আর্জেন্টিনার ‘সেরা সমর্থক’ তুলা আর নেই

কার্লোস পাসকুয়াল ‘তুলা’ (১৯৪১–২০২৪)। ছবিটি গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ফিফা দ্য ‘বেস্ট’ পুরস্কারের অনুষ্ঠানে তোলাএএফপি

নাম তাঁর কার্লোস পাসকুয়াল। কিন্তু এই নামে তাঁকে অনেকেই চিনবেন না। আর্জেন্টাইন ফুটবলে তাঁর অন্য নাম ‘তুলা’। এবার কি চেনা গেল? বেশি দিন আগের কথা নয়, ২০২২ কাতার বিশ্বকাপ ফাইনাল শেষে আর্জেন্টিনার জার্সিতে দিগ্‌বিদিক আনন্দে ড্রাম বাজিয়ে চলা সেই বুড়ো সমর্থককে নিশ্চয়ই মনে আছে!

আরেকটু ধরিয়ে দেওয়া যায়। গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ফিফা দ্য বেস্ট পুরস্কারে সাড়ে ছয় লাখের বেশি ভোট পেয়ে ‘বেস্ট ফ্যান অ্যাওয়ার্ড’ জিতেছিলেন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা। আর সেই পুরস্কার আর্জেন্টিনার সমর্থকদের পক্ষ থেকে নিয়েছিলেন কার্লোস পাসকুয়াল ‘তুলা’—নিজের দেশে তিনি অনেকের মতে, আর্জেন্টাইন ফুটবলের সেরা সমর্থক। সেই তুলা আর নেই। ঠিকানা পাল্টে পাড়ি জমিয়েছেন না–ফেরার দেশে।

৮৩ বছর বয়সে গতকাল মারা গেছেন তুলা।

আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘ক্লারিন’ জানিয়েছে, বুয়েনস এইরেসে মিতের সানাতোরিয়ামে গত ৩১ জানুয়ারি অস্ত্রোপচার করান তুলা। এর আগে কয়েক বছর নানা রকম শারীরিক সমস্যায় ভুগছিলেন। এ কারণেই অস্ত্রোপচার করানো হয়েছিল। তারপর কোমায় চলে গিয়েছিলেন বলে জানিয়েছিল তাঁর পরিবার। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সবার কাছে প্রার্থনা চেয়েছিলেন তাঁরা। কিন্তু প্রার্থনায় আর কাজ হলো না। লিওনেল মেসির এলাকা রোজারিওতে জন্ম নেওয়া আর্জেন্টাইন ফুটবলের একনিষ্ঠ ভক্ত এই মানুষটিকে আর তাঁর জাতীয় দলের ম্যাচে গ্যালারিতে দেখা যাবে না।

ফিফা সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনোর সঙ্গে তুলা
ফিফা

গত বছর ফেব্রুয়ারিতে ফিফা দ্য বেস্ট পুরস্কারের রাতে তুলার মঞ্চে ওঠার সেই দৃশ্য নিশ্চয়ই মনে আছে? গায়ে আর্জেন্টিনার জার্সি, মাথায় চিরাচরিত হ্যাট এবং সেটাও আর্জেন্টিনার জার্সির রঙে বানানো আর গলায় ড্রাম। স্প্যানিশ ছাড়া অন্য কোনো ভাষা না জানা এই ভদ্রলোক সেদিন ফিফার মঞ্চে উঠেও জাতীয় দলকে সমর্থন এবং সাফল্যের উচ্ছ্বাসে ভেসে ড্রাম বাজিয়েছিলেন। খুব ভালোমতো খেয়াল করে আরেকটি ব্যাপার হয়তো অনেকেই ধরতে পেরেছিলেন। তুলার ড্রামে দুজন ব্যক্তির ছবি ছিল—পোপ ফ্রান্সিস ও ইভা পেরন।

আর্জেন্টিনার ‘আধ্যাত্মিক নেতা’ হিসেবে স্বীকৃত ইভা পেরনের একনিষ্ঠ অনুসারীও ছিলেন তুলা। আর আর্জেন্টিনা জাতীয় দলকে তিনি কতটা ভালোবাসেন, সেদিন ফিফা দ্য বেস্টের রাতেই বোঝা গিয়েছিল। পুরস্কার হাতে বলেছিলেন, ‘আর্জেন্টাইন হিসেবে আমি খুশি। কারণ, প্রায় সব পুরস্কারই আমরা জিতেছি। দিবু (মার্তিনেজ), স্কালোনি ও মেসি জিতেছে। সমর্থক হিসেবে তাই আমি ভীষণ আনন্দিত। ১৯৭৪ বিশ্বকাপ থেকে আজকের দিন পর্যন্ত আমি সব বিশ্বকাপ ও কোপা আমেরিকায় (গ্যালারিতে) ছিলাম।’

সেদিন ফিফার মঞ্চে তুলার পরের কথাগুলো শুনলেও মনে হবে সমর্থক হলে এমনই হতে হয়, ‘এই ৮২ বছর (মৃত্যুর সময় ৮৩) বয়স পর্যন্ত আমি প্রায় সব জায়গাতেই গিয়েছি। হ্যাঁ, আমি গরিব, কিন্তু পৃথিবীর প্রায় সব জায়গাতেই গিয়েছি। আমি স্রেফ আরেকজন আর্জেন্টাইন ভক্ত, যে অন্য সব লাখো সমর্থকের মতোই জাতীয় দলকে ভালোবাসে। আর্জেন্টিনা ছিল দুঃখী দেশ। কিন্তু তারা (জাতীয় দল) আমাদের আনন্দে ভাসিয়েছে।’

ক্লারিন জানিয়েছে, আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের ম্যাচে সমর্থন দিতে তুলা এক ডজনের বেশি দেশ ভ্রমণ করেছেন। যাত্রাপথে যখন যেখানে যা পেয়েছেন, তাতেই চড়ে বসেছেন—নৌকা, উড়োজাহাজ, ট্রেন—কোনো কিছু বাদ রাখেননি। ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপের অফিশিয়াল গানের ভিডিওতেও ছিলেন তুলা। আর এসবই তিনি সম্ভব করেছেন শুধু স্প্যানিশ ভাষাজ্ঞানকে পুঁজি করে। কখনো কখনো কাজে লাগিয়েছেন ডিয়েগো ম্যারাডোনার সঙ্গে সম্পর্ক এবং একজন ‘পেরোনিস্ট’ হওয়ার পরিচিতি। আর্জেন্টিনার সাবেক প্রেসিডেন্ট হুয়ান পেরন ও তাঁর স্ত্রী ইভা পেরনের রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারীদের এ নামে ডাকা হয়।

আর্জেন্টিনার জার্সি ও ড্রাম—তুলার জীবনে অবিচ্ছেদ্য হয়ে উঠেছিল
ফিফা বিশ্বকাপ

গত বছর ডিসেম্বরে তুলার ‘পেরোনিস্ট’ হওয়ার পেছনের গল্পটা সংবাদমাধ্যম সিএনএনকে বলেছিলেন তাঁর নাতি মাতিয়াস বোরে, ‘শৈশবে দেখেছি, আমার দাদা হুয়ান সেবাস্তিয়ান পেরন ও ইভা দুয়ার্তে পেরনের অনুসারী ছিলেন। ইভা তাঁকে একটি সাইকেল উপহার দিয়েছিলেন এবং সম্ভবত সেটা তাঁর জীবনের একমাত্র সাইকেল ছিল। তখন থেকেই তাঁর লক্ষ্য ছিল পেরনের সঙ্গে অন্তত একবার হলেও দেখা করা এবং তাঁকে সম্মান জানানো।’

১৯৭১ সালে স্বপ্নপূরণ হয়েছিল তুলার। নির্বাসিত হুয়ান সেবাস্তিয়ান পেরনের সঙ্গে দেখা করতে স্পেনে গিয়েছিলেন তুলা। ‘পেরোনিস্ট’দের ‘লয়্যালিটি ডে’তে নিজের ড্রামটা পেরনকে উপহার দেন তুলা। পেরনও তুলাকে নতুন একটি ড্রাম উপহার দিয়েছিলেন। আর্জেন্টিনার সংবাদমাধ্যম ‘লা নাসিওন’ জানিয়েছে, সেই ঘটনার পর থেকে ড্রাম তুলার যেন আরেকটি অঙ্গ হয়ে গিয়েছিল! রাজনৈতিক কর্মসূচি থেকে আর্জেন্টিনার ম্যাচ—ড্রাম নিতে কখনো ভুলেননি তুলা। আর্জেন্টিনার ক্লাব ফুটবলে রোজারিও সেন্ট্রালকে সমর্থন করতেন ১৯৪১ সালে জন্ম নেওয়া এই ফুটবলপাগল মানুষটি।

আর্জেন্টিনার খেলা দেখতে তুলা এই যে বিভিন্ন দেশে যেতেন, সেটার খরচ নির্বাহ করতেন কীভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর গত বছর মার্চে তাঁকে নিয়ে ‘বুয়েনস এইরেস হেরাল্ড’-এ প্রকাশিত প্রতিবেদনেই দিয়েছেন তুলা। আর্জেন্টিনা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (এএফএ) ও রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্য নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেছিলেন, ‘আমার টাকাপয়সাওয়ালা বন্ধুরা আছে, যারা আমাকে নিমন্ত্রণ করে।’ তুলা হুইলচেয়ারে করেও বিভিন্ন দেশে গিয়েছেন। মুঠোফোন ছিল না। আর স্প্যানিশ ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা না জানায় ভিনদেশে তাঁর যাতায়াত থেকে অন্য সবকিছুতে সমস্যা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কীভাবে যেন সবকিছু সামলে নিতেন। এর ব্যাখ্যায় বলে গেছেন, ‘সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মতো কাউকে না কাউকে পেয়ে যেতাম।’

স্পেনে হুয়ান সেবাস্তিয়ান পেরন নির্বাসিত থাকাকালীন সময়ে তাঁর সঙ্গে তুলা। তখন বেজ ড্রামস উপহার পেয়েছিলেন পেরনের কাছ থেকে
এক্স

জার্মানিতে অনুষ্ঠিত ১৯৭৪ বিশ্বকাপ দেখতে যাওয়ার স্মৃতিও ক্লারিনকে এর আগে বলেছিলেন তুলা, ‘প্রথমে মাদ্রিদে যাই, পেরনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুবাদে জায়গাটা আগে থেকেই চেনা ছিল। এরপর ফ্রান্সের সীমান্ত পার হয়ে জার্মানিতে ঢুকেছিলাম।’ এ পথে অন্যের গাড়িতে যাত্রী হয়ে কিংবা লুকিয়ে জাহাজে উঠে গন্তব্যস্থলে যাওয়ার কথাও সংবাদমাধ্যমটিকে বলেছিলেন তুলা। শুধু কি তা–ই, আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে তোলা ছবি এবং খেলোয়াড়দের সঙ্গে তোলা পোস্টকার্ডের ছবি দেখিয়েও ভ্রমণের খরচ মিটিয়েছেন তিনি।

২০২২ বিশ্বকাপের আগে নিজের ড্রামসের জন্য স্পনসর চেয়েছিলেন তুলা। কাতারে যাওয়ার খরচ মেটাতে সাহায্যও চেয়েছিলেন। এ নিয়ে তাঁর জীবনদর্শনটা বলেছিলেন ক্লারিনকে, ‘আমার টাকা নেই। কিন্তু আমি হচ্ছি সার্চ ইঞ্জিন, যে সব সময় যোগাযোগটা রাখে সবার সঙ্গে। মানুষের ভালোবাসা এ ব্যাপারে খুব গুরুত্বপূর্ণ।’ কাতার বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে তুলা জানতেন না সেখানে কীভাবে যেতে হবে। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে তুলা ক্লারিনকে এ নিয়ে বলেছিলেন, ‘অর্থ নেই। এটাও জানি না, কোন ভাষায় কথা বলতে হবে। কিন্তু সৃষ্টিকর্তা আমার পাশে আছেন। এর আগে ১২টি বিশ্বকাপে ছিলাম টাকাপয়সা ছাড়াই। সমর্থন দেওয়ার মতো কাউকে না কাউকে পেয়ে গেছি সব সময়। উদাহরণ চান? রাশিয়ায় (২০১৮) এক রাশিয়ান আমাকে সাহায্য করেছেন। এবারও আশা করছি, কারও না কারও সাহায্য পাব।’

আর্জেন্টিনার সমর্থক হিসেবে তুলার পরিচিতি কিন্তু তাঁর দেশের সীমানা ডিঙিয়েছে বেশ আগেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অন্য সব সমর্থকদের কাছে তিনি পরিচিত মুখ, প্রেরণাও। জুরিখে ফিফার জাদুঘরে একটি সেকশন আছে তাঁর জন্য। সেখানে তাঁর একটি হ্যাট সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। সেই হ্যাট অবশ্যই আর্জেন্টিনার জাতীয় পতাকার রঙে বানানো এবং তার পাশে ড্রামসের একটি স্টিকও রাখা আছে, যেটা তুলা একসময় ব্যবহার করতেন। হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার আগে জাদুঘরটি একবার দেখতে যেতে চেয়েছিলেন তুলা। কিন্তু মানুষের মনের ইচ্ছা সব সময় পূরণ হয় না। মানুষ চায় এক হয় আরেক!

এখন এসবই স্মৃতি।

তবে তুলাকে মনে রাখা হবে, এমনটাই জানিয়েছেন এএফএ সভাপতি ক্লদিও তাপিয়া। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘এক্স’-এ করা পোস্টে তাপিয়া লিখেছেন, ‘আমরা একে অপরকে কখনো ভুলব না। তোমাকে সব সময় মনে রাখব তুলা!’