জার্মান মাথা ও বলকান হৃদয়ের তেরজিচ যেভাবে স্বপ্নপূরণের খুব কাছে

বরুসিয়া ডর্টমুন্ড কোচ এদিন তেরজিচ। প্যারিসে গতকাল রাতে ফাইনালে ওঠার পরএএফপি

চল্লিশোর্ধ্ব পুরুষ, শক্তপোক্ত, পরিণত, পোড়-খাওয়া। চোখ ভিজতে সে রকম আঘাত লাগে। এদিন তেরজিচের জীবনে তেমন আঘাত এসেছিল ২০২৩ সালের ২৭ মে। সেদিন মৌসুম শেষ হওয়ার মাত্র ৪ মিনিট আগে বায়ার্ন মিউনিখের কাছে বুন্দেসলিগা শিরোপা হারিয়েছিল বরুসিয়া ডর্টমুন্ড। গ্যালারিতে উন্মত্ত প্রায় ৮০ হাজার ‘হলুদ-কালো’ শিবির। কিছুক্ষণ আগে ঘটা ট্র্যাজেডিতে তাঁদের শোকে মুহ্যমান হয়ে পড়ার কথা।

আরও পড়ুন

কিন্তু কিসের কী, ডর্টমুন্ডের সমর্থকেরা আকাশ-বাতাস কাঁপানো নিনাদে ক্লাবের গান গাইতে শুরু করলেন। সমর্থকদের সমবেত সেই চিৎকারসুলভ সংগীতের মাঝে খেলোয়াড়দের নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন তেরজিচ। খেলোয়াড়দের কারও কারও ভেঙে পড়াটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু তেরজিচের তো তেমন হলে চলবে না। তিনি কোচ—এ ঘরানার মানুষেরা সাধারণত আবেগকে বাক্সবন্দী করে ডাগআউটে নেমে নিরাসক্ত মনেই বাড়ি ফেরেন। কিন্তু তেরজিচ সেদিন আর পারেননি।

ডর্টমুন্ড ফাইনালে ওঠার পর কোচিং স্টাফদের সঙ্গে তোলা এই ছবিটি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করে তেরজিচ লিখেছেন, ‘ওয়েম্বলি! আমরা আসছি!’
ইনস্টাগ্রাম

সামনে উন্মাতাল সমর্থকদের নিনাদ—তেরজিচের প্রতি তা যেন তিরের ফলার মতো ছুটে আসছিল। চোয়াল শক্ত করে চোখ-মুখ কুঁচকে তিনি মনের মধ্যে কোথায় যেন বাঁধ দেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু ভালোবাসার তোড়ের সামনে পৃথিবীর সবকিছুই বালির বাঁধ! তেরজিচ কেঁদে ফেললেন। অশ্রু লুকাতে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে অবচেতন মনে দুই-এক পা সামনে এগোলেন। কোচের মনের মধ্যে কী চলছে, সেটা বুঝতে পেরে গ্যালারি থেকে ঝরল করতালির বৃষ্টি, সঙ্গে অশ্রু—এবার সমর্থকদের চোখে। তেরজিচ তখন আর কোচ নেই। তিনিও সমর্থক!

এবার সেই সমর্থকের গল্প শুনুন।

২০১২ সাল। ডর্টমুন্ডের ডাগআউটে ‘রবিনহুড’খ্যাত ইয়ুর্গেন ক্লপ। এই জার্মানের হাত ধরে সেবারই সর্বশেষ লিগ জিতেছিল ডর্টমুন্ড। ‘প্রুশিয়ানস’দের সেই বিজয় গ্যালারি থেকে দেখেছিলেন তেরজিচ। মাথায় কালো ক্যাপ, গলায় শৈশবের ‘প্রথম প্রেম’ ডর্টমুন্ডের হলুদ গলাবন্ধ। তেরজিচ হাসছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছবিটি এখন ভাইরাল। ২০১২ থেকে ২০২৪—তেরজিচের এই এক যুগের পথচলার শিরোনাম কী হতে পারে? স্বপ্নপূরণ? নাহ, সেটি তো এখনো পুরোপুরি পূরণ হয়নি। হ্যাঁ, এটুকু বলাই যায়, সেই ভক্তই এখন কোচ, আর এই ৪১ বছর বয়সী কোচের হাত ধরেই নিজেদের ১১৪ বছরের ইতিহাসে তৃতীয়বারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে উঠল ডর্টমুন্ড।

আরও পড়ুন

অথচ ডাগআউটে নয়, কৈশোরে তেরজিচ মাঠে থাকতে চেয়েছিলেন। হতে চেয়েছিলেন ফরোয়ার্ড। জার্মানির আঞ্চলিক লিগে (চতুর্থ স্তর) ১৮৮ ম্যাচ খেলার পর ২০১৩ সালের দিকে এসে তেরজিচ বুঝে ফেলেন, খেলার মাঠ নয়, তাঁর জায়গা অন্য কোথাও। তত দিনে বয়সও একত্রিশের কোঠায়। তেরজিচের ফুটবল নিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি অবশ্য তার আগেই পাল্টাতে শুরু করেছিল।

ক্রীড়াবিজ্ঞানে ২০১০ সালে ডিগ্রি নিয়ে রেখেছিলেন তেরজিচ। সেই সময় থেকে ২০১৩ পর্যন্ত অপেশাদার ফুটবলে খেলার পাশাপাশি বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের একাডেমিতে স্কাউট ও সহকারী কোচের কাজও করেছেন। অনূর্ধ্ব-১৭, অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব-২৩ দল নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি মূল দলের জন্য খুঁজতেন প্রতিভাও। লিভারপুলে কিংবদন্তি মর্যাদা পাওয়া ক্লপ তখন ডর্টমুন্ড মূল দলের দায়িত্বে। তখনকার একটি ঘটনা এমন—একবার স্টুয়ার্ডের ছদ্মবেশে রিয়াল মাদ্রিদের গোপন অনুশীলন সেশন দেখতে গিয়েছিলেন তেরজিচ। রিয়ালে পেনাল্টি নেয় কারা—এটা দেখার জন্য। ‘সেটা ছিল অভিযাত্রার শুরু’—সেই সময়টা স্মরণ করে গত বছর জানুয়ারিতে ‘দ্য অ্যাথলেটিক’কে বলেছিলেন তেরজিচ।

তেরজিচ বড় হয়েছেন ডর্টমুন্ডের ৪০ কিলোমিটার পূর্বের শহর মেনদেনে। সাবেক যুগোস্লাভিয়ান অভিবাসীর সন্তান তিনি, ‘আমার বাবা বসনিয়ান, মা ক্রোয়েশিয়ান, বাসায় আমরা যুগোস্লাভিয়ান ভাষায় কথা বলি।’ তাঁর ভাই অ্যালেন ডর্টমুন্ডের রিজার্ভ দলের অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্বে ছিলেন। ডর্টমুন্ডের স্কাউট হিসেবেও কাজ করেন। দুটি দেশের নাগরিকত্ব—জার্মানি ও ক্রোয়েশিয়া—রয়েছে তেরজিচের। যদিও তিনি নিজে দাবি করেন, ‘আমার জাতীয়তা হলো ফুটবল।’

আরও পড়ুন

তেরজিচ সে জাতীয়তার স্বরূপও ব্যাখ্যা করেছেন। নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলার জন্য ‘জার্মান মাথা’ এবং ‘আবেগ ও হৃদয়টা একজন বলকানের।’

শৃঙ্খলার উদাহরণটা চাইলে এবার চ্যাম্পিয়নস লিগ থেকেই নিতে পারেন। ডর্টমুন্ডের এ পর্যন্ত খেলা ১২ ম্যাচের মধ্যে ১০ ম্যাচেই প্রথমার্ধে প্রতিপক্ষ গোল করতে পারেনি। পার্ক দে প্রিন্সেসে পিএসজিও গতকাল সেমিফাইনাল ফিরতি লেগে প্রথমার্ধে গোল পায়নি। অথচ পিএসজির স্কোয়াডের দাম ১০০ কোটি ইউরোর বেশি আর সেই দলে ছিলেন ১৮ কোটি ইউরো দামের বিশ্বের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার কিলিয়ান এমবাপ্পে! শুধু প্রথমার্ধ কেন, পিএসজি তো দুই লেগ মিলিয়েই গোল পায়নি!

জার্মানি, ক্রোয়েশিয়া কিংবা বসনিয়া—তিনটি দেশের জাতীয় দল মাঠে নামলে তেজরিচ ভক্ত বনে যান। ডর্টমুন্ডের বাইরে এই তিনটি জাতীয় দলের তিনি একনিষ্ঠ সমর্থক। বুঝতেই পারছেন সেটি মা, বাবা এবং যে দেশটি তাঁর পরিবারকে ‘গেস্ট ওয়ার্কার’ হিসেবে থাকতে দিয়েছিল, তাদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই এমন ভক্ত বনে যাওয়া, ‘শুধু এই ম্যাচগুলোর সময়ই কর্নারে কতজন খেলোয়াড় আছে, সেসব আমি পাত্তা দিই না।’

২০১২ ইউরোয় ক্রোয়েশিয়ার কোচ স্লাভেন বিলিচ আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচের আগে কৌশলগত জ্ঞান নিয়েছিলেন তেরজিচের কাছ থেকে। ম্যাচটা ৩-১ গোলে জেতার পর সংবাদ সম্মেলনে সে জন্য তেরজিচকে ধন্যবাদও জানিয়েছিলেন। পরে সেই বিলিচেরই ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর সহকারী হিসেবে যোগ দেন তুর্কি ক্লাব বেসিকতাসে। সেখান থেকে ওয়েস্ট হাম ইউনাইটেডে। এবারও বিলিচের সহকারী।

আরও পড়ুন

এই ওয়েস্ট হামে থাকতেই তেরজিচের কোচিং অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং পর্যবেক্ষণ বেড়েছে। আর সে জন্য বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে বড় হওয়াটা তাঁর জন্য আশীর্বাদ। তেরজিচের ভাষায়, ‘আপনি বছরের পর বছর পড়াশোনা করতে পারেন, বিভিন্ন লোকের কথা শুনতে পারেন, অনেক ব্যাজও পেতে পারেন। কিন্তু এই সবকিছুই অন্য রকম হয়ে যাবে যখন আপনি বিভিন্ন দেশের ২৫টি ‘ইগো’র (খেলোয়াড়) সামনে দাঁড়াবেন। এটা শেখা যায় না। এটার মধ্যেই বাঁচতে হয়। আমি নিজেকে অবিশ্বাস্য রকম সৌভাগ্যবান মনে করি, কারণ বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি।’

বিলিচ ওয়েস্ট হামে ২০১৭ সালে ছাঁটাই হওয়ার পর ডর্টমুন্ডে ফিরে আসেন তেরজিচ। কাজ শুরু করেন ডর্টমুন্ডের তৎকালীন লুসিয়ান ফাভরের সহকারী হিসেবে। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে ফাভরে ছাঁটাই হওয়ার পর ২০২০-২১ মৌসুম শেষ না হওয়া পর্যন্ত ডর্টমুন্ডের অন্তর্বর্তীকালীন কোচের দায়িত্ব পান। এর মধ্যে কিছুদিন কাজ করেছেন ক্লাবটির টেকনিক্যাল পরিচালক হিসেবেও। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। ভক্ত থেকে স্কাউট, সহকারী কোচ এবং তারপর মূল দলের কোচ—একদম ‘জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ’!

অন্তর্বর্তীকালীন কোচ হিসেবে সে বছর ডর্টমুন্ডকে জার্মান কাপ জিতিয়েছিলেন তেরজিচ। খেলোয়াড়দের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক, ইংরেজি ভাষায় পারঙ্গমতা এবং ডর্টমুন্ডের সমর্থকদের (ইয়েলো ওয়াল) মধ্যে জনপ্রিয়তা অর্জন করা তেরজিচ তাঁর প্রাণের ক্লাবের মূল দলের কোচের দায়িত্ব পান ২০২২ সালের ২০ মে মার্কো রোজের জায়গায়। বাকিটা আপনার জানা।

তেরজিচ ম্যাচের শেষে সাধারণত ঘুমানো কিংবা বিশ্রাম নেন না। ম্যাচের ভুলগুলো নিয়ে কাটাছেঁড়া করেন। তবে ম্যাচ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ড্রেসিংরুমে গিয়ে খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথাও বলেন না। খেলোয়াড়দের সঙ্গে বসেন তিনি লম্বা একটা ঘুম দেওয়ার পর। আর ম্যাচের আগে একদম ঠান্ডা মাথা চাই তাঁর। রসিকতা করে সে জন্যই বলেছেন, ‘আমি অনেকটাই মোবাইল ফোনের মতো। রিচার্জ হতে হয় নতুবা ব্যাটারি ফুরিয়ে যায়।’

ডর্টমুন্ডের স্বপ্নপূরণ করতে পারবেন কি তেরজিচ
ইনস্টাগ্রাম

চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ওঠার পর তেরজিচ নিশ্চয়ই এখন রিচার্জ হচ্ছেন। সামনে যে আরও বড় পরীক্ষা। সে জন্য চাই ঠান্ডা মাথা। অবশ্য ‘ইয়েলো ওয়াল’ কিংবা ‘হলুদ বসন্ত’-এর (ফাইনালে ওঠার পর তো বসন্তই) সারথি-সমর্থকদের স্বপ্ন দেখার কথাটা বলেই রেখেছেন তেরজিচ, ‘আমরা সমর্থকদের স্বপ্ন দেখার সামর্থ্যটা ফিরিয়ে দিতে পেরেছি।’

ক্লপও ডর্টমুন্ড সমর্থকদের এই সামর্থ্যটা ফিরিয়ে এনেছিলেন। তেরজিচও হাঁটছেন সে পথেই। একটা লম্বা ঘুম থেকে উঠে তেরজিচ হয়তো হাঁক দেবেন, চলো এবার স্বপ্নটা পূরণ করি!

আরও পড়ুন