ইংলিশ ক্লাবের ‘বস’ এখন বিমানবন্দরের যাত্রীসেবা কর্মী

ব্রিস্টল বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা কর্মী হিসেবে কাজ করছেন লুক উইলিয়ামসএক্স

কিছুদিনের মধ্যে যদি আপনাকে ব্রিস্টল বিমানবন্দর দিয়ে কোথাও যেতে হয়, আপনার সঙ্গে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটতে পারে।
যাত্রীসেবা অঞ্চলে হাসিখুশি এক কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়ে যেতে পারে আপনার। হাই-ভিজ জ্যাকেট, স্টিল-টো ক্যাপ জুতা, হয়তো ব্যস্ত হাতে হুইলচেয়ার ঠেলছেন। যদি ফুটবলপ্রেমী হন, লোকটাকে দেখে আপনার চেনা চেনা লাগতে পারে।
আপনি তখন কী করবেন? ভদ্রলোকের চেহারা যাঁর মতো লাগছে, আপনি ফোন বের করে ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে তাঁর ছবি বের করবেন। তারপর সেই ছবিটা ওই যাত্রীসেবা কর্মীকে দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করবেন, ‘আপনি দেখতে অনেকটা এই লোকটার মতো, তা–ই না?’
সেই যাত্রীসেবা কর্মী তখন হেসে বলবেন, ‘অনেকেই বলে। বলবেই তো। কারণ, এটা আসলে আমিই!’
আপনি তখন অবাক হবেন। কারণ, আপনার সামনে যে লোকটা দাঁড়িয়ে আছেন, তিনি আর কেউ নন—লুক উইলিয়ামস, এই বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত যিনি ছিলেন ইংলিশ চ্যাম্পিয়নশিপ ক্লাব সোয়ানসি সিটির কোচ!

আরও পড়ুন

লুক উইলিয়ামসের সঙ্গে ঠিক এ ঘটনাটাই ঘটেছিল কিছুদিন আগে। ব্রিস্টল বিমানবন্দরে যাত্রীসেবা কর্মী হিসেবে যোগ দেওয়ার পর ওটা ছিল তাঁর চতুর্থ কর্মদিবস। তখন ইজিজেট ফ্লাইটের গেটে দাঁড়িয়ে, এক যাত্রীকে বাসে তোলার অপেক্ষায়। এমন সময় তিন তরুণ এসে তাঁকে দেখালেন একটি ফোন, যেখানে তাঁর নিজের ছবি! তাঁদের একজন বলেই ফেললেন, ‘আচ্ছা, আপনাকে দেখতে কি এই লোকটার মতো লাগে?’

শারীরিকভাবে অক্ষম যাত্রীদের সহায়তা করছেন লুক উইলিয়ামস
এক্স

উইলিয়ামস মিথ্যা বলার লোক নন। আর গলায় তখন তাঁর আইডি কার্ডও ঝুলছে। হাসতে হাসতেই সেই তরুণকে জানান, ওই লোকটা তিনি নিজেই। তিনি বিমানবন্ধরে যাত্রীসেবার কাজ করছেন, সেই ছবি পরে ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। শুধু এক্সেই সেই ছবিটা দেখেছে লাখ লাখ ফুটবলপ্রেমী। এ নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে নিউইয়র্ক টাইমস-এর ক্রীড়াবিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য অ্যাথলেটিকও। সেটা পরে অনেক পাঠক আবার বলেছেন, এ তো জব শেমিং!

আরও পড়ুন

লুক উইলিয়ামস নিজে অবশ্য এমনটা মনে করেন না। সোয়ানসি থেকে চাকরি হারিয়েছেন মানে যে বেকার আর ঘরে বসে টিভি দেখে দিন কাটাতে হবে—তিনি এমনটা ভাবেন না। বরং ভোর ৪টা ৪৫-এর বাস ধরে নিয়মিত পৌঁছে যান ব্রিস্টল বিমানবন্দরে, আর শুরু করেন ৯ ঘণ্টার শিফট। যাত্রীদের সাহায্য করা, বিশেষত শারীরিকভাবে অক্ষম যাত্রীদের সহায়তা করা—এটাই তাঁর নতুন কাজ।

সোয়ানসি সিটির কোচ থাকা অবস্থায় লুক উইলিয়ামস
এএফপি


চাকরি হারানোর পরও চুক্তি অনুযায়ী ক্লাব থেকে যথেষ্ট অর্থ পাচ্ছেন লুক উইলিয়ামস, শুধু ওটা হিসাব করলেই তিনি ইংল্যান্ডের শীর্ষ আয় করা ১ শতাংশ লোকদের একজন। তাই তাঁর এই চাকরিটা ঠিক টাকার জন্য নয়। বরং এটা তাঁর চোখে একটা শেখার সুযোগ, নিজের বাচ্চাদের সামনে ‘কাজ করে যাওয়া’ এবং ‘প্রতিদিনের একটা উদ্দেশ্য রাখা’র উদাহরণ। উইলিয়ামসের কথায়, ‘আমি বসে থেকে বই পড়ে সময় কাটাতে পারতাম। কিন্তু সেটা আমার ধাত নয়। আমি চাচ্ছিলাম, এমন কিছু করতে, যেটা কাজে লাগে—আমারও, সমাজেরও।’
লুক আরও বলেন, ‘এই কাজটা আমাকে একটা রুটিন দিয়েছে। একঘেয়েমি নয়, বরং নতুন কিছু শেখার সুযোগ। এখানে ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কলিগদের নানা অভিযোগ শুনি। তাতে বুঝতে পারি, মানুষ আসলে কীভাবে পরিচালিত হতে চায়।’

আরও পড়ুন

বিমানবন্দরে তিনি যেমন সাহায্য করছেন, তেমনি শিখছেনও—কেমন করে মানুষ ম্যানেজমেন্ট দেখেন, কোন গুণে একজন কর্মী প্রিয় হয়ে ওঠেন। যেমন সার্জিও নামের এক সহকর্মীর কথা বলেন উইলিয়ামস, যিনি ইতালিয়ান ক্লাব নাপোলির ভক্ত। সার্জিওর ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, যাত্রীদের প্রতি ভালোবাসা, আর সহকর্মীদের প্রশংসা—লুকের চোখে তিনি যেন আদর্শ টিম প্লেয়ার! বললেন, ‘এই লোকটা (সার্জিও) যাত্রীদের সঙ্গে এমনভাবে কথা বলে, সবাই খুশি হয়ে যায়। পজিটিভ এনার্জি ছড়ায়। সবাই ওকে পছন্দ করে। এমন একজন থাকলে ফুটবল টিমেও সপ্তাহে সপ্তাহে তাকে একাদশে রাখতাম!’

লুক উইলিয়ামস
এএফপি


এই সহজ, আন্তরিক ভাবটাই লুক উইলিয়ামসকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে দেয়। তাঁর স্কুলজীবনটা ছিল ঝামেলাপূর্ণ—একটা হোমওয়ার্কও কখনো জমা দেননি! খেলোয়াড়ি জীবনটাও ভালো যায়নি। বারবার অস্ত্রোপচার, মাথায় চোট, গাড়ি দুর্ঘটনায় খুলি আর কোমরের হাড় ভেঙে যাওয়া—সব মিলিয়ে দুঃস্বপ্ন। তবুও দমে যাননি। কোচিং ক্লাসে ভর্তি হয়েছেন, সেটার খরচ জোগাতে কখনো লরি লোড করেছেন, কখনো নাইটক্লাব থেকে লোক আনার মিনিবাস চালিয়েছেন। কোচিং দিয়েই শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। ব্রাইটন, সুইন্ডন, ব্রিস্টল, এম কে ডন্স, নটস কাউন্টি ঘুরে সোয়ানসি পর্যন্ত। চ্যাম্পিয়নশিপে সোয়ানসির পারফরম্যান্স খারাপ হওয়ায় সর্বশেষ মৌসুমের শেষ দিকে তাঁর চাকরি চলে যায়।

আরও পড়ুন

চাকরি চলে গেলে অন্য কোচরা সাধারণত ফুটবল থেকে বিরতি নেন, নিজেদের নিয়ে চিন্তা করেন এবং তারপর একটা সময় বিভিন্ন ফুটবল ক্লাব ও কোচের সঙ্গে দেখা করে আবার কোচিংয়ে ফেরেন। কিছু ব্যতিক্রমও আছে। যেমন ইয়ান হলোওয়ে বিরতিতে ছবি আঁকেন, টনি পুলিস নেপোলিয়নকে নিয়ে পড়াশোনা করেন। কিন্তু বিমানবন্দরের চাকরির জন্য আবেদন করা, জুমে ইন্টারভিউ দেওয়া এবং প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া—এটা একজন ফুটবল কোচের জন্য কিছুটা অস্বাভাবিকই।

আবার কোচিংয়ে ফিরতে চান লুক উইলিয়ামস
এএফপি


উইলিয়ামসের কাছে অবশ্য ব্যাপারটা অস্বাভাবিক নয়। ‘বিশ্রাম’ না নিয়ে বেছে নিয়েছেন ‘অভিজ্ঞতা’ অর্জনের পথ। কারণ, তাঁর চোখে, ‘পরিচয় শুধু পেশা দিয়ে তৈরি হয় না, মানুষ কেমন, সেটা দিয়েই বিচার হওয়া উচিত।’
তাহলে কি আর ফুটবলে ফিরবেন না? ‘অবশ্যই ফিরব’—লুক উইলিয়ামস আত্মবিশ্বাসী। তবে সেই প্রত্যাবর্তনের আগে এখন তিনি নিজের পরিচয় দিতে চান এভাবে, ‘একজন সাবেক ফুটবল কোচ, একজন আগ্রহী শিখতে চাওয়া মানুষ, একজন দায়িত্ববান বাবা, একজন নম্র যাত্রীসেবা কর্মী, আর সবকিছুর ওপরে একজন মানুষ!’


লুক উইলিয়ামস সত্যিই অনন্য!

আরও পড়ুন