অনেক নাটকের পর সরে গেলেন বার্সা সভাপতি

সভাপতির পদ থেকে সরে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিচ্ছেন বার্তোমেউ।ছবি: বার্সেলোনার টুইটার

আগের দিনও সভায় বসেছিলেন তাঁরা। তখন পর্যন্ত জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউ বলে দিয়েছিলেন, পদত্যাগের ভাবনা তাঁদের মাথায়ও নেই। কিন্তু ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই বার্সেলোনা সভাপতির ভাবনার জগতে ১৮০ ডিগ্রি বদল! কাল আবার বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে সভায় বসেছিলেন বার্তোমেউ। সভা শেষে জানিয়ে দিলেন, তিনি ও তাঁর বোর্ড সরে যাচ্ছেন বার্সেলোনার দায়িত্ব থেকে!

তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হওয়ার আগেই সরে গেলেন বার্তোমেউ। তাঁকে উৎখাত করতে বার্সেলোনার সমর্থকদের কয়েকটি গ্রুপ মিলে ‘মেস কো উনা মোসিও’ নামে এক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেটিতে প্রাথমিক সাফল্যও এসেছে। বার্সেলোনার সমর্থকদের মধ্যে থেকে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভোটে ঠিক হয়েছে, বার্তোমেউর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট হবে। সে ভোটে বার্সার নিবন্ধিত প্রায় দেড় লাখ সমর্থকের দুই-তৃতীয়াংশের ভোট তাঁর বিপক্ষে গেলে সরে যেতে হতো বার্তোমেউকে।

কিন্তু বার্তোমেউ সে ‘ভাগ্য পরীক্ষায়’ আর যাননি। বার্সা সভাপতি হিসেবে তাঁর ছয় বছরের বিতর্কিত অধ্যায়ের সমাপ্তি টেনে দিলেন।

সরে যাওয়ার কারণ হিসেবে অবশ্য সমর্থকদের নিরাপত্তার দিকটিকেই দেখিয়েছেন বার্তোমেউ। পদত্যাগের আগ মুহূর্ত পর্যন্তও বার্তোমেউ ও তাঁর বোর্ড চাইছিল, করোনাভাইরাসকে কারণ হিসেবে দেখিয়ে ভোট পিছিয়ে দিতে। এমনিতেই আগামী বছরের মার্চে বার্সেলোনার সভাপতি নির্বাচন নির্ধারিত হয়ে আছে, তার আগে ভোটের মুখোমুখি হতে চাননি বার্তোমেউ বোর্ড। কিন্তু কাতালান অঞ্চলের প্রশাসকেরা সেটিকে আমলে নেননি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে ভোট আয়োজনের নির্দেশনা দেয় কাতালান প্রশাসন।

কাল কাতালান প্রশাসনের সে সিদ্ধান্ত জানার পর আবার সভায় বসে বার্তোমেউ ও তাঁর বোর্ড। এরপরই পদত্যাগের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। যেটির আনুষ্ঠানিক কারণ হিসেবে দেখানো হয়, করোনার মধ্যে ভোট আয়োজন সমর্থকদের স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকির।

পাশাপাশি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে চেয়েছেন বলেও জানান বার্তোমেউ, ‘পরিস্থিতি শান্ত করতে মার্চে (সভাপতি) নির্বাচন ডেকেছিলাম আমরা। আর মার্চে যেহেতু নির্বাচন হচ্ছেই, এই অবস্থায় এত কাজ সামনে রেখে পদত্যাগ করার কোনো কারণই ছিল না আমাদের। এই দায়িত্বটা এড়াতে পারতাম না আমরা।’

শেষ দিকে বার্তোমেউর দায়িত্বের মধ্যে সবচেয়ে বড় ছিল ক্লাবে যে আর্থিক দুরবস্থা তৈরি করে দিয়ে গেছেন, সেটি কিছুটা ভদ্রস্থ করা। সে জন্য অবশ্য খেলোয়াড়দের বেতনে হাত দিয়েছিলেন বার্সা সভাপতি। দায়িত্ব ছাড়ার মুহূর্তেও সেটি মনে করিয়ে দিয়ে গেছেন বার্তোমেউ, ‘খরচ কমানো ও আয় বাড়ানোর আর্থিক দিকগুলো ঠিকঠাক না করেই পদত্যাগ করতে হচ্ছে আমাদের। আশা করি খেলোয়াড়দের বেতন সমন্বয় করার প্রক্রিয়াটা ঠিকঠাক শেষ করা হবে, তা না হলে (ক্লাবের আর্থিক পরিস্থিতি) খুবই সঙিন হয়ে পড়বে।’

ছয় বছরে নিজে যা ঠিকঠাকভাবে করেননি, যাওয়ার সময় সেটিই করার আহ্বান জানালেন আর কি! অবশ্য ছয় বছর তো বার্সার নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে, তার আগেও বার্সার দায়িত্বে ছিলেন বার্তোমেউ।

রিয়াল মাদ্রিদ সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের সঙ্গে আলাপে রত বার্তোমেউ। গত শনিবার রিয়ালের বিপক্ষে ম্যাচটিই ছিল বার্তোমেউর শেষ।
ছবি: এএফপি

২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত বার্সার সভাপতির দায়িত্ব পালন করা হোয়ান লাপোর্তার বোর্ডের একজন পরিচালক ছিলেন বার্তোমেউ। লাপোর্তার পর বার্সার সভাপতি হয়ে আসা সান্দ্রো রোসেলের ‘ডানহাত’ ছিলেন। নেইমারের দলবদলে কর ফাঁকি দেওয়াসহ নানা দুর্নীতির অভিযোগে ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে রোসেল পদত্যাগ করলে সে জায়গা অন্তর্বর্তীকালীন সভাপতি হয়ে আসেন বার্তোমেউ। ২০১৫ সালে সভাপতি নির্বাচনে জয়ী হয়ে চেয়ারটাতে বসেন পূর্ণ মর্যাদা নিয়েই।

সেই মর্যাদা কতটুকু রাখতে পেরেছেন, তা অবশ্য প্রশ্ন বটে! তাঁর সময়ে বার্সা একটি চ্যাম্পিয়নস লিগসহ চারবার লিগ জিতেছে বার্সা। কিন্তু মাঠে—বিশেষ করে চ্যাম্পিয়নস লিগে—দলের পারফরম্যান্স কয়েক বছর ধরেই পড়তির দিকে। দলের প্রয়োজন না বুঝে একের পর এক তারকার পেছনে ছুটে বার্সা বোর্ড নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোর চেষ্টা করে গেছে সব সময়। কিন্তু তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে মাঠে দলের পারফরম্যান্সে, পাশাপাশি বার্সার হিসাবের বইয়েও। একে তো রক্ষণ-মাঝমাঠে দৈন্যের মধ্যে আক্রমণে তারকার ঠাসাঠাসিতে দলটা হয়ে পড়েছে ভারসাম্যহীন, তার ওপর এত তারকার দলবদল মূল্য ও বেতনের বোঝায় বার্সার উদ্বৃত্তপত্রে পড়েছে টান। দেনার দায় বেড়েছে।

তার সঙ্গে যোগ হয়েছে বার্তোমেউর বোর্ডকে ঘিরে একের পর এক নেতিবাচক খবর। ইয়োহান ক্রুইফের মতো কিংবদন্তি তাঁর বোর্ডের সঙ্গে থাকেননি। মেসি-গার্দিওলা-পুয়োলদের মতো কিংবদন্তিদের বিরুদ্ধে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কুৎসা রটিয়ে তাঁর নিজের ‘ইমেজ’ ভালো করতে একটি প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগ ওঠে বার্তোমেউর বিরুদ্ধে। শেষ দিকে মেসির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বিষিয়ে উঠেছিল। কফিনে শেষ পেরেক হয়ে এসেছে গত আগস্টে ক্লাব ছাড়তে চেয়ে মেসির বুরোফ্যাক্স পাঠানো।

সব মিলিয়ে বিরক্ত বার্সা সমর্থকেরা বার্তোমেউর বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোট আয়োজনের পক্ষে ভোট দেয়। কিন্তু সে সুযোগ না দিয়েই সরে গেছেন বার্তোমেউ।