ব্রাজিলের জার্সিতে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডে পেলেকে ছুঁতে লাগে আর মাত্র দুটি গোল। শুধু ছোঁয়া কেন, গোলসংখ্যায় পেলেকে পেরিয়ে যাওয়ার বিপক্ষে কেউ বাজি ধরতে চাইলে মনে হয় না, তাতে কোনো সাড়া পাওয়া যাবে।
রেকর্ডটা যদি হয়েই যায়, সঙ্গে বিশ্বকাপটা জিতেও ফেলতে পারেন, তাহলে নেইমারের আর কোনো অতৃপ্তি থাকবে বলে মনে হয় না। ভুলে যেতে পারবেন ২০১৪ বিশ্বকাপের দুঃস্বপ্ন। ২০১৮ বিশ্বকাপে ফুটবল–বিশ্বের কৌতুকে পরিণত হওয়ার যন্ত্রণা। আপনারও হয়তো নেইমার বললে ওই ছবিগুলো আর চোখে ভাসবে না। কোন ছবিগুলো, বুঝতে পারছেন তো!
এর আগে একটা প্রশ্ন। হুয়ান কামিলো জুনিগার কথা কি মনে আছে? এমনিতে মনে রাখার কোনো কারণ নেই। যদিও সন্দেহ করি, লেখাটা নেইমারকে নিয়ে বুঝে ফেলায় আপনার মনে পড়ে গেছে কলম্বিয়ান এই উইং ব্যাকের কথা। নেইমার জুনিয়রের ফুটবল-জীবনের সবচেয়ে বেদনাময় অধ্যায়টা তো এই জুনিগার কারণেই।
২০১৪ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনাল শেষ হওয়ার চার মিনিট আগের ওই দৃশ্যটা হয়তো টিভিতে লাইভ দেখে থাকবেন। দৌড়ে এসে হাঁটু দিয়ে নেইমারের পিঠে মারলেন জুনিগা। ব্যথায় মাটিতে কাতরাতে থাকা নেইমার তখন ভাবতেই পারেননি, নিজেদের দেশে স্বপ্নের বিশ্বকাপ সেখানেই শেষ। আঘাতটা আর ইঞ্চিখানেক এদিক-ওদিক হলেই বাকি জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে যেতে পারতেন—পরে এটা জানার পর হয়তো তাঁর বিশ্বকাপ-দুঃখ কিছু্টা কমেছে।
ব্রাজিল সেই ম্যাচ জিতে সেমিফাইনালে উঠেছিল। যে সেমিফাইনালের কথা উঠলে ব্রাজিলিয়ানমাত্রই অন্য প্রসঙ্গে চলে যেতে চান। বেলো হরিজন্তেতে জার্মানির বিপক্ষে ৭-১ গোলে পরাজয়ের দিন নেইমার আরেক শহরের হাসপাতালে হুইলচেয়ারে বসা। মাঠে থেকেও হলুদ কার্ডের খাঁড়ায় কাটা পড়ে যিনি খেলতে পারেননি, সেই থিয়াগো সিলভা কাল দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এসে দাবি করলেন, নেইমারকে এত ভালো অবস্থায় তিনি কখনো দেখেননি।
২০১৪ বিশ্বকাপের সঙ্গে এই বিশ্বকাপের থিয়াগো সিলভার পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে যা বললেন, একই কথা নেইমারের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। এই আট বছরে জীবন অনেক কিছু শিখিয়েছে। ফুটবল তো বটেই। নেইমার সম্পর্কে অবশ্য আরেকটা তথ্য যোগ হলো। ২০১৮ বিশ্বকাপে গিয়েছিলেন চোটের সমস্যা নিয়ে। এবার পুরো ফিট। রীতিমতো টগবগ করে ফুটছেন।
২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে নেইমারের কী হয়েছিল, তা তো শুরুতেই বলা হলো। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের কথা মনে আছে তো? ২০১৪ যদি নেইমারের প্রতি সবার সমবেদনা জাগিয়ে থাকে, ২০১৮ জাগিয়েছে বিরক্তি। ৫ ম্যাচে ২৬ বার ফাউলের শিকার হয়েছেন। ম্যাচপ্রতি সংখ্যাটা সবচেয়ে বেশিই হবে। তবে মনে হয় না, এটা কেউ মনে রেখেছে। বরং মনে রেখেছে মাঠে নেইমারের গড়াগড়ি। যা এমনই আলোচিত ছিল যে মোট কত সময় মাঠে শুয়ে ছিলেন, সেই হিসাবও বের করে ফেলা হয়েছে—১৪ মিনিট। নেইমারকে কতবার ফাউল করা হয়েছে, তা ভুলে গিয়ে এই সংখ্যাটাই বরং মনে রেখেছেন সবাই।
যে কারণে ‘বিশ্বকাপের নেইমার’ বললে মাঠে গড়াগড়ি দিতে থাকার দৃশ্যটাই হয়তো চোখে ভাসে আপনারও। মনেই থাকে না, বিশ্বকাপে নেইমার ৬টি গোলও করেছেন। পরশুর পেনাল্টি গোলে লিওনেল মেসি এগিয়ে যাওয়ার আগে বিশ্বকাপে দুজনের গোল সমানই ছিল। মেসির এটা শেষ বিশ্বকাপ। শেষ বিশ্বকাপ রোনালদোরও। বয়সে দুজনের অনেক ছোট হয়েও নেইমারেরও নাকি এটাই শেষ।
সান্তোস থেকে উঠে আসা, খেলার ধরন...সব মিলিয়ে ‘নতুন পেলে’ নামটা তো শুরু থেকেই। এই বিশ্বকাপই শেষ হলে বিদায়ে মিল থাকবে। বয়সের মিল। পেলেও ৩০ বছর বয়সেই শেষ বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। তবে তা তিনটি বিশ্বকাপ জেতার পর। এটা ছোঁয়ার সাধ্য তো আর নেইমারের নেই। তবে ট্রফি হাতে নিয়ে বিশ্বকাপকে বিদায় জানানোয় মিলটা তো থাকতেই পারে।
মেসি-রোনালদোও বিশ্বকাপ জেতেননি। ক্যারিয়ারের একমাত্র অতৃপ্তি ঘোচানোর তাড়না তাঁদেরও আছে। তবে নেইমারের ক্ষেত্রে তো সেটা দায়। শুধু তাহলেই যদি মানুষের স্মৃতি থেকে ২০১৮ বিশ্বকাপের ওই ছবিগুলো মুছে যায়।