মেসি-বার্সার সম্পর্ক আর এক বছরের, না তারও বেশি?

আপাতত ইচ্ছের বিরুদ্ধে মেসি থাকছেন বার্সেলোনায়। কিন্তু পরে কি তাঁর মন বদলাতে পারে?ছবি: টুইটার

কথাটা সংবাদমাধ্যমে এসেছে। তবে এ রকম কোনো আলাপচারিতা সত্যিই লিওনেল মেসি ও রোনাল্ড কোম্যানের মধ্যে হয়েছিল কি না, সেটি নিশ্চিত হওয়া কঠিন। মেসি-বার্সা মুখোমুখি অবস্থানে চলে যাওয়ার পর এ রকম কত গুঞ্জনই তো ছড়িয়েছে সংবাদমাধ্যমে।
কী সেই গুঞ্জন? বার্সেলোনার কোচ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর মেসির সঙ্গে প্রথম বৈঠকে নাকি কোম্যান বলেছেন, ‘দলে তোমার যে অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা ছিল, সেসব এখন থেকে শেষ। অন্য সবার মতোই তোমাকে থাকতে হবে, দলের কথা ভাবতে হবে।’ কথাগুলো হুবহু এ রকম ছিল কি না, সেটা জানার উপায় নেই। তবে স্প্যানিশ ও আর্জেন্টাইন কিছু সংবাদমাধ্যমের খবর ও বার্সেলোনা সংশ্লিষ্ট সাংবাদিকদের টুইটে এ রকমই একটা আলাপচারিতার কথা এসেছে। অনেকেই মনে করছেন, ওই বৈঠক মেসির বার্সেলোনার ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিতে অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিল।

যদি সত্যি-সত্যি এ রকম কোনো আলাপচারিতা হয়ে থাকে তাহলে কোম্যানের সঙ্গে মেসির আজ (সোমবার) আবার যে দেখা হওয়ার কথা, সেটার ওপর চোখ থাকবে সবার। স্প্যানিশ ক্রীড়া দৈনিক স্পোর্ত খবর দিয়েছে, গতকাল মেসি নিজের বাসা থেকেই কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়েছেন। যদি সেই পরীক্ষার ফল নেগেটিভ হয় (হবে বলেই আশা করা হচ্ছে), তাহলে আজ প্রথমবারের মতো কোম্যানের অধীনে অনুশীলনে যোগ দেবেন মেসি। আর অধিনায়ক প্রথমবারের মতো অনুশীলনে আসা মানে কোচের সঙ্গে কথাবার্তা তো হবেই। দুজনেই নিশ্চয়ই চাইবেন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে  নিজেদের সম্পর্কটা আরেকটু সহজ করে নিতে।

‘পরিবর্তিত পরিস্থিতি’ মানে মেসির বার্সেলোনাতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর আর কী! ইচ্ছের বিরুদ্ধে থাকতে হলেও মেসি জানেন, অন্তত আগামী এক বছর তাঁকে কোম্যানের অধীনেই খেলতে হবে। কোম্যানও শুরুতে যেটাই ভেবে থাকেন, এই এক বছর অন্তত মেসিকে ঘিরেই তাঁর দল পুনর্গঠনের পরিকল্পনা করবেন। সুতরাং সম্পর্ক সহজ করে নেওয়াই ভালো দুজনের জন্য।

কোম্যান কি অধিনায়ক হিসেবে রাখবেন মেসিকে, না কি অন্য কাউকে দায়িত্ব দেবেন?
ছবি: টুইটার

অথচ ব্যাপারটা এই পর্যায়ে যাওয়ারই কথা ছিল না। বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় দলে থাকা মানে যেকোনো কোচের জন্যই পরিকল্পনা করার কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাওয়ার কথা। মেসি অবশ্য গোল-এর সঙ্গে তাঁর বিখ্যাত সাক্ষাৎকারে সম্পর্ক সহজ করার একটা আভাস দিয়ে রেখেছেন। সেখানেই বলেছেন, বাধ্য হয়ে থাকতে হলেও দলের প্রতি তাঁর নিবেদন আগের মতোই থাকবে, সেরাটা দিয়েই লড়বেন দলের সাফল্যের জন্য। কোম্যান তো এটাই চান।

গোল-এর সঙ্গে মেসির আলোচিত সেই সাক্ষাৎকারটি দেখতে পারেন এখানে


কোম্যান নিজের দিক থেকে কতটা আন্তরিক, সেটি আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই বোঝা যাওয়ার কথা। মেসি বার্সেলোনার অধিনায়ক। কোম্যান তাঁর পুনর্গঠিত দলেও কি মেসিকেই অধিনায়ক হিসেবে রাখবেন? মেসির পাশাপাশি বার্সেলোনার দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ অধিনায়ক হিসেবে আছেন জেরার্ড পিকে, সার্জিও বুস্কেটস ও সার্জি রবার্তো। যদি মেসিকে অধিনায়কত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে অধিনায়কদের প্যানেলে চতুর্থজন হিসেবে প্রথম পছন্দ হওয়ার কথা মার্ক-আন্দ্রে টের স্টেগেন। তবে কোম্যান এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিলে সেটি মেসির প্রতি নেতিবাচক বার্তা হিসেবে যেতে পারে। আর এ রকম কোনো বার্তা গেলে এই মৌসুমটাই বার্সেলোনায় মেসির শেষ মৌসুম হয়ে যেতে পারে।

চুক্তি অনুযায়ী অবশ্য এটাই বার্সেলোনায় মেসির শেষ মৌসুম। তবে আপাতত যেহেতু মেসি বার্সায় থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অনেকেই মনে করছেন, এই থাকাটা আরও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে। সেটা অবশ্য নির্ভর করছে বেশ কিছু বিষয়ের ওপর। সেগুলো কী রকম, তাও একটু আলোচনা করা যাক—

জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউর পরে নতুন কোনো সভাপতি এলে কি সিদ্ধান্ত বদলাবেন মেসি?
ছবি: টুইটার

বার্সেলোনার পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচন
জোসেপ মারিয়া বার্তোমেউর নেতৃত্বাধীন বার্সেলোনার বর্তমান পরিচালনা পর্ষদের মেয়াদ শেষ হচ্ছে আগামী বছর মার্চে। ১৫ মার্চ নতুন সভাপতি পদে নির্বাচন হওয়ার কথা। বার্তোমেউ এবার সভাপতি পদে দাঁড়াচ্ছেন না, এটা মোটামুটি নিশ্চিত। তবে তাঁর মতাদর্শে বিশ্বাসী কেউ তো দাঁড়াবেন, থাকবে অন্য প্রতিপক্ষও। মেসির সঙ্গে বার্সেলোনার বর্তমান চুক্তি আগামী বছর জুন পর্যন্ত। তার মানে সেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই বার্সেলোনার দায়িত্ব নেবেন নতুন সভাপতি। আর সেই সভাপতি যদি নতুন কোনো পরিকল্পনা নিতে পারেন এবং তার সেই পরিকল্পনা যদি মেসির মনে ধরে, কে জানে তিনি থেকেও যেতে পারেন বার্সায়।

জাভির প্রত্যাবর্তন
এটিও কিছুটা বার্সেলোনার প্রশাসন পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্ত। কোম্যানের সঙ্গে বার্সেলোনার চুক্তি দুই বছরের। তবে কোচদের এই চুক্তি আসলে শুধু কাগজে-কলমে। দল খারাপ খেললে কোচ বরখাস্ত হয়ে যেতে সময় লাগে না। কোম্যান যদি এই বার্সেলোনাকে নিয়ে দারুণ কিছু করে দেখাতে পারেন, তাহলে তো ভালোই। আর না পারলে মনে হয় না বার্সা তাঁকে চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়া পর্যন্ত রাখবে।

বন্ধু জাভি কোচ হয়ে ফিরলে হয়তো পাল্টাতে পারে মেসির সিদ্ধান্ত।
ছবি: টুইটার

আর্নেস্তো ভালভার্দেকে বরখাস্ত করার পরই বার্সা বোর্ড ক্লাব কিংবদন্তি জাভিকে কোচ করে আনতে চেয়েছিল। কিন্তু জাভি সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন। তবে মেসি মনে করেন, বার্সার নতুন করে শুরুর জন্য জাভি কোচ হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবেন। তাই এক সময়ের সতীর্থ জাভি বার্সেলোনায় কোচ হয়ে ফিরলে মেসিও থাকা-না থাকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারেন।

পরিবার

গোল-এর সাক্ষাৎকারে মেসি গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলেছেন। তিনি যখন বার্সেলোনা ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁর পরিবারকে জানিয়েছিলেন, সেটা এক হৃদয়বিদারক পরিস্থিতি তৈরি করেছিল। ১২ বছর বয়স থেকে মেসি নিজে বার্সেলোনায় আছেন, এই ক্লাবই শুধু নয়, শহরটাও তাঁর জীবনের সঙ্গে মিশে গেছে। সেখানেই তিনি সংসার পেতেছেন, সন্তানেরা জন্মেছে।

মেসির বার্সেলোনায় থাকা না থাকার সিদ্ধান্তে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিতে পারে তাঁর পরিবার।
ছবি: টুইটার

বার্সেলোনায় মেসির তিনটা বাড়ি, যার একটিতে মেসি থাকেন, একটিতে তাঁর বাবা-মাসহ বৃহত্তর পরিবার। অন্যটা পারিবারিক দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হয়। মেসির সন্তানেরা বার্সেলোনার স্কুলে পড়ে, সেখানেই তাঁদের বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে অনেকের সঙ্গে। মেসিই বলেছেন, সবকিছু ছেড়ে অন্য কোথাও যেতে হবে শুনে তাঁর বাচ্চারা কেঁদেছে, স্ত্রী মন খারাপ করেছেন। আরও একবার এ রকম কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে তাই মেসি এই বিষয়টা খুব বেশি ভাববেন। বার্সায় থাকা-না থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে তাই মেসির পরিবারের সবচেয়ে বড় ভূমিকা থাকবে।

এই ঘটনার পরও যদি মেসি আগামী জুনে বার্সায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি হবে এক বছর মেয়াদি এবং সেই চুক্তিতে কোনো “বাই আউট ক্লজ” তিনি রাখতে চাইবেন না।

এ সবকিছুর পরেও যদি মেসি বার্সেলোনা ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে বুঝতে হবে, আসলেই এই ক্লাবে তিনি আর দেওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে করছেন না।

বার্সার সঙ্গে বর্তমান চুক্তিটা জুনে শেষ হলেও জানুয়ারি থেকেই বিভিন্ন ক্লাবের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে পারবেন মেসি, কথাবার্তা বলতে পারবেন আগ্রহী ক্লাবগুলোর সঙ্গে। ওই সময় হয়তো একটা আভাস পাওয়া যাবে, কী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছেন মেসি। তবে বিবিসির বিখ্যাত ফুটবল সাংবাদিক ও লেখক গিয়েম বালাগ সম্প্রতি তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে মেসির সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারটি পুরো বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ‘আমার মনে হয় না, মেসি-বার্সা লড়াই মেসির ক্লাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেওয়াতেই শেষ হয়ে গেছে। এই ঘটনার পরও যদি মেসি আগামী জুনে বার্সায় থাকার সিদ্ধান্ত নেয়, সেটি হবে এক বছর মেয়াদি এবং সেই চুক্তিতে কোনো “বাই আউট ক্লজ” সে রাখতে চাইবে না।’
আসলে কী হয়, সেটা শুধু ভবিষ্যৎই বলতে পারে!