আজ তার বয়স ১৮ হলো

জিদানের জাদুকরি সেই ভলি। ছবি: ইউসিএল টুইটার পেজ
জিদানের জাদুকরি সেই ভলি। ছবি: ইউসিএল টুইটার পেজ

'ম্যাডলি বাঙালি' সিনেমার সেই সংলাপটি আক্ষরিকভাবে মনে নেই। মর্মার্থ ছিল এমন, সব মানুষের জীবনেই সুযোগ আসে। কারও ৭ বছর বয়সে কারও ৭০ বছর বয়সে।

সুযোগটা ‍দুহাতে লুফে নিতে পারছেন কি না সেটি বড় প্রশ্ন। ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তা পেরেছেন জিনেদিন জিদান। পেয়েছিলেন ২০০৬ বিশ্বকাপেও, বিজন অশ্রুমাখা সফলতা। সাধারণ জীবনে সুযোগ বার বার আসে না। জিদান অসাধারণ কেউ বলেই বার বার এসেছে। যেমন ২০০২ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল।

বলটা ভেসে থাকতেই ভলি করার ভাবনাটা এসেছিল জিদানের। ছবি: ইউসিএল টুইটার পেজ
বলটা ভেসে থাকতেই ভলি করার ভাবনাটা এসেছিল জিদানের। ছবি: ইউসিএল টুইটার পেজ

অনেকের মতেই, গ্লাসগোর সেই ফাইনালের ৪৫ মিনিটে ঐন্দ্রজালিক মুহূর্তটি জিদানের ক্যারিয়ারের সারাংশ। প্রতিভা ও লক্ষ্যের অপূর্ব সমণ্বয়। জিদান এরপর কখনো তার পুনরাবৃত্তি করতে পারেননি। ঠিক, এ কারণেই সুযোগের প্রসঙ্গ টানা। কিছু সুযোগ, কিছু মুহূর্ত মানুষের জীবনে একবারই আসে। সেটি অসাধারণ কেউ হলেও। পরে আর কখনো তার পুনরাবৃত্তি ঘটে না। পারা যায় না।

সেই ফাইনালের ১৪ বছর পর স্বীকারোক্তিটা দিয়েছিলেন জিদান নিজেই। রিয়াল মাদ্রিদের কোচ হয়েও চ্যাম্পিয়নস লিগ জয়ের পর বলেছিলেন কিংবদন্তি, 'পরে ঠিক ওভাবেই গোল করার চেষ্টা করেছি। এমনকি বিজ্ঞাপনের শুটিংয়েও চেষ্টা করেছি। অনুশীলনে খেটেছি, কিন্তু আর কখনো হয়নি। সেদিন ওই শট, ওই সময়, মুহূর্তটা ছিল “পারফেক্ট”।'

কোন দিন, কোন মুহূর্তের কথা বলা হচ্ছে এতক্ষণে ফুটবলপ্রেমীদের ধরে ফেলার কথা। রিয়াল মাদ্রিদ সমর্থক হলে তো কথাই নেই। সে যাই হোক, গৌরচন্দ্রিকা রেখে এবার আসল কথায় আসা যাক। 'তার' বয়স আজ ১৮ হলো!

এই 'সে' কেউ নয়। জিদানও না। এই 'সে' সেই গোলটা। লেভারকুসেন গোলরক্ষক হ্যান্স-জর্গ বাটের সবচেয়ে ভালো মনে থাকার কথা। জিদানের পা থেকে বলটা পিকাসোর তুলির টান হয়ে জাল ছোঁয়ার আগে যে সর্বশেষ তাঁকে দেখেছিল! হ্যান্স নিজেও নিশ্চয়ই এখনো দেখেন। দুঃস্বপ্ন!

গোলরক্ষকদের এই এক জ্বালা। গোটা বিশ্বের ফুটবলপ্রেমীদের কাছে যা আরাধ্য, গোলরক্ষকদের কাছে সেটাই নিষিদ্ধ; গোল। জিদান সেদিন বাঁ পায়ের ভলিতে এই আরাধ্য আর নিষিদ্ধকে নামিয়ে এনেছিলেন এক কাতারে।লেভারকুসেন ভক্তদের করতালি তার প্রমাণ। তবু বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞেস করুন রাউল গঞ্জালেসকে।সে ম্যাচে প্রথম গোলটা করা রিয়াল স্ট্রাইকার বলবেন, 'শুধু মাদ্রিদ সমর্থকেরাই নয়, যেকোনো ফুটবলপ্রেমীর চোখে লেগে থাকবে গোলটি।'

জুভেন্টাস থেকে রেকর্ড (৭৫ মিলিয়ন ইউরো) দামে রিয়ালে আসার পর সেটা ছিল জিদানের প্রথম মৌসুম। তার আগে বিশ্বকাপ, ইউরো জিতলেও চ্যাম্পিয়নস লিগ ছিল অধরা। জুভেন্টাসের হয়ে দুটি ফাইনাল খেলেও পারেননি। খিদেটা তাই ছিল। ওদিকে লেভারকুসেন ছিল সে মৌসুমে চমকে দেওয়া দল। জার্মান দলটি সেবারই প্রথমবারের উঠেছিল চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে।

ম্যাচের ১৫ মিনিটের মধ্যে ১-১ গোলে সমতায় চলে আসে দুই দল। ৮ মিনিটে রিয়ালকে রাউল এগিয়ে দিলেও ১৩ মিনিটে লেভারকুসেনকে সমতায় ফেরান লুসিও। এরপর 'এক পা এগোও তো দুই পা পেছাও' নীতিতে খেলেছে দুই দল। মনে হচ্ছিল প্রথমার্ধের শেষটা এমন ম্যাড়ম্যাড়েই কাটবে।

ভুল।

গোলের পর। জিদানের উল্লাস। লেভারকুসেন খেলোয়াড়দের মাথায় হাত। ছবি: টুইটার
গোলের পর। জিদানের উল্লাস। লেভারকুসেন খেলোয়াড়দের মাথায় হাত। ছবি: টুইটার

শুন্য সম্ভাবনা কিংবা মুহূর্ত থেকে অসাধারণ কিছু জন্ম দিতে পারেন কারা? এক কথায় জিদানরা। অসাধারণরাও বলা যেত, কিন্তু দুটো শব্দই সমার্থক! সেদিন তাই সবাই অনেকটা বিনা মেঘেই দেখেছিল ভয়ঙ্কর সুন্দর 'বজ্রপাত'!

অথচ শুরুটা ছিল শুনশান। ঘুর্ণাক্ষরেও কারও ভাবনায় ছিল না এমন কিছু ঘটতে যাচ্ছে। বলটা আকাশ থেকে নেমে আসার আগে জিদান নিজেও কি ভাবতে পেরেছিলেন? তাঁর সেই সময়ের সতীর্থ স্টিভ ম্যাকম্যানাম্যানের ভাষায়,' মুভটা তেমন কিছুই ছিল না। সোলারি লম্বা বল দিয়েছিল রবার্তো কার্লোসকে (যে পাস কার্লোসের ভাষায় খুব বাজে ছিল)। সে বলটা বাঁ পায়ের টোকায় তুলে দেয় ওপরে। এমন না যে জিজুকে দেখে এটা করেছিল। কিন্তু আসল ব্যাপারটা হলো স্টাইল, সবাই বলে তার বাঁ পা নাকি দুর্বল। কিন্তু ওই পায়েই নেওয়া তার শট এবং বলটা যেভাবে ঢুকেছে জালে, চোখ জুড়িয়ে দেয়।'

জিদানের সামনে বলটা ভেসে পড়ার সময় তাঁকে পায়ের নিশানা তাক করতে দেখেন সোলারি। তখনই বুঝে যান জিজু শটটা নেবেন, 'অবিশ্বাস্য। অনেক উঁচু থেকে বাঁ পায়ে বলটা নিয়েছে। এমন জিনিস জীবনে একবারই দেখা যায়।' ক্লাস টপমুলার;লেভারকুসেন কোচ বলে যান, 'দর্শকদের জন্য এটি চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের ইতিহাসে অন্যতম সেরা গোল। কিন্তু কৌশলগতভাবে এটা খুব কঠিন। জিদান বলেই সম্ভব হয়েছে।'

ইউটিউবে গোলটির ভিডিও আছে। দেখলে নিশ্চয়ই খেয়াল করবেন, রবার্তো কার্লোস বাঁ প্রান্ত থেকে বলটা বাতাসে ভাসিয়ে বক্সে ফেলার আগেই সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন জিদান। ব্রাজিলিয়ান ডিফেন্ডার তাঁকে উদ্দেশ করে ক্রসটা দেননি। স্রেফ বক্সে ফেলতে চেয়েছিলেন। কোথায় আসতে পারে জিদান যেন আগেই টের পেয়ে যান! এরপর সেই মাহেন্দ্রক্ষণ।

বলটা যখন নামছে জিদানও শট নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এরপর বাঁ পায়ের নিখুঁত ভলি। নিখুঁত বলার কারণ, জিদান যে উচ্চতা থেকে ভলি করেছেন তা সাধারণত দেখা যায় না। কারণ বলে বুটের সংযোগ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আরেকটু নিচু থেকে ভলি করে থাকেন সবাই। কিন্তু জিদানের ভলিটা ওই উচ্চতায়ই ছিল নিখুঁত টাইমিংয়ের। বলটা গোলার গতিতে আছড়ে পড়ে জালে।

জিদানের ব্যাখ্যা শুনলে আরও ভালোভাবে বোঝা যায়, 'এসব গোল পরিকল্পনা করে হয় না। সময়মতো প্রস্তুত থাকতে হয়। সঠিক উচ্চতায়, সঠিক অ্যাঙ্গেলে শটটা নিখুঁতভাবে নিতে পেরেছিলাম। আমার ক্যারিয়ারে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ‍ মুহূর্ত।'

সুযোগটা নিতে পেরেছিলেন বলেই ওই মুহূর্তটা জিদানের ক্যারিয়ারে সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে থাকবে। ভক্তদের জন্য তা স্মৃতির মণিকোঠায় এক চিলতে মুক্তো, এই ১৮ বছর বয়সেও যার ছটা ভিঞ্চির মোনালিসার মতো। এমনিতে দ্যূতিটা চোখে পড়বে না, ভালো করে দেখলে অসাধারণ, মানে জিদান!