে, বুনিয়োদকর এফসির হয়ে। বিশ্বকাপজয়ীর বিপক্ষে খেলার সেই অভিজ্ঞতা ওতাবেকের কাছে অমূল্য, ‘বুনিয়োদকর সেবার দারুণ দল ছিল। রিভালদো নিজেকে উজাড় করে দিয়ে দলকে শিরোপা জিতিয়েছিল। ব্রাজিল তারকার সঙ্গে খেলার সেই অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা হয় না।’ বিশ্বমানের ফুটবলারদের সঙ্গে এরপরও খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছে ওতাবেকের। তবে সেই অভিজ্ঞতা খুব সুখকর নয়, ‘২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিকে উজবেকিস্তান অনূর্ধ্ব–২৩ দলের হয়ে খেলেছি। অলিম্পিকের পর ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব–২৩ দলের বিপক্ষে একটি প্রীতি ম্যাচে কাইল ওয়াকারের সঙ্গে সংঘর্ষে চোটে পড়ি। চোটটা ছিল মারাত্মক। ওই চোটের কারণেই জাতীয় দলে খেলার যে স্বপ্ন দেখছিলাম, সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।’

ওতাবেকের কোচিং ডিগ্রি, তাঁর কোচিং জ্ঞানকে কীভাবে দেখছে ব্রাদার্স? তাঁর সঙ্গে কিছুদিন কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে ফয়সাল মাহমুদ বললেন, ‘আসলে ওতাবেকের সঙ্গে আমি সতীর্থ হিসেবে খেলেছি। আমরা বন্ধুর মতোই। আমি ওর কাছ থেকে নির্দ্বিধায় সাহায্য নিয়েছি। ওর জ্ঞান আমাকে সমৃদ্ধ করেছে। সে কখনোই অযাচিত হস্তক্ষেপ করেনি আমার কাজে। আমি যত দিন কোচ হিসেবে কাজ করেছি, সে আমার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত মনে করেছে। আমিও কিছু চাপিয়ে দিইনি। অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হিসেবে ওর সঙ্গে আলোচনা করেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

আরও পড়ুন