মেসি কেন মেসি, নেইমার কেন নেইমার

লিওনেল মেসি ও নেইমারছবি: রয়টার্স

নির্মলেন্দু গুণ লিখেছিলেন, ‘কবিতা আমাকে জাগিয়ে রাখে, ঘুমুতে দেয় না। আমাকে সে কষ্ট দেয় আমার মেয়ের চোখের জলের মতো।’ ২৪ নভেম্বর ব্রাজিল যখন হারাল সার্বিয়াকে, রিচার্লিসনের বাইসাইকেল কিকের সৌন্দর্যের ছটায় যখন আমাদের চোখ অন্ধপ্রায়, তখন ঘটে গেছে আরেক ঘটনা।

নেইমার খেলা শেষ হওয়ার আগেই মাঠ ছেড়ে গেছেন, বেঞ্চে যখন তিনি বসা, তাঁর চোখ অশ্রুতে টলমল করছিল। পরের দিন সেই দৃশ্য দেখে হৃদয় বিদীর্ণ হতে লাগল, তা কষ্ট দিতে লাগল আমার মেয়ের চোখের জলের মতো।

নেইমার আবারও জখম। ২০১৪ সালে পিঠের হাড় ভেঙে মাঠ ছেড়েছিলেন। কিন্তু তা শুধু একজন খেলোয়াড়ের চলে যাওয়া ছিল না! জার্মানির বিরুদ্ধে সেই রহস্যময় খেলার দিনে বেলো হরিজন্তে স্টেডিয়ামে পুরো গ্যালারিতে দর্শকেরা পরে এসেছিলেন নেইমারের মুখোশ, আর খেলোয়াড়েরাও নেইমারের জার্সি হাতে নিয়ে জাতীয় সংগীত গাইছিলেন।

ফল আমরা সবাই জানি, ১–৭, কিন্তু সেই ভয়ংকর কুড়ি মিনিটের ব্যাখ্যা জানি না। আমার কাছে ব্যাখ্যা একটাই, নেপোলিয়নকে ছাড়া ফরাসি বাহিনী এগোচ্ছে রাশিয়ার দিকে, আলেকজান্ডারকে ছাড়া গ্রিস বাহিনী চলেছে ভারত জয় করতে, নেইমারকে ছাড়া ব্রাজিল নেমেছে জার্মানিকে রুখতে!

গত পরশু প্রথম আলো ডটকমে আমি লিখেছিলাম, ‘বলে দিন, আর্জেন্টিনাই জিতবে।’ তাতে আর্জেন্টিনার এক স্কুলশিক্ষকের উদ্ধৃতি ছিল, ‘সবাই কথা বলবে ফুটবল নিয়ে, আমি আস্থা রাখি মেসির হৃদয়ের শক্তিতে।’ ফুটবলে ৯০ মিনিট খেলা হয়, ৫৪০০ সেকেন্ড, একটা গোল হতে লাগে মাত্র এক সেকেন্ড। এই এক সেকেন্ডই পার্থক্য রচনা করে, আর তা ঘটান বড় খেলোয়াড়েরা।

মেক্সিকোর বিপক্ষে গোলের পর মেসি
ছবি: রয়টার্স

আর্জেন্টিনার আছেন মেসি। মেক্সিকোর বিরুদ্ধে তাঁর ওই গোলটা কেবল তিনিই করতে পারেন। মেক্সিকোর মেসি ছিল না, তাই তারা গোল পায়নি। ২০১৮ সালে এমবাপ্পের খেলা দেখে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলাম, চ্যাম্পিয়ন হবে ফ্রান্স। কারণ, চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য লাগে জিগীষা, খুনে স্বভাব। যেটা ম্যারাডোনার ছিল, ব্রাজিলের রোনালদোর ছিল। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর আছে। দক্ষতার উৎকর্ষ দিয়েও চ্যাম্পিয়ন হওয়া যায়, যা করে দেখিয়েছেন জিনেদিন জিদান। মেসির সেই উৎকর্ষ আছে, সেই সৌকর্য আছে নেইমারের। মেসি বা নেইমার ম্যারাডোনার মতো দুর্ধর্ষ নন, তাঁরা শিল্পী, তাঁরা জাদুকর। বল পায়ে তাঁরা যা খুশি তা–ই করতে পারেন।

মেসির প্রশংসা আপনি করতে পারেন আরেকটা কারণে, তিনি ভদ্র, নম্র। নেইমার কিন্তু উল্টো। তিনি হলেন পাড়ার সেই দুষ্টু ছেলে, যাকে ভালো না বেসে আপনি পারবেন না। খেলা শুরুর আগে গা গরমের পালায় নেমে নেইমার সহখেলোয়াড়দের সঙ্গে অবিরাম দুষ্টুমি করতে থাকেন, দেখলে মুখে আপনা–আপনিই হাসি ফুটে ওঠে। নেটফ্লিক্সের ছবিটা কি দেখেছেন, নেইমার, দ্য পারফেক্ট কেওয়াস? নেইমার মানেই হট্টগোল।

তিনি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে খেলতে গিয়ে ফাউলের শিকার হয়েছেন ৯ বার, রাশিয়া বিশ্বকাপে ৫ ম্যাচে তাঁকে ফাউল করা হয়েছে ২৬ বার, লিগে তিনি ফাউলের শীর্ষ শিকার, এ মৌসুমে ৬৬ বার। উৎপল শুভ্র ঠিকই লিখেছেন, এর কারণ তিনি বল নিয়ে কারিকুরি করে প্রতিপক্ষকে নাজেহাল করেন।

সার্বিয়ার বিপক্ষে চোট পান নেইমার
ছবি: রয়টার্স

নেইমারের ইনজুরিতে নাকি ব্রাজিলবাসী খুশি। এর কারণ, রাজনীতি। তিনি ব্রাজিলের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একটা পক্ষ নিয়েছেন। তবে নেইমার ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘ঈশ্বর যদি আমাকে একটি দেশ বেছে নেওয়ার সুযোগ দেন, তাহলে আমি অবশ্যই বেছে নেব ব্রাজিল।

আমার জীবনে কিছুই সহজে আসেনি। আজকের দিনটা আমার জীবনের এক কঠিন দিন।...আমি নিশ্চিত আমার দেশ আর সতীর্থদের পাশে দাঁড়াতে আমি ফিরে আসব।’

নেইমার ফিরে আসছেন। তিনি বলছেন, বেঞ্চে থাকবেন, দরকার হলেই নেমে পড়বেন। আজকের খেলা সুইজারল্যান্ডের বিরুদ্ধে, এটা কঠিন। কিন্তু ব্রাজিলকে পারতে হবে নেইমারকে ছাড়াই খেলতে।

নেইমার, শিগগিরই সেরে উঠুন। ব্রাজিল থেকে বাংলাদেশ, আপনার জন্য প্রার্থনা করছে কোটি কোটি সমর্থক!