গৃহযুদ্ধও দমাতে পারেনি ইয়েমেনের তরুণ ফুটবলারদের
বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে টানানো বিশাল আকারের ইয়েমেনের জাতীয় পতাকা। সেটি নিয়ে জয় উদ্যাপন করা সমর্থকদের দিকে ম্যাচ শেষে ছুটে আসে ইয়েমেনের অনূর্ধ্ব–১৭ ফুটবলাররা। ৫ ও ৭ অক্টোরর তা দেখা গেছে স্টেডিয়ামে। সারাক্ষণ যেন ফুটবলের আনন্দেই মেতে থাকতে চায় ইয়েমেনের এই তরুণ ফুটবলাররা। ঢাকায় চলমান এএফসি অনূর্ধ্ব–১৭ এশিয়ান কাপ ফুটবলের বাছাইপর্ব খেলতে এসে নিজেদের দারুণভাবে মেলে ধরেছে তারা।
ইয়েমেনের ছেলেরা ঢাকায় দুই ম্যাচে করেছে ১৪ গোল। ভুটানের জালে আট, সিঙ্গাপুলের জালে ছয়। রীতিমতো গোলের বন্যা বইয়ে দিচ্ছে তারা। চূড়ান্ত পর্বে যেতে শেষ গ্রুপ ম্যাচে বাংলাদেশের বিপক্ষে রোববার জয় চায় দলটি। অথচ যুদ্ধবিধ্বস্ত মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইয়েমেনের ফুটবলারদের জীবন কাটে কি না নানা সংকটে। গোলরক্ষক ওয়াদাহ আনোয়ার আহমেদ, অধিনায়ক ইসাম আবদুলাতেফ রাদমানদের ঘুম ভাঙে বারুদের গন্ধে। রক্তের দাগ মুছে নিত্যদিনের অনুশীলন শুরু করে ফুটবলাররা।
ইয়েমেনে যেন মানুষের জীবনের দাম সবচেয়ে সস্তা। প্রায় আট বছর ধরে সে দেশে হুতি ও বিচ্ছিন্নতাবাদীর মধ্যে চলছে গৃহযুদ্ধ। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম দরিদ্র এই দেশে শিশুদের ভবিষ্যত বলতে গেলে অনিশ্চিত। দুর্নীতি, খাদ্যাভাব ও বেকারত্বের উচ্চ হারের মতো বহু সমস্যায় জর্জরিত ইয়েমেনের মানুষ তবুও ফুটবলকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। গোলার আঘাতে বাড়িঘর ধ্বংস হচ্ছে, ভেঙে পড়ছে স্টেডিয়াম।
একের পর এক গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে ফুটবল অবকাঠামো। সেখানে গড়ে উঠছে অস্থায়ী মিলিটারি ক্যাম্প। তবুও ইয়েমেনের শহর, গ্রামে, পাড়া–মহল্লার অলিগলিতে ফুটবলে মেতে ওঠে সবাই। যুদ্ধের মতো মানবিক সংকটের মধ্যেও অনানুষ্ঠানিক টুর্নামেন্ট আর পথ ফুটবলের মাঝে সান্ত্বনা খুঁজে নেয় ইয়েমেনিরা। বালু আর পাথরে ভরা ন্যাড়া মাঠে অপেশাদার ফুটবলাররা গোল দিয়ে মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে।
যুদ্ধে হাজার হাজার সাধারণ মানুষ মারা যাচ্ছে ইয়েমেনে। বাদ পড়ছে না ফুটবলাররাও। ঢাকায় আসা ইয়েমেনের অনূর্ধ্ব-১৭ দলের কোচ মোহাম্মদ হাসান আলী আলবাদানি বলছিলেন, ‘যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে ইয়েমেনের অন্তত ২৫-৩০ ফুটবলার। এর মধ্যে আছে জাতীয় দলের গোলরক্ষক আবদুল্লাহ আরেফ। সকালে ক্লাবের মাঠে অনুশীলন করার সময় গোলার আঘাতে মারা গেছে সাবেক ফুটবলার নাসের আল-রাইমি। ১০ বছরের ছেলেকে নিয়ে সে ক্লাবের মাঠে অনুশীলন করছিল। রকেটের গোলায় দুজনের শরীর ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়।’
দলের সঙ্গে আসা চিকিৎসক আবদুল রেহমান আলশারগাবিও যুদ্ধের নৃশংসতার শিকার। তিনি বলেন, ‘আমার এক নিকটাত্মীয় যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছে। গৃহযুদ্ধ আমাদের জীবন এলোমেলো করে দিয়েছে। আমরা এ থেকে মুক্তি চাই।’
শুধু ফুটবল নয়, গৃহযুদ্ধের কারণে ইয়েমেনে সব ধরনের খেলাধুলা বন্ধ হওয়ার জোগাড়। যদিও জাতিসংঘের নেওয়া যুদ্ধবিরতির উদ্যোগে গত ছয় মাস মাঠে একটু একটু করে খেলা ফিরতে শুরু করেছে। কিন্তু অর্থসংকটে ক্লাবগুলো ঠিকমতো চলতে পারছে না বলে জানালেন আবদুল রেহমান, ‘সাধারণত এই ধরনের যুদ্ধে দেশের খেলাধুলায় বড় রকমের প্রভাব পড়ে। আমাদের ফুটবল লিগও বন্ধ ছিল অনেক দিন।
তবে খুশির খবর, সেটা গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে আবারও চালু হয়েছে। কিন্তু খেলোয়াড়দের সহযোগিতার জন্য যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন, সেটা আমাদের নেই।’
দক্ষিণ ইয়েমেনে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা বেশি শক্তিশালী। উত্তর ইয়েমেনে শক্তি দেখায় হুতিরা।
বিভক্ত এই জাতিকে ফুটবলই একদিন এক পতাকার নিচে এনেছিল। সেই বর্ণনা দিচ্ছিলেন আবদুল রেহমান, ‘গত ডিসেম্বরে আমাদের ছেলেরা পশ্চিম এশিয়ান অনূর্ধ্ব-১৫ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে সৌদি আরবকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। সেদিন সানা, এডেনের রাস্তায় রাস্তায় হুতি আর বিদ্রোহীরা ইয়েমেনের জাতীয় পতাকা উড়িয়েছে। গাড়ির হর্ন বাজিয়েছে। আতশবাজি আর বুলেট ছুড়েছে আকাশে। সত্যিই সেদিন মনে হচ্ছিল, ফুটবলই পারে আমাদের এক পতাকার নিচে আনতে।’
ফুটবল দিয়েই ঐক্যবদ্ধ হতে চায় ইয়েমেনিরা। দেশে কিংবা বিদেশে যেখানেই হোক না কেন, ফুটবলের মাধ্যমেই আকাশে ওড়াতে চায় ইয়েমেনের পতাকা।