মার্তিনেজ, অর্ধেক মানুষ তুমি অর্ধেক ‘জন্তু’

আর্জেন্টিনার গোলকিপার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ। আজ টাইব্রেকার জয়ের পরএএফপি

‘দিবু একটা জন্তু!’

ইংরেজিতে শব্দটি ‘অ্যানিমেল’; বাংলায় ‘পশু’, ‘জন্তু’, ‘জানোয়ার’...। আজ সেই ‘জন্তু’কেই ধন্যবাদ জানিয়ে কূল পাচ্ছে না আর্জেন্টিনা। থরে-বিথরে ঝরছে কৃতজ্ঞতাসূচক বার্তা।

আর্জেন্টাইন সমর্থকেরা তাঁকে এখন হাতের কাছে পেলে নিশ্চয়ই জড়িয়ে ধরতেন। কিংবা আরও এক কাঠি সরেস ভক্তরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বীরপুরুষ’ কবিতাকে অনুকরণ করতে পারেন। দেশকে ‘মা’-এর মর্যাদায় রেখে সেই দেশেরই ৩১ বছর বয়সী ‘খোকা’ মার্তিনেজকে চুমু খেয়ে তাঁরা হয়তো বলতে পারেন, ‘ভাগ্যে খোকা সঙ্গে ছিল! কী দুর্দশাই হতো তা না হলে।’

আরও পড়ুন

বীরপুরুষ ‘সন্তান’ সঙ্গে থাকলে মায়ের কিসের ভয়! যে জার্সির জন্য নিজের প্রাণটাও দিতে কার্পণ্য করবেন না এমিলিয়ানো মার্তিনেজ, সেই দেশের সম্মান রক্ষা পেয়েছে তাঁর হাতেই। ঠিক যেভাবে ২০২২ বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালে বীরপুরুষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন আর্জেন্টিনার তিন কাঠির নিচে, আজ হিউস্টনেও দেখা গেল সেই মার্তিনেজকেই। অথচ রদ্রিগো দি পল তাঁকেই কিনা ‘জন্তু’ বলে দিলেন! আবেগের দমক বাঁধ ভেঙে গেলে আসলে এমনই হয়। আর তখন ‘জন্তু-জানোয়ার’ শব্দটিও ভালো লাগে। কারণ, ভীষণ দুষ্টু ছেলেরাই সাহসী হয়। আর সে জন্যই মায়ের বকুনিতে ‘জানোয়ার’ শব্দটি থাকলেও সেটি আসলে আদরমাখা প্রশ্রয়।

আর্জেন্টিনার পক্ষ থেকে রদ্রিগেজ সেই প্রশ্রয়ই দিয়েছেন মার্তিনেজকে।

অ্যাকশনে মার্তিনেজ। ইকুয়েডরের দুটি টাইব্রেকার ঠেকিয়েছেন
এএফপি

কেন দিয়েছেন, সে প্রশ্ন এখন অবান্তর। বরং বলা ভালো, কেন প্রশ্রয় দেবেন না? বিশ্বের বাদবাকি আন্তর্জাতিক দলগুলোর স্ট্রাইকারদের কাছে মার্তিনেজ হয়তো ভীষণ বিরক্তিকর, ঝামেলার একশেষ। পেনাল্টি নিতে গেলে মনঃসংযোগ নষ্ট করতে সামনে দাঁড়িয়ে কী সব বলে! কর্নারের সময় বক্সে দাঁড়িয়ে তাঁর চোখরাঙানি সইতে হয় প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের। মাঠে কোনো ঝামেলা হলে সতীর্থের জন্য এই মার্তিনেজই আবার ছুটে যান সবার আগে। আর ঝামেলার শিকার হওয়া লোকটি লিওনেল মেসি হলে তো কথাই নেই। গোটা দুনিয়া একদিকে, আর মেসিকে আগলে মার্তিনেজ থাকবেন ঠিক তার বিপরীত প্রান্তে!

আরও পড়ুন

এই মার্তিনেজই প্রয়োজনের সময়ে আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বড় ভরসার নাম। মেসি, আনহেল দি মারিয়া কিংবা হুলিয়ান আলভারেজদের ক্ষমতার বাইরে যা, সেটাই মার্তিনেজের হাতের নাগালে। পেনাল্টি ঠেকাতে কিংবা টাইব্রেকারে ওস্তাদতুল্য লোক কিংবা ওয়ান-ওয়ান পরিস্থিতিতে। মনে পড়ে ফ্রান্সের বিপক্ষে লুসাইলের সেই ফাইনাল? শুধু টাইব্রেকার নয়, তার আগে ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে কোলো মুয়ানির শট এবং বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে মার্তিনেজের সেই দেশের স্বপ্ন বাঁচানো সেভ!

কিংবা একদম নিকট অতীতেও যাওয়া যায়। এই কোপা আমেরিকারই গ্রুপ পর্বে চিলির বিপক্ষে ম্যাচে ৭২ থেকে ৭৫ মিনিটের মধ্যে সেই দুটি সেভ। সেসবও ভালো না লাগলে আজ ইকুয়েডরের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে টাইব্রেকারের উদাহরণও টানতে পারেন। শুটআউটে প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড় কোন দিকে শট নেবেন, সেটা সম্ভবত মার্তিনেজ আগেভাগেই বুঝতে পারেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই যে এমন হচ্ছে! আজও যেমন ইকুয়েডরের অ্যাঞ্জেল মেনা ও অ্যালান মিন্দা কোন দিকে শট নেবেন, সেটি বুঝে সেদিকে ঝাঁপিয়েই শিরোপা ধরে রাখার স্বপ্ন বাঁচালেন আর্জেন্টিনার।

ম্যাচে একটু আক্রমণাত্বক মেজাজে থাকতে পছন্দ করেন মার্তিনেজ
এএফপি

বিজ্ঞানই বলে, যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আসি আসি করলে মানুষের আগে নাকি প্রাণিজগতের অন্যান্য বাসিন্দা টের পায় আগে। দি পলের কথা ধরে মজা করে তাই বলাই যায়, মার্তিনেজের ক্ষেত্রেও বিজ্ঞানের এই যুক্তি মিথ্যে নয়!

আর্জেন্টিনার হয়ে এখন পর্যন্ত চারবার টাইব্রেকার শুটআউটে দাঁড়িয়ে জিতেছেন সব কটিই। শুটআউটে ১৮টি শটের মুখোমুখি হয়ে ১টি গিয়েছে পোস্টের বাইরে, ৯টি গোল হয়েছে এবং বাকি ৮টি শটই ঠেকিয়েছেন মার্তিনেজ। এরপরও কি বলবেন, দি পল মিথ্যে বলেছেন?

আরও পড়ুন

হ্যাঁ, তা তো কিছুটা বলেছেনই। মার্তিনেজ আসলে অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ‘জানোয়ার’! মাঠে যতক্ষণ থাকেন ততক্ষণ পরেরটি, টাইব্রেকার কিংবা পেনাল্টির সামনে মার্তিনেজের এই চরিত্রের সর্বোচ্চটুকু বেরিয়ে আসে। কিন্তু শেষ বাঁশি বাজার পর সেই ‘জানোয়ার’ই পাল্টে হয়ে যায় রক্তমাংসের মানুষ। মানুষের দুঃখ ছুঁয়ে যায় তাঁকে। টাইব্রেকার জয়ের পর তাই সবার আগে ছুটে গিয়ে ইকুয়েডর গোলকিপার আলেক্সান্দার ডমিনিগুয়েজকে জড়িয়ে ধরেন, সান্ত্বনা দেন, অনুচ্চারে হয়তো বলেওছেন, ‘বন্ধু অপেক্ষা করো, তোমারও দিন আসবে!’

অপেক্ষা যে মার্তিনেজকেও করতে হয়েছে। আর্জেন্টিনার জার্সিতে খেলছেন মাত্র তিন বছর। কিন্তু এরই মধ্যে জিতেছেন কোপা আমেরিকা ও বিশ্বকাপ। অবদান? জিজ্ঞেস করতে পারেন, ২০২১ কোপার সেমিফাইনালে খেলা কলম্বিয়া দলকে, সেদিনও টাইব্রেকারে ‘জানোয়ার’-এর মুখে পড়তে হয়েছিল ‘লা ট্রাইকালার’দের। কাজটা বেশি কষ্টকর হলে অন্তত কোলো মুয়ানিকে তো প্রশ্নটি করতেই পারেন যে আর্জেন্টিনার জার্সিতে মার্তিনেজের কী অবদান?

কাতার বিশ্বকাপের ফাইনালে টাইব্রেকারেও আর্জেন্টিনার ত্রাণকর্তা ছিলেন মার্তিনেজ
এএফপি

মুয়ানি কিছু বলার আগেই আপনি মেসির উত্তর পেয়ে যাবেন। টাইব্রেকারে আর্জেন্টিনার প্রথম শটটি মিস করে কিংবদন্তির মুখে মেঘ ভর করেছিল। মার্তিনেজ সেই ‘মেঘ’ সরিয়ে মেসির মুখে শরতের আকাশ ফুটিয়েছেন। কিংবদন্তি হেসে জড়িয়ে ধরেছেন তাঁর স্বপ্নের ত্রাতাকে। তারপর বলেছেন, মার্তিনেজের সঙ্গে যে কথা সবচেয়ে মানায়, সেটাই, ‘আমি জানতাম, এসব সময়ে “দিবু” দাঁড়িয়ে যাবে। এ ধরনের মুহূর্তই ওর পছন্দ, যেটা তাঁকে বড় করে তুলেছে।’

মার্তিনেজকে বুঝতে মেসির এ কথাই যথেষ্ট। তিন কাঠির নিচে ওই ক্ষুদ্র জায়গাটুকুই মার্তিনেজের দুনিয়া। অন্য সময় যা-ই করুন, গোটা দেশ যখন ওই তিনটি কাঠির তলে দাঁড়ানো ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার মানুষটির পানে তাকিয়ে থাকে, তখন সেই তিনিই অতিমানব হয়ে ওঠেন। অন্য ভাষায় রাজা। প্রজা তো হয়েছিলেন জীবনে, সেটি পেছনে ফেলে আসা অন্য একসময়ের গল্প।

বুয়েনস এইরেসে মার দেল প্লাতায় জন্ম নেওয়া মানুষটি কৈশোরে বাড়ি ছেড়েছিলেন ফুটবলের টানে। ইন্দিপেন্দিয়েন্তে ঘুরে তাঁর আর্সেনালে অপেক্ষার গল্প সবারই জানা। ৮ বছর সেখানে থাকলেও এবং গোলকিপার নিয়ে সংকট থাকলেও আর্সেনাল তাঁকে খেলিয়েছিল মাত্র ১৫ ম্যাচ। হতাশা তো ছিলই। কিন্তু বীরপুরুষেরা সেটি প্রকাশ করবেন কেন! উল্টো ২০১৭ সালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছিলেন আশার কথা, ‘আমার সময় আসবে।’

মার্তিনেজ এমনিতে বেশ আমুদে চরিত্র। কিন্তু দেশের জার্সি গায়ে মাঠে যেন চীনের প্রাচীর
এএফপি

মার্তিনেজ এখন সেই সময়ের মধ্যেই আছেন। তিন কাঠির নিচে যে দুনিয়ার কথা বলা হলো, সেখানকার নিয়মটি তাঁর জানা। গোলকিপার দুর্দান্ত সেভ করলেও সেটি তাঁর দায়িত্ব, করারই কথা ছিল। কিন্তু ভুল করলে রক্ষে নেই! পেনাল্টিতে প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়েরা শট নেওয়ার সময় গোলকিপারকে নেকড়ের চোখে পরখ করে নেয়। মার্তিনেজ বনের নিয়ম জানেন; নেকড়ের আক্রমণ ঠেকাতে মানুষ নয়, নেকড়েই হতে হয়! দি পল যে বিষয়কে বর্ণনা করেছেন এক শব্দে। মার্তিনেজ তা পুঁজি করেই ফিরিয়ে এনেছেন সের্হিও গয়কোচিয়ার স্মৃতি।

আরও পড়ুন

১৯৯০ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ইতালির বিপক্ষে টাইব্রেকার জিতিয়ে আর্জেন্টিনাকে সেমিফাইনালে তুলেছিলেন গয়কোচিয়া। সাবেক এ গোলকিপার এখন টিভি ধারাভাষ্যকার। আজ নিশ্চয়ই উত্তরসূরির বীরত্ব তিনি দেখেছেন এবং একটি জায়গায় তাঁর একাকিত্বও ঘুচেছে। আর্জেন্টিনার ইতিহাসে এত দিন টাইব্রেকার শুটআউটে সর্বোচ্চ ৮টি সেভের রেকর্ড গয়কোচিয়ার একার দখলে ছিল। মার্তিনেজ সেখানে আজ ভাগ বসালেন। পার্থক্য হলো, গয়কোচিয়াকে এ জন্য ২৮টি শুটআউটের সম্মুখীন হতে হয়েছে, মার্তিনেজের ক্ষেত্রে যা ১৮টি। এর মধ্যে আজ সর্বশেষ ২টি সেভের পর মার্তিনেজ বলেছেন, ‘ওদের (সতীর্থদের) বলেছি, আমি বাড়ি ফিরে যেতে প্রস্তুত নই।’

অর্থাৎ কোয়ার্টার ফাইনালেই আর্জেন্টিনার যাত্রার শেষটা তিনি দেখেননি কিংবা বিশ্বাস করেননি। তাহলে এভাবে চলতে থাকলে মার্তিনেজ বাড়ি ফিরবেন কবে? মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জেতা হলো, বাদ যায়নি বিশ্বজয়ের মুকুটও। আর্জেন্টিনার জার্সিতে আরেকবার মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের মুকুট জয়ের হাতছানিও সামনে। আসলে এই আহ্বান উপেক্ষা করা মার্তিনেজের জন্য অসম্ভব। আর্জেন্টিনার জার্সি তো! সম্ভবত বাধ্য না হলে কখনো খুলবেন না। আর সেই বাধ্য হওয়ার সময় মার্তিনেজকে দেখতে কেমন লাগবে?

বয়স যতই ডালপালা ছড়াক, মাঠের আচার-আচরণে তো দেখে মনে হয় গা থেকে কৈশোরের গন্ধ এখনো যায়নি। রবীন্দ্রনাথের ‘ছুটি’ গল্পের সেই চঞ্চলমতি ফটিক চক্রবর্তীর মতো। গল্পে একদম শেষে গিয়ে ফটিকের বাড়ি ফেরার সময় হয়েছিল। ভীষণ জ্বরের ঘোরে পাশ ফিরে হয়তো চোখের দুই ফোঁটা (গল্পে নেই) অশ্রু লুকিয়ে সে বলেছিল, ‘মা, এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।’