নেইমারকে ‘সেদ্ধ’ করলে যা থাকে, সেটাই দেজিরে দুয়ে
আলিয়াঞ্জ অ্যারেনায় শেষ বাঁশি বেজেছে। পিএসজির খেলোয়াড়েরা মাঠেই চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের উদ্যাপনে মত্ত। সেই ভিড়ে এগিয়ে গেলেন মার্সেলো—রিয়াল মাদ্রিদ ও ব্রাজিলের সাবেক লেফটব্যাক। দেজিরে দুয়ে তাঁকে আগেই খেয়াল করেছিলেন। দুই পা এগিয়ে গিয়ে মার্সেলোকে বললেন, ‘আমার পক্ষ থেকে নেইমারকে দয়া করে হ্যালো বলবেন, প্লিজ। তিনি আমার আদর্শ।’
মার্সেলো অবশ্য এই কাজটি আগেই সেরে রেখেছেন। দুয়েকে মাঠেই জানিয়ে দেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোমাকে অনুসরণ করতে তাকে (নেইমার) আগেই বলেছি। বার্তাও দিতে বলেছি।’
পিএসজি চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পর নেইমার দুয়েকে কোনো বার্তা দিয়েছেন কি না, তা জানা যায়নি। তবে নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন, খেলার ধরনে তাঁর সঙ্গে একদম অমিল যেমন নেই, তেমনি গোল করে উদ্যাপনও ব্রাজিলিয়ানের অনুকরণেই। যদিও দুয়ের খেলার ধরনে তুলনাটা কিলিয়ান এমবাপ্পের সঙ্গেই বেশি ওঠে। টগবগে আত্মবিশ্বাস, বিস্ফোরক দৌড় ও চটপট সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। যদিও দুয়ের ভাবনা অন্যরকম, ‘আমি দেজিরে দুয়ে, কিলিয়ান হলো কিলিয়ান।’
অর্থাৎ দুয়ে নিজের পরিচয়েই পরিচিত হতে চান। তবে প্রভাবটাও স্বীকারও করে নিলেন, ‘সবাই কোনো না কোনো খেলোয়াড়ের মাধ্যমে প্রভাবিত। আমার ক্ষেত্রে নেইমার।’
কিন্তু চরিত্রগত দিক থেকে দুয়ে পিএসজিতে তাঁর দুই পূর্বসূরির চেয়ে আলাদা। গত বছর দুয়ে পিএসজিতে যোগ দেওয়ার আগে দুই মৌসুম কাটিয়েছেন রেনে-তে। লিগ আঁ-র এই ক্লাবের বয়সভিত্তিক দল থেকেই দুয়ের উঠে আসা। সেখানে তাঁকে একসময় সামলেছেন কোচ হুলিয়েন স্তেফান। দুয়ের ব্যক্তিত্ব নিয়ে ধারণা দিলেন তিনি, ‘ব্যক্তিত্ব বিচারে এরই মধ্যে তার পথ (এমবাপ্পে ও নেইমারের তুলনায়) আলাদা। তার সবকিছুই আবর্তিত হয় পারফরম্যান্স ও শীর্ষ পর্যায়ে ওঠা নিয়ে। যেটা সবচেয়ে অবিশ্বাস্য সেটা হলো, এই বয়সেই তার ব্যক্তিত্ব ও পরিণত মানসিকতা।’
অথচ দেজিরে দুয়ের বয়স আজই বিশ ছুঁল!
গত শনিবার চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে যখন জোড়া গোল করলেন, গোল বানালেন, তখনো দুয়ের গা থেকে ‘টিনএজ’ (১৯ বছর ৩৬২ দিন) ঘ্রাণ কাটেনি। কিন্তু কী করতে পারেন, সেটা মিউনিখের স্টেডিয়ামে দেখেছেন সবাই—১৯৬৪ সালে ইন্টারের হয়ে সান্দ্রো মাজোলার পর ইউরোপের শীর্ষ এ প্রতিযোগিতার ফাইনালে জোড়া গোল করার পাশাপাশি একটি গোল বানানো প্রথম খেলোয়াড়! পার্থক্যটা হলো ইতালির সর্বকালের অন্যতম সেরা মাজোলার তখন বয়স ছিল ২২ বছর, আর দুয়ে কুড়ি-ই ছোঁননি। শুধু এটাই নয়, দুয়ে এই বয়সেই কতটা পরিণত, সেটা বোঝা যায় স্তেফানের মুখে বলা এক ঘটনায়।
নেইমার পিএসজিতে থাকতে তাঁর নৈশজীবন নিয়ে প্রচুর সমালোচনা হয়েছে। রাত জেগে পার্টির মৌতাতে মজে থাকায় অনেক সময় অনুশীলনেও যেতে পারেননি। দুয়ে এ ক্ষেত্রে নেইমারকে অনুসরণ করেননি। শুনুন স্তেফানের মুখেই, ‘সে এমন এক খেলোয়াড়, যে সকালবেলা আগেভাগে (অনুশীলনে) চলে আসে এবং অনুশীলন শেষে দেরিতে যায়। ঘুমেও সে প্রচুর গুরুত্ব দেয়, সেটা বিকেল কিংবা সন্ধ্যার ঘুম। গত মার্চে সন্ধ্যায় ইউরোপিয়ান একটি ম্যাচ একসঙ্গে দেখতে আমরা খেলোয়াড়েরা ও স্টাফ মিলে একটি রেস্টুরেন্টে ডিনারের আয়োজন করি। তার মা–বাবা ও ভাই রাত সাড়ে ১০টায় এসে হাজির। কারণ, তখন বিছানায় গিয়ে তার বিশ্রামের সময় হয়ে গেছে। এটা তার পেশাদারি মনোভাব ও সিরিয়াসনেস বুঝিয়ে দেয়।’
দুয়ের পরিবারে শুধু তিনিই ফুটবলার নন। ফ্রান্সের অঁজে-তে জন্মেছেন আইভরি কোস্ট জাতীয়তার বাবা ও ফরাসি মায়ের ঘরে। নাগরিকত্ব আছে দুই দেশেরই। দুয়ের ভাই ২২ বছর বয়সী গুয়েলা দুয়েও ফুটবলার। ছোট ভাইয়ের মতো অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার কিংবা উইঙ্গার নন, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ড কিংবা সেন্টারব্যাক পজিশনে খেলেন স্ত্রাসবুর্গে। বেড়ে ওঠা দুয়ের মতোই রেনের বয়সভিত্তিক দলে। সুযোগ পেয়েছেন আইভরিকোস্ট জাতীয় দলেও। তাঁর কাজিন ইয়ান জিবোয়ো উঠে এসেছেন রেনের একাডেমি থেকে, এখন খেলেন তুলুজে। তাঁর আরেক কাজিন ২৪ বছর বয়সী মার্ক-অলিভিয়ের দুয়ে খেলেন স্পেনের তৃতীয় বিভাগের দল পনফেরাদিনায়। চাচা নওমানদিয়েজ দুয়ে আফ্রিকান ফুটবল ফেডারেশনের রেফারিং বিভাগের পরিচালক ও ফিফা ইনস্ট্রাক্টর। এমনিতে ফার্মাসিস্ট হলেও ২০১৪ বিশ্বকাপে প্রথম আইভরিকোস্টের রেফারি হিসেবে বিশ্বকাপের ম্যাচ পরিচালনা করেন।
রেনের অনূর্ধ্ব-১৩ দলে তাঁকে কোচিং করানো সিলভেইন লেতাং তখনই জানতেন, ‘খুব অল্প বয়স থেকেই দুয়ের সামনে দারুণ ক্যারিয়ার। সে সৃষ্টিশীল খেলোয়াড়। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে পার্থক্য গড়তে পছন্দ করে, তবে দলের জন৵ খেলে।’ ব্যক্তিগত ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে দুয়ে যে খুব অল্প বয়স থেকেই প্রাধান্য দেন, সেটাও বোঝা যায় তিনি রেনের অনূর্ধ্ব-১১ দলে থাকতে একটি ঘটনায়। তখন রেনের এক কোচ তাঁকে রক্ষণভাগে নামিয়ে দিয়েছিলেন, যেটা আক্রমণাত্মক মানসিকতার দুয়ের পছন্দ হয়নি। ফুটবলটাই ছেড়ে দিতে চেয়েছিলেন!
দুয়ের বাবা মাহো দুয়ে আরএমসি স্কাউটিং পডকাস্টে বলেছিলেন এ ঘটনা, ‘সে আর ফুটবল খেলতে চায়নি (তখন)।’ কিন্তু বড়দের পরামর্শে ফুটবল না ছাড়া সেই দুয়ে এখন কোথায় দাঁড়িয়ে?
রেনের মূল একাদশে গত মৌসুমে যাঁর জায়গা নিশ্চিত ছিল না, তাঁকে ৪ কোটি ৩০ লাখ পাউন্ডে কিনে এমবাপ্পের শূন্যতা পূরণ করতে চেয়েছিল পিএসজি। আর যে এমবাপ্পে পিএসজিতে চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পেরে যোগ দিলেন রিয়ালে—তাঁর মতো খেলোয়াড়ের শূন্যতা পূরণের প্রায় অসম্ভব চ্যালেঞ্জ নেওয়া দুয়ে-ই কিনা শিরোপাটি জিতলেন! সেটাও ফাইনালে ৪১ বার বলে টাচ করে দুটি গোল ও একটি গোল বানানো ছাড়াও অনেকবারই ত্রাস ছড়িয়েছেন ইন্টারের রক্ষণে।
ব্ল্যাকবার্ন রোভার্সের হয়ে প্রিমিয়ার লিগজয়ী ক্রিস সাটন তাই বিবিসি রেডিও ফাইভকে ফাইনালের পর বলেছেন, ‘দেজিরে দুয়ে থাকলে এমবাপ্পেকে কি প্রয়োজন?’
এই একুশ শতাব্দীতে বয়স কুড়ি বছর হওয়ার আগেই যে ১০ জন খেলোয়াড় ফ্রান্স জাতীয় দলে ডাক পেয়েছেন, দুয়ে তাঁদের একজন। বাকি নয়জনের নাম জানলে বোঝা যায় দুয়ে আসলে কোনো পথে আছেন—ওয়ারেন জাইরে এমেরি, উসমান দেম্বেলে, এদুয়ার্দো কামাভিঙ্গা, কিলিয়ান এমবাপ্পে, রাফায়েল ভারান, করিম বেনজেমা, কিংসলে কোমান, অ্যান্থনি মার্শিয়াল ও সামির নাসরি। আর জার্সির নম্বর হিসেবে দুয়ের ‘১৪’ বেছে নেওয়ার কারণ ব্লেইস মাতুইদি। ফ্রান্সের হয়ে বিশ্বকাপ এবং পিএসজির হয়ে চারবার লিগজয়ী সাবেক মিডফিল্ডারের জার্সি নম্বর ছিল ১৪। শুধু তা–ই নয়, ২০১০–এর দশকে পিএসজির উত্থানে যেসব খেলোয়াড়ের বড় ভূমিকা ছিল, মাতুইদি তাঁদের একজন। দুয়ের গায়ে ১৪ নম্বর জার্সি দেখে পিএসজি সমর্থকদের তাই খুশি লাগাই স্বাভাবিক।
অথচ পিএসজিতে গত বছর আগস্টে অভিষেকের পর মৌসুমের প্রথম গোল পেতে ডিসেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় দুয়েকে। এরপর অবশ্য আর থামাথামি নেই। বিভিন্ন পজিশনে খেলতে অভ্যস্ত এ ফুটবলার ৫৪ ম্যাচে ১৫ গোলের পাশাপাশি ১৬ গোল করিয়েছেন। এই ৩১ গোলে অবদানের মধ্যে ২২ গোলই এসেছে ২০২৫ সালে। ২০০৫ কিংবা তার পরে জন্ম নেওয়া খেলোয়াড়দের মধ্যে শুধু লামিনে ইয়ামালেরই এ মৌসুমে দুয়ের চেয়ে গোলে অবদান বেশি।
দুয়ের এই পারফরম্যান্স স্তেফানের ভাষায়, ‘সে এরই মধ্যে অনেক উঁচুতে পৌঁছে গেছে। সেখানেই থাকবে। এটা পরিষ্কার। তার কোনো সীমা-পরিসীমা নেই, যেটা চ্যাম্পিয়নদের বৈশিষ্ট্য। সে কি ব্যালন ডি’অর জয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে? এটা সম্ভব। একদিন তেমন কিছু হয়ে ওঠার সব রকম উপাদানই আছে তার ভেতরে।’
২০২২ সালে ইসরায়েলে ফ্রান্সের ইউরোপিয়ান অনূর্ধ্ব-১৭ টুর্নামেন্ট জয়ে প্রথম নজরে আসেন দুয়ে। তাঁর উঠে আসার বাকি পথটা এত দিনে সবার জানা। নিশ্চয়ই এটাও জানা, এবার চ্যাম্পিয়নস লিগে ১৬ ম্যাচে (৮ বার একাদশে, ৮ বার বদলি) গোল করেছেন ৫টি, করিয়েছেন ৪টি। এর মধ্যে শেষ দুটি গোলের (চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল) ম্যাচে তাঁর খেলার ধরনকে দারুণভাবে বিশ্লেষণ করেন ইংরেজ সাংবাদিক ও সংবাদমাধ্যম ‘গার্ডিয়ান’–এর প্রধান ক্রীড়া লেখক বার্নি রোনি, ‘এমন সব রাতে (চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল) তাকে দেখে মনে হয়, কেউ হয়তো নেইমারকে আট ঘণ্টা ধরে সেদ্ধ করে তার সব বাগাড়ম্বর ও অপ্রয়োজনীয় অলংকারাদি ছাড়িয়ে শুধু বিশুদ্ধ অংশটুকুসহ মাঠে ছেড়ে দিয়েছে। এ যেন পোস্ট-থেরাপি নেইমার।’
কুড়ি বছর বয়সে নেইমারের ইউরোপে পা পড়েনি। তবে দক্ষিণ আমেরিকার শ্রেষ্ঠ ক্লাব প্রতিযোগিতা কোপা লিবার্তাদোরেস জিতেছিলেন কুড়িতে পা রাখার আগেই। ১৯ বছর বয়সে। দুয়েও একই বয়সে জিতলেন ইউরোপের শ্রেষ্ঠ ক্লাব প্রতিযোগিতা।
পার্থক্য হলো, নেইমারের অমিত প্রতিভাকে ধীরে ধীরে তাঁর বিশৃঙ্খল জীবন ঘুণপোকার মতো খেয়ে নিয়েছে। দুয়ের জীবনে এখনো তেমন কোনো ‘ঘুণপোকা’র কথা জানা যায়নি। আজ তাঁর ২০ বছর বয়সে পা রাখা পর্যন্ত ভেতরে যতটুকু যা আছে, পুরোটাই শুদ্ধ, শুধু-ই ফুটবলের জন্য।
শুভ জন্মদিন, দেজিরে দুয়ে।