উগান্ডায় কেন আর্সেনালকে নিয়ে এত পাগলামি
সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে আজ চ্যাম্পিয়নস লিগ কোয়ার্টার ফাইনালের ফিরতি লেগে রিয়াল মাদ্রিদের মুখোমুখি হবে আর্সেনাল। লন্ডন থেকে অনেক গানার সমর্থক নিশ্চয়ই মাদ্রিদে যাবেন, প্রিয় দলের সমর্থনে গলা ফাটাবেন। উত্তর লন্ডনের বার-পাবগুলো কাল রাতে মুখর থাকবে আর্সেনাল সমর্থকদের হইহুল্লোড়ে।
ওদিকে উত্তেজনা আর রোমাঞ্চ নিয়ে খেলা দেখতে বসবেন লন্ডন থেকে প্রায় ১০ হাজার কিলোমিটার দূরের শহর উগান্ডার কাম্পালায় আর্সেনালপ্রেমীরা। নিজদের দেশের ক্লাব নয়, কিন্তু আর্সেনালকে নিয়ে সাম্প্রতিককালে উগান্ডার ফুটবলপ্রেমীদের উন্মাদনা বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমে বেশ আলোচিত। যেমন আলোচিত হয়ে উঠেছিল ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের সময় আর্জেন্টিনাকে নিয়ে বাংলাদেশের ফুটবলপ্রেমীদের উন্মাদনাও।
গত সপ্তাহেই উগান্ডার আর্সেনাল সমর্থকেরা রাত জেগে উৎসব করার একটা উপলক্ষ পেয়েছিলেন। তাদের প্রিয় দল চ্যাম্পিয়নস লিগের কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগে রিয়াল মাদ্রিদকে হারিয়েছিল ৩-০ গোলে! ফ্রি-কিক থেকে আর্সেনাল মিডফিল্ডার ডেকলান রাইসের অবিশ্বাস্য দুই গোলের পর উগান্ডার রাজধানী কাম্পালায় যে আবেগ, উল্লাস আর উন্মাদনা দেখা গেছে, তাতে যে কারও মনে হতে পারে, আর্সেনাল বুঝি তাদেরই ঘরের দল।
মিকেল আরতেতার দল যখন মাঠে নামে, পূর্ব আফ্রিকার এই দেশটির বড় শহরগুলোতে নৈশ ক্লাব, পাবের দৃশ্যই বদলে যায়। রীতিমতো উৎসব শুরু হয় যেন। এক সময় ইংল্যান্ডেরই আরেক ক্লাব ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড বেশ জনপ্রিয় ছিল উগান্ডায়। তবে ইদানীং বেশ বেড়েছে আর্সেনাল সমর্থক। সম্ভবত এই মুহূর্তে আর্সেনালই উগান্ডার সবচেয়ে জনপ্রিয় ফুটবল ক্লাব। গানারদের ম্যাচের আগে এখানে রীতিমতো গির্জায় বিশেষ প্রার্থনাও হয় মাঝেমধ্যে, চাওয়া হয়েছে ঐশ্বরিক সাহায্য! আর্সেনালের মাঠের খেলা দেখে অবশ্য ইদানীং অনেকেরই এমনটা মনে হতে পারে, ঐশ্বরিক সাহায্য দরকার!
এই ভালোবাসা শুধু আবেগে সীমাবদ্ধ থাকেনি, এটা বড় একটা ব্যবসায়িক সম্ভাবনাও তৈরি করেছে উগান্ডায়। দেশটির বিভিন্ন শহরের দোকান আর ছোট ব্যবসায়ীরা জার্সি বিক্রি করছেন, আর্সেনালের জার্সি নিয়েই সবচেয়ে বেশি আগ্রহ। বড় কোম্পানিগুলো ম্যাচ ও ফলাফল ঘিরে বিজ্ঞাপণ দিচ্ছে। অন্যদিকে, স্পোর্টস বেটিং কোম্পানিগুলোর জন্যও এটা একটা বিশাল ব্যবসা।
দীর্ঘদিন ধরে আফ্রিকার ফুটবল কাভার করছেন দেশটির অভিজ্ঞ ক্রীড়া সাংবাদিক আইজ্যাক মুমেমা। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, ‘আমি আফ্রিকার অনেক দেশ ঘুরেছি, কিন্তু ফুটবল নিয়ে উগান্ডার মতো পাগলামি অন্য কোথাও দেখিনি।’
কাম্পালার এক গ্যারেজে মেকানিক সোয়ালে সুলেইমান, তিনি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ভক্ত। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ নিয়মিত অনুসরণ করেন; কারণ, তাঁর মতে, ইপিএলের উত্তেজনা, প্রতিদ্বন্দ্বিতা, বিনোদন এবং অপ্রত্যাশিত ফলাফলের সম্ভাবনা যেকোনো লিগের চেয়ে বেশি।
আরও অনেকেই হয়তো সুলেইমানের মতো ভাবেন। যে কারণে ইংল্যান্ডের বড় বড় ক্লাবগুলোর ফ্যান ক্লাব তৈরি হয়েছে উগান্ডায়। সমর্থকদের নিজেদের মধ্যে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ খোলা হচ্ছে, পানশালা আর ভিডিও হলে তো সব সময় আলোচনা চলতেই থাকে।
তবে আর্সেনাল ভক্তদের উন্মাদনা যেন অন্য মাত্রার। প্রিয় দল বড় ম্যাচ জিতলে আর্সেনাল সমর্থকেরা পুলিশের অনুমতি ছাড়াই বিজয় মিছিল বের করেন। এ রকম ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে দেশটিতে। আবার এর খারাপ দিকও আছে। প্রিয় দলের প্রতি এই ভালোবাসা মাঝেমধ্যে মারাত্মক সহিংসতায় রূপ নেয়।
কখনো কখনো দুই দলের সমর্থকদের মধ্যে লেগে যায়। হাতাহাতি, মারামারি হয়।
গত বছরই ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের বিপক্ষে জয়ের উল্লাস করার সময় এক আর্সেনাল সমর্থককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। লুকায়া শহরের এক ভিডিও হলে তিনি খেলা দেখছিলেন। শেষ বাঁশি বাজার পরে আর্সেনাল সমর্থকেরা এত উল্লাস করছিলেন যে সেখানকার এক নিরাপত্তাকর্মী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। রাগে তিনি ট্রিগার টেনে দেন।
গত মৌসুমের শুরুতে কাবালে এলাকায় বেনিয়ামিন এনডিয়ামুহাকি নামে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এক সমর্থককে এক আর্সেনাল সমর্থক ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন।
এর আগে গত মৌসুমের শুরুতে কাবালে এলাকায় বেনিয়ামিন এনডিয়ামুহাকি নামে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের এক সমর্থককে এক আর্সেনাল সমর্থক ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন। আর্সেনাল আর লিভারপুলের মধ্যে ম্যাচের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে দুজনের মধ্যে তর্ক হয়েছিল। ২০২৩ সালে দেশটির বিভিন্ন প্রান্তে প্রিমিয়ার লিগ-সংশ্লিষ্ট চারটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
উগান্ডা ফুটবল কোচিং অ্যাসোসিয়েশনের (ইউএফসিএ) চেয়ারম্যান স্টোন কায়াম্বাদ্দে বিবিসিকে বলছিলেন, ‘আমাদের দেশের লোকজনের কিছু পছন্দ হলে ওরা সেটার সঙ্গে পুরো মন দিয়ে জড়িয়ে পড়ে। আর উগান্ডার মানুষ ফুটবলকে সত্যিই ভালোবাসে।’
উগান্ডায় ফুটবলসংশ্লিষ্ট সহিংসতা অবশ্য আশির দশক থেকে চলে আসছে। দেশটির ক্রীড়াবিজ্ঞানী লুম্বুয়ে লিনিকা বিবিসিকে বলেছেন, ‘এক্সপ্রেস এফসি আর এসসি ভিলার মতো উগান্ডার প্রধান দুটি স্থানীয় দলের মধ্যে খেলা হলেই সহিংসতার ঘটনা ঘটত।’
কিন্তু ইদানীং পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এর জন্য জুয়াকে দায়ী করছেন। দেশটির অনেক পুরুষ বাজি ধরে জীবিকা নির্বাহের চেষ্টা করেন। কয়েক বছর আগে বাজিতে টাকা হারানোর পর বিষ খেয়ে আত্মহত্যাও করেছিলেন একজন।
বেটিং কোম্পানিগুলোও প্রিমিয়ার লিগ নিয়ে উগান্ডার ফুটবলপ্রেমীদের এই আসক্তির সুযোগ নিচ্ছে। তারা নিজ উদ্যোগে এমন কিছু জায়গা তৈরি করেছে, যেখানে ভক্তরা খেলা দেখতে এবং বাজি ধরতে পারবেন। ওসব জায়গাতে প্রায়ই সহিংস ঘটনা ঘটছে।
কাম্পালার এক ইউনাইটেড সমর্থক আমোস কালওয়েগিরা বিবিসিকে বলেছেন, ‘কাজের সুযোগ সীমিত হওয়ায় অনেক ফুটবল ভক্ত দ্রুত টাকা উপার্জনের জন্য বাজির দিকে ঝুঁকছেন। এই বিনিয়োগের সঙ্গে আবার আবেগও জড়িত। ফলে ম্যাচের ফলাফল নিজের অনুকূলে না গেলে অনেকেই আগ্রাসী হয়ে যাচ্ছেন।’
ক্রীড়াবিজ্ঞানী লুম্বুয়ে লিনিকার মতে, ‘ফুটবল আমাদের আনন্দ দেওয়ার কথা, বিনোদনের একটা মাধ্যম হওয়ার কথা। কিন্তু উগান্ডায় আমরা এটাকে জীবিকা নির্বাহের একটা উপায় বানিয়ে ফেলেছি, যা আনন্দের বারোটা বাজাচ্ছে।’ তবে উগান্ডার একটি বেটিং কোম্পানির সিনিয়র অফিসার কলিন্স বংগোমিন মনে করেন, ফুটবল সহিংসতার জন্য বেটিং (বাজি) শিল্পকে দায়ী করা উচিত নয়। তাঁর দাবি, দেশটির মানুষ যথেষ্ট সভ্য নয় বলেই এমনটা হচ্ছে।
উগান্ডায় আর্সেনালের অফিশিয়াল সাপোর্টার্স ক্লাবের সেক্রেটারি সলোমন কুতেসার মতে, দেশের মদ্যপান সংস্কৃতিই ফুটবল সহিংসতার জন্য দায়ী।
অবশ্য উগান্ডায় ২ হাজারের বেশি বেটিং শপ থাকায় সরকারেরও লাভ হচ্ছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, গত বছর বাজি ধরা থেকে সরকার প্রায় ৫ কোটি ডলার রাজস্ব আদায় করেছে।
কেউ কেউ মনে করেন, এসব সহিংসতার জন্য মূলত আর্সেনাল আর ইউনাইটেড সমর্থকেরাই দায়ী। লিভারপুল সমর্থক লিনিকা যেমন বললেন, ‘আমাদের সমর্থকেরা একটু বয়স্ক, একটু সচ্ছল। তাই আমরা হারে বেশি আবেগপ্রবণ হই না।’ তাঁর সঙ্গে সুর মিলিয়েছেন পামেলা ইকুমার নামে আরেক লিভারপুল ভক্ত, ‘আমরা হারলেও মাথা গরম করি না।’ অন্যদিকে ওদের পাশেই বসে আর্সেনাল ভক্ত অ্যাগনেস দাবি করেছেন, ‘ধুর! আমরা আবেগপ্রবণ, তাই বলে কি পাগল নাকি?’
উগান্ডায় আর্সেনালের অফিশিয়াল সাপোর্টার্স ক্লাবের সেক্রেটারি সলোমন কুতেসার মতে, দেশের মদ্যপান সংস্কৃতিই ফুটবল সহিংসতার জন্য দায়ী। তাঁর কথা, ‘কিছু ভক্ত নেশাগ্রস্ত অবস্থায় খেলা দেখে এবং দল হারলে তাদের সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে।’
কুতেসার এখন কায়মনোবাক্যে একটাই জিনিস চান—আর্সেনালের জয়। এনওয়াঙ্কো কানু আর থিয়েরি অঁরির সময় থেকেই তিনি আর্সেনাল ভক্ত। তাঁর কথা, ‘এই মৌসুমটা আমাদের।’
এই মৌসুমে আমাদের বলতে কুতেসা হয়তো চ্যাম্পিয়নস লিগের কথাই বুঝিয়েছেন। প্রিমিয়ার লিগের তাদের শিরোপা স্বপ্ন তো ভেস্তেই গেছে বলা যায়। তবে আর্সেনালের সামনে এখনো সুযোগ ১৬ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগের সেমিফাইনালে খেলার। তারপর যদি ভাগ্য সঙ্গে থাকে, হয়তো প্রথমবারের মতো জিততে পারে ইউরোপ-সেরার ট্রফিও।