প্রিয় জানা, ফুটবল তোমাকে ভালোবাসে
চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে পিএসজির শিরোপা জয়ের পর নামটি বারবার ফিরে এসেছে—জানা। পিএসজি কোচ লুইস এনরিকের জানা নামের এই মেয়েটি ক্যানসারে মারা যায় ২০১৯ সালে। তখন তার বয়স মাত্র ৯। ২০১৫ সালে বার্সেলোনার হয়ে এনরিকের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর উদ্যাপনের পুরোটা জুড়ে ছিল জানা। কাল তেমনই একটি মুহূর্তে জানা ছিল অন্যলোকে। কিন্তু না থেকেও কাল মাঠে উপস্থিতি ছিল জানার। উদ্যাপনের সময় বাবা এনরিকে তাকে বারবার স্মরণ করেছেন। গ্যালারিতে পিএসজি সমর্থকেরাও। ফুটবলের আবেগের সঙ্গে মিশে যাওয়া সেই জানার উদ্দেশে এই খোলাচিঠি—
প্রিয় জানা,
একটা ঘটনা বলি, শোনো। ঘটনাটা ফ্রাঞ্জ কাফকার। তাঁর সঙ্গে তোমার পরিচয় হয়েছিল কি না, আমার জানা নেই। অন্যলোকে তোমাদের দেখা হয়েছে কি না, তা–ও জানি না। তবু তোমাকে গল্পটা বলছি। পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সাহিত্যিক একদিন বার্লিনের একটি পার্কে আনমনে হাঁটছিলেন। অন্যান্য দিনের মতোই আরেকটি নীরস দিন ছিল সেটি। যদিও খুব বেশিক্ষণ আর তা থাকেনি। কাফকা দেখলেন, একটি ছোট মেয়ে পার্কের এক কোণে দাঁড়িয়ে কাঁদছে।
তিনি গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কাঁদছ কেন? মেয়েটি জানাল, সে তার পুতুল এই পার্কে হারিয়ে ফেলেছে, এখন আর খুঁজে পাচ্ছে না। এরপর মেয়েটির সঙ্গে কাফকাও খুঁজতে শুরু করলেন, কিন্তু সেই পুতুলটি আর পাওয়া গেল না। কাফকা মেয়েটিকে বললেন, পরদিন আসতে, আবার খুঁজবেন। পরদিনও খুঁজে পাওয়া গেল না। তখন কাফকা মেয়েটিকে একটি চিঠি দিয়ে বললেন, এই চিঠিটি তার সেই পুতুলের লেখা। তুমি নিশ্চয় বুঝতেই পারছ, চিঠিটা আসলে কাফকার নিজের লেখা ছিল। যেখানে লেখা ছিল, ‘তুমি কেঁদো না। আমি পৃথিবী ভ্রমণে বেরিয়েছি। আমি আমার ভ্রমণকাহিনি তোমাকে লিখে জানাব।’
এরপর পুতুলের হয়ে কাফকা নিয়মিত সেই মেয়েটিকে চিঠি লিখতেন। আর পুতুলের চিঠি মনে করে সেই চিঠি পড়ে মেয়েটি খুশি হয়ে যেত। এভাবে কিছু দিন চলার পর একদিন কাফকা একটি পুতুল এনে মেয়েটিকে দিয়ে বললেন, এই নাও তোমার পুতুল। মেয়েটি বলল, এই পুতুল তো আমার না। কাফকা তাঁকে বললেন, এটি তারই সেই পুতুল। ভ্রমণ করতে করতে বদলে গেছে।
সে কথা বিশ্বাস করে মেয়েটি পুতুলটাকে নিজের কাছে রেখে দেয়। এর অনেক দিন পর সেই পুতুলের ভেতর মেয়েটি একটি চিরকুট খুঁজে পায়, যেখানে লেখা ছিল, ‘তুমি যা কিছু ভালোবাসো, তা সম্ভবত একদিন হারিয়ে যাবে; কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই ভালোবাসা অন্য কোনো রূপে ফিরে আসবে।’
প্রিয় জানা, এই শেষ লাইনটি লেখার জন্যই মূলত পুরো গল্পটা বলা। তুমি আমাদের মাঝে আজ নেই। কিন্তু সত্যিই কি নেই? কাল চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে তোমার চেয়ে প্রবলভাবে আর কে ছিল, বলো! কাল ম্যাচজুড়ে তুমি ছিলে, ছিলে ম্যাচ শেষে উদ্যাপনের পুরোটা সময়েও। তুমি আমাদের ভালোবাসার একজন, একদিন যাকে আমরা ঘুমঘোরে হারিয়ে ফেলেছিলাম। কিন্তু মানুষ হারালেও ভালোবাসা কি হারায়! দেখো না, মিউনিখের এই রাতে কীভাবে তুমি তুমুল ভালোবাসা নিয়ে ফিরে এলে আমাদের জীবনে, ফুটবলের এই আনন্দধারায়!
অন্যলোকে বসে পিএসজির জার্সিতে উদ্যাপন করতে করতে এই ভালোবাসা নিশ্চয়ই তুমিও অনুভব করেছ! অলৌকিক সেই ভালোবাসা বুঝতে পেরেই হয়তো তোমার বাবা লুইস এনরিকে বলেছেন, ‘সে আমাদের মাঝে আছে। আমি প্রতিদিন তাকে অনুভব করি।’ গতকাল রাতে আমরাও অনুভব করেছি জানা। তুমি সত্যিই আমাদের মাঝে আছ। হ্যাঁ,শরীরীভাবে হয়তো নয়, কিন্তু তোমার হৃদয়ের গানটুকু আমরা ঠিকই শুনেছি।
তুমি তো অবশ্য জানো, ফুটবল এমনই! বিল শ্যাঙ্কলি যেমনটা বলেছিলেন, ‘ফুটবল জীবন–মরণ না, এর চেয়েও বেশি কিছু।’ সেটাই তো সত্যি হলো কাল রাতে। জীবন–মৃত্যুর সব সীমা পেরিয়ে ফুটবল তোমাকে মিলিয়ে দিয়েছে আমাদের সঙ্গে। আমাদের মতো যারা ফুটবলকে ভালোবাসে তাদের সঙ্গে। এ যেন নির্জনে কেউ পাতালের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়েছে আকাশকে।
জানা, নশ্বর পৃথিবীতে যত দিন শরীর হয়ে ছিলে ফুটবলই ছিল তোমার জীবন। সেই কবে বার্সালোনার জার্সি পরে তোমাকে আমরা উদ্যাপন করতে দেখেছিলাম। সেদিন বাবার সঙ্গে ছোট পাখির মতো মাঠজুড়ে উড়ছিলে তুমি। ভেসে গিয়েছিলে লাল–নীল উৎসবে। কাল রাতেও নিশ্চয় এমন কিছু করতে তুমি। নীল জার্সি পরে পিএসজির পতাকা হাতে পুরো মাঠে ছোট্ট পাখির মতো উড়ে বেড়াতে।
অবশ্য আগেই তো বলেছি, না থেকেও তুমি ছিলে আমাদের সঙ্গে। গ্যালারি উত্তাল করা দর্শকদের ভালোবাসায় তুমি মিশে ছিলে। বাবার বুকে টি–শার্টের গায়ে জার্সি পরে পতাকা হাতে হাসতে হাসতে আনন্দ করতেও তোমাকে আমরা দেখেছি। ফুটবলের যে আবেগ এবং জীবনের চেয়েও বড় যে ক্যানভাস, কাল রাতে সেখানে ছিলে তুমি। ম্যাচ শেষে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উপচে পড়া ভালোবাসাতেও তুমি প্রবলভাবে ছিলে জানা। সবার এমন ভালোবাসা নিশ্চয় তোমাকে আপ্লুত করেছে!
তুমি আবার আসবে জানা। ফুটবল নামের খেলাটির সঙ্গে মিশে থাকা আবেগে ভর দিয়ে তুমি আবার ফিরবে। আবার আমাদের হাসি, কান্না কিংবা উদ্যাপন–উৎসবে পাখি হয়ে, ফুল হয়ে কিংবা গান হয়ে তুমি আবার ফিরে আসবে। জীবনানন্দ দাশের ‘একটি নক্ষত্র আসে’ কবিতার সেই লাইনগুলোর মতো— ‘একটি নক্ষত্র আসে; তারপর একা পায়ে চ’লে/ঝাউয়ের কিনার ঘেঁষে হেমন্তের তারাভরা রাতে/সে আসবে মনে হয়; —আমার দুয়ার অন্ধকারে/কখন খুলেছে তার সপ্রতিভ হাতে!’
ইতি
তোমার মতোই এক ফুটবলপ্রেমী