ছয়ে নির্যাতনের শিকার, সাতে ধূমপায়ী, আটে মাদকসেবী—ডেলে আলীর শৈশব যেভাবে কেটেছে

সর্বশেষ তুর্কি ক্লাব বেসিকতাসে খেলেছেন ডেলে আলীছবি : টুইটার

ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের সাবেক ডিফেন্ডার ও ফুটবল-বিশ্লেষক গ্যারি নেভিলের ইউটিউব চ্যানেল দ্য ওভারল্যাপকে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন এভারটনের ইংলিশ অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার ডেলে আলী। সেই সাক্ষাৎকারে আলী তাঁর নিজের জীবন নিয়ে এমনকিছু তথ্য জানিয়েছেন, যা অস্বস্তিতে ফেলবে, আবার সাক্ষাৎকার থেকে চোখ সরানোও কঠিন।

নেভিলের ইউটিউব চ্যানেলে কাল এই সাক্ষাৎকার পোস্ট করা হয়। ইংল্যান্ডের ৩৭ ম্যাচ খেলা টটেনহামের সাবেক এই মিডফিল্ডার সাহসের সঙ্গে জানিয়েছেন, ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তি কাটাতে তিনি পুনর্বাসন কেন্দ্রেও ভর্তি হয়েছিলেন। আর শৈশব নিয়ে যা জানিয়েছেন, তা শুনে খারাপ লাগবেই।

টটেনহামে শুরুর দিকে ডেলে আলীকে ইংলিশ ফুটবলে প্রজন্মের অন্যতম সেরা প্রতিভা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। কিন্তু বিভিন্ন কারণে প্রত্যাশা মিটিয়ে এগোতে পারেননি। নেভিলের সঙ্গে খোলা মনের আলাপচারিতায় ২৭ বছর বয়সী এ ফুটবলার জানিয়েছেন, পুনর্বাসন কেন্দ্রে তাঁর ভর্তি হওয়ার ঘটনা বেশি দিন আগের নয়। আর শৈশবে মায়ের এক বন্ধুর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকারও হয়েছিলেন।

আলীর ভাষায়, ‘সত্যি বলতে, এটা (নিজের শৈশব) নিয়ে আমি কখনোই সেভাবে কিছু বলিনি। এমন কিছু ঘটনা আছে, যেগুলো (আমার শৈশবকে) সংক্ষেপে বুঝতে সাহায্য করবে। ছয় বছর বয়সে আমি মায়ের বন্ধুর দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হই। তখন তিনি বাসায় নিয়মিত আসতেন। আমার মা ছিলেন মদ্যপ। তখন আমার বয়স ছয় বছর। নিয়মশৃঙ্খলা শিখতে আমাকে আফ্রিকা পাঠানো হয়েছিল। পরে সেখান থেকে ফেরত পাঠানো হয়।’

টটেনহামের হয়ে ২০১৮-১৯ মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ওঠা আলী নিজের শৈশবের বর্ণনায় এখানেই থামেননি; বলে যান, ‘সাত বছর বয়সে ধূমপান শুরু করি। আট বছর বয়সে ড্রাগ নেওয়াও শুরু হয়। বয়সে বড় এক লোক বলেছিল, ছোটদের বাইক চালাতে অসুবিধা নেই। আমি ফুটবল নিয়ে বাইকে উঠে তার নিচে ড্রাগস রেখে চালিয়েছি। ১১ বছর বয়সে পাশের এলাকার এক লোক আমাকে ব্রিজের সঙ্গে ফাঁসি দিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছিল।’

গ্যারি নেভিলকে সাক্ষাৎকার দেওয়ার এক পর্যায়ে কেঁদে ফেলেন ডেলে আলী
ছবি : টুইটার

আলীর বাবার নাম ডেনিস ও মায়ের নাম কেহিন্দে। নৈশক্লাবে দুজনের পরিচয়ের এক বছর পর আলীর জন্ম। তিন বছর বয়সে তাঁর মা–বাবার বিচ্ছেদ ঘটে। এরপর তাঁর বাবা আবারও বিয়ে করেন। মিলিয়নিয়ার বাবার সঙ্গে নাইজেরিয়াতেও শৈশব কেটেছে আলীর। প্রাইভেট স্কুলে তিনজন কাজের লোক তাঁকে আনা-নেওয়া করতেন। বাসায় ফিরে মাকে মদ্যপ অবস্থায় দেখতেন।

আলীর বাবা ডেনিস পরে স্বীকার করেছিলেন, তাঁর ছেলের বেড়ে ওঠা প্রত্যাশামতো হয়নি। আলী নিজেও এর আগে জানিয়েছেন, শৈশবে নিজের আশপাশে ‘ভুল মানুষ’ পেয়েছিলেন, সে সময় রাত দুইটা পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা মেরে বাসায় ফিরেছেন।

আরও পড়ুন

২০০৭ সালে স্থানীয় মিল্টন কেনেস ডনস ক্লাবে যোগ দেওয়ার পর ফুটবলে মনোযোগ দেন আলী। সেখানে ক্লাব সতীর্থ হ্যারি হিকফোর্ডের বাসায় তাঁর পরিবারের সঙ্গে থাকতে শুরু করেন। অ্যালান ও স্যালি হিকফোর্ড তাঁকে দত্তক নেওয়ার পর জীবনটা পাল্টাতে শুরু করে। এর পর থেকে জার্সিতে নিজের নামের সঙ্গে বংশপদবি রাখেননি আলী। তাঁর ভাষায়, আলী পরিবারের সঙ্গে নিজের কোনো যোগসূত্র তিনি অনুভব করতেন না।

নিজের দত্তক মা–বাবাকে নিয়ে আলী বলেছেন, ‘১২ বছর বয়সে আমাকে দত্তক নেওয়া হয় এবং তখন থেকে এটা অসাধারণ একটি পরিবার। আমার জীবনে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারত না।’ পুনর্বাসনে থাকা নিয়েও কথা বলেছেন এই ফুটবলার। সে সময় নাকি নিজের শৈশব নিয়ে আলীর চিন্তাভাবনাই ঘুরিয়ে দিয়েছিল, ‘পুনর্বাসনে তারা আমাকে শিখিয়েছিল, শৈশব নিয়ে নিজেকে দোষ দেওয়াটা ঠিক নয়। আমার জীবনে তো কোনো আইনি বিধিনিষেধ ছিল না। পুলিশি ঝামেলায় জড়িয়েছি। কোনো নিয়ম ছাড়াই বেড়ে উঠেছি। মা প্রচুর মদ্যপান করত। সে জন্য তাকে দোষ দিই না। পুনর্বাসনে যাওয়ার পর বুঝেছিলাম, সে কোন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে।’

আলী জানিয়েছেন, জন্ম দিয়েছেন যে মা–বাবা, তাঁদের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার কোনো ইচ্ছাই তাঁর নেই, ‘মায়ের সঙ্গে আর কথা বলি না। ১৮ বছর বয়সে আমার জন্মদাত্রী মা ও বাবা সংবাদমাধ্যমের কাছে গিয়ে দত্তক নেওয়া পরিবারকে দোষারোপ করেন। অথচ দত্তক নেওয়া পরিবার থেকেই আমাকে মা–বাবার সঙ্গে দেখা করতে যেতে বলো হতো। আমি কখনো যেতে চাইনি...এসবের পর মনে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলাম। এ কারণেই মায়ের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখিনি। বাবা? তার সঙ্গেও সম্পর্ক রাখতে চাই না।’

আরও পড়ুন

ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তি নিয়েও কথা বলেন ডেলে আলী, ‘ঘুমের ওষুধের প্রতি আসক্তি আছে আমার। এটা শুধু আমার সমস্যা নয়, ফুটবল যাঁরা বোঝেন, তাঁদের বাইরেও এ সমস্যায় পড়া অনেকেই আছেন।’

টটনহামে ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করে আসা ডেলে আলী চোখে মরিসিও পচেত্তিনো সেরা কোচ
ছবি : টুইটার

টটেনহামে থাকতে মরিসিও পচেত্তিনোকে সেরা ম্যানেজার বলেছেন আলী। গত বছর এভারটনে যোগ দিলেও ২০২২-২৩ মৌসুমে তাঁকে তুর্কি ক্লাব বেসিকতাসে ধারে পাঠায় ইংলিশ ক্লাবটি। আলী মনে করেন, নিজের জীবনের এসব ঘটনা তিনি বলেছেন, কারণ তাতে অন্যদেরও উপকার হতে পারে। তাঁর মতো ভুক্তভোগীরা যেন উপকৃত হতে পারেন, সে জন্য আলী বলেছেন, ‘কোনো পরিবর্তন মানেই সেটা ভীতিকর নয়...আশা করি আমার অভিজ্ঞতাগুলো সবাইকে সাহায্য করবে।’