আর্জেন্টিনা দলে মেসির সঙ্গে নামছেন কারা?

অনুশীলনে মার্তিনেজের সঙ্গে মগ্ন মেসি।ছবি: টুইটার

আর্জেন্টিনা দল সর্বশেষ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেছে কত দিন আগে, সেটির হিসেবটা একটু অবিশ্বাস্যই লাগতে পারে এখন। করোনাভাইরাসে থেমে থাকা বিশ্বে জাতীয় দলগুলোর সবই অনেক দিন মাঠের বাইরে ছিল, কিন্তু সে তো মার্চ থেকে। আর্জেন্টিনা জাতীয় দল প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ থেকে বাইরে ৪৬০ দিন ধরে! এক বছরেরও বেশি সময়!

সেই যে গত বছর ব্রাজিলে কোপা আমেরিকার তৃতীয় স্থান নির্ধারণী ম্যাচটাতে খেলেছিল, লিওনেল মেসির লাল কার্ড দেখার সেই ম্যাচের পর আর প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে নামা হয়নি আর্জেন্টিনার। প্রতিযোগিতামূলক দূরে থাক, প্রীতি ম্যাচও সর্বশেষ খেলেছে গত নভেম্বরে, উরুগুয়ের বিপক্ষে। মার্চেই বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে নামার কথা ছিল, কিন্তু করোনা এসে তো তখন সব থামিয়েই দিল!

অবশেষে খুলছে গেরো, আর্জেন্টিনা নামছে মাঠে। বাংলাদেশ সময় আগামীকাল ভোর ৬.৩০ মিনিটে ইকুয়েডরের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে শুরু হচ্ছে আর্জেন্টিনার ২০২২ বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। আর্জেন্টিনার সবচেয়ে বিখ্যাত দুই মাঠের একটি—বোকা জুনিয়র্সের লা বোমবোনেরাতে হতে যাওয়া সেই ম্যাচে আর্জেন্টিনার একাদশে কারা থাকছেন? কোন ছকে দল সাজাবেন আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি?
মার্চে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও করোনার কারণে তিন দফা পিছিয়ে অবশেষে বাংলাদেশ সময় আজ ভোর থেকে শুরু হচ্ছে দক্ষিণ আমেরিকা অঞ্চলের (কনমেবল) বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব। প্রথম দিনে নেইমারের ব্রাজিল মাঠে নামছে না, তবে লুইস সুয়ারেজের উরুগুয়ে ও মেসির আর্জেন্টিনাকে দেখা যাবে কাল ভোরেই। নিজেদের মাঠে উরুগুয়ের ম্যাচটাও কঠিনই, নিজেদের মাঠে চিলির বিপক্ষে। অন্য ম্যাচে প্যারাগুয়ের মাঠে যাচ্ছে পেরু।

কিন্তু মেসি আর আর্জেন্টিনা বলেই বেশি নজর থাকছে আর্জেন্টিনা-ইকুয়েডর ম্যাচে। ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্বের প্রথম ও শেষ ম্যাচেও এই ইকুয়েডরের বিপক্ষেই খেলেছিল আর্জেন্টিনা। প্রথম ম্যাচে চোটের কারণে মেসি ছিলেন না, রিভার প্লেটের মাঠ এস্তাদিও মনুমেন্তালে আর্জেন্টিনা হেরেছিল ২-০ গোলে। আর বাছাইপর্বের শেষ ম্যাচ? আর্জেন্টিনার জার্সিতে মেসির তর্কসাপেক্ষে সেরা পারফরম্যান্সই ছিল সেটি। রাশিয়া বিশ্বকাপে যেতে আর্জেন্টিনাকে জিততেই হতো—ইকুয়েডরে এমন ম্যাচে প্রথম মিনিটেই পিছিয়ে পড়ে আর্জেন্টিনা। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিন হাজার মিটার উচ্চতার সেই স্টেডিয়ামে কঠিনতম চ্যালেঞ্জের মুখেই দারুণ হ্যাটট্রিক করেন মেসি, আর্জেন্টিনা ৩-১ গোলে জিতে টিকিট কাটে রাশিয়ার।

ছবি: ওলে

সেই ইকুয়েডর, আরেকটি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব। ইকুয়েডরের কোচও এবার আর্জেন্টাইনই—গুস্তাভো আলফারো। সেই ইকুয়েডরের বিপক্ষে ম্যাচে কোন ছকে নামবে কাল আর্জেন্টিনা?

দলের প্রাণভোমরা যেকোনো সময়ের মতো যে মেসিই থাকছেন, তা তো আর বলে দিতে হয় না! তর্কসাপেক্ষে সময়ের—অনেকের চোখে সর্বকালেরও—সেরা ফুটবলারকে ঘিরেই দল সাজাচ্ছেন আর্জেন্টিনা কোচ। তবে গত কয়েক বছরের আর্জেন্টাইন কোচদের সঙ্গে বর্তমান কোচ স্কালোনির পার্থক্য, শুধু মেসির ওপরই নির্ভরশীল না করে দলটাকে একটা ‘দল’ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। ২০১৮ বিশ্বকাপের ব্যর্থতার পর দলের পুরোনো অনেক তারকাকে বাইরে রেখে তরুণদের সুযোগও দিয়েছেন স্কালোনি। এই ম্যাচেও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না।

চোট অবশ্য কিছু বদল আনতে বাধ্য করছে স্কালোনিকে। মিডফিল্ডার জিওভান্নি লো সেলসো চোটে। ২০১৯ কোপা আমেরিকায় খেলা রাইটব্যাক রেনসো সারাভিয়া ও সেন্টারব্যাক জেরমান পেৎসেয়াও চোটে। রক্ষণে তাই নতুন দুই মুখকে দেখা যাবে। আর্জেন্টাইন বিখ্যাত দুই পত্রিকা ওলে আর টিওয়াইসি স্পোর্ত বলছে, রাইটব্যাক হিসেবে খেলবেন রিভার প্লেটের ২৩ বছর বয়সী গনসালো মন্তিয়েল। আর সেন্টারব্যাক হিসেবে ২৪ বছর বয়সী লুকাস মার্তিনেজ কুয়ার্তা, তিন দিন আগে শেষ ইউরোপিয়ান দলবদল মৌসুমের শেষ দিনে যিনি রিভার প্লেট ছেড়ে যোগ দিয়েছেন ইতালির ক্লাব ফিওরেন্তিনায়। এই দুজনের সঙ্গে রক্ষণে থাকছে পুরোনো দুটি নামই—কদিন আগে ম্যানচেস্টার সিটি ছেড়ে বেনফিকায় যাওয়া সেন্টারব্যাক নিকোলাস ওতামেন্দি ও লেফটব্যাক নিকোলাস তাগলিয়াফিকো।

আর্জেন্টিনার দুটি পজিশন নিয়েই এখন যত ভাবনা। এক, গোলপোস্টে কে খেলবেন? দুই, মাঝমাঠে লো সেলসোর জায়গা কে নেবেন?

মাঝমাঠে অন্য দুটি জায়গা মোটামুটি নিশ্চিত। সেন্ট্রাল ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে থাকছেন পিএসজির লিয়ান্দ্রো পারেদেস, তাঁর সঙ্গে উদিনেসের রদ্রিগো দে পল। আক্রমণে মেসির সঙ্গে স্ট্রাইকার হিসেবে ইন্টার মিলানের লওতারো মার্তিনেজের থাকা তো নিশ্চিতই, এ দুজনের সঙ্গে সেভিয়ার জার্সিতে দুর্দান্ত ফর্মে থাকা ফরোয়ার্ড লুকাস ওকাম্পোস থাকছেন বলেও জানাচ্ছে ওলে ও টিওয়াইসি স্পোর্ত। ওকাম্পোস থাকা মানে গতি আর কারিকুরির পাশাপাশি বক্সে উচ্চতার সুবিধাও মিলবে।

বাকি থাকে শুধু গোলকিপার আর মাঝমাঠের একটি পজিশন। সেখানে প্রতিটি জায়গা নিয়েই লড়াইটা দুজনের মধ্যে। এ নিয়ে ওলে ও টিওয়াইসি স্পোর্তের মতামত দুরকম। ওলে জানাচ্ছে, গোলকিপার হিসেবে থাকার দৌড়ে আছেন অ্যাস্টন ভিলার এমিলিয়ানো মার্তিনেজ ও এস্তেবান আনদ্রাদা। তবে টিওয়াইসি জানাচ্ছে, গোলকিপার হিসেবে থাকছেন মার্তিনেজই। বুধবার দলের অনুশীলনে মার্তিনেজকেই মূল গোলকিপার হিসেবে খেলিয়েছেন স্কালোনি। কিন্তু শেষ মুহূর্তে জানা যাচ্ছে ফ্রাঙ্কো আরমানিই থাকবেন গোলবারে।

এ ছকেই নামার সম্ভাবনা বেশি।

আর মাঝমাঠে দে পল ও পারেদেসের সঙ্গে কাকে খেলাবেন? সেখানেও দুজনের মধ্যেই চলছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা—সেভিয়ার মার্কোস আকুনিয়া, যিনি মূলত লেফট মিডফিল্ডার বা লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলেন। খেলতে পারেন লেফটব্যাক হিসেবেও। তাঁকে মাঝমাঠের তিনজনের বাঁ পাশেও খেলাতে পারেন স্কালোনি। দৌড়ে তাঁর সঙ্গে আছেন বায়ার লেভারকুসেনের এজেকিয়েল পালাসিওস। এখানেও ওলে আর টিওয়াইসি স্পোর্তের মতের ভিন্নতা আছে। ওলে বলছে, এখানে আকুনিয়ার থাকা নিশ্চিত। টিওয়াইসি স্পোর্ত জানাচ্ছে, দৌড়ে দুজনই আছেন, তবে বুধবার সর্বশেষ অনুশীলনে সেখানে আকুনিয়াই খেলেছেন।

একাদশ ঠিক হয়ে গেলে প্রশ্ন আসে ছকের। কোন ছকে খেলবে আর্জেন্টিনা? স্কালোনির অধীনে মূলত ৪-৩-৩ ছকেই খেলেছে আর্জেন্টিনা। তবে স্কালোনি পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করেছেন অনেক। কাল ৪-৩-৩ ছকেও খেলতে পারে আর্জেন্টিনা, সে ক্ষেত্রে মেসি প্রথাগতভাবে ডান উইং থেকে ঢুকবেন ভেতরের দিকে, ওকাম্পোস থাকবেন আক্রমণের বাঁ দিকে। মাঝে মার্তিনেজ। কিন্তু এই ছকে খেলতে গেলে মাঝমাঠের তিনে আকুনিয়ার চেয়ে পালাসিওসই বেশি মানানসই হতে পারেন। অবশ্য কোপা আমেরিকাতেও আকুনিয়াকে মাঝমাঠের তিনে রেখেই খেলিয়েছেন আর্জেন্টিনা কোচ।
আকুনিয়া খেলবেন বলেই অনেকের ধারণা, হয়তো ছক বদলে ৪-৪-১-১ ছকে যাবে আর্জেন্টিনা। সে ক্ষেত্রে মাঝমাঠের এক প্রান্তে থাকবেন আকুনিয়া, অন্য প্রান্তে ওকাম্পোস। মূল স্ট্রাইকার লওতারো মার্তিনেজ, তাঁর পেছনে স্বাধীন ভূমিকায় মেসি। এতে রক্ষণ সুবিধা পাবে আর্জেন্টিনা, তবে আক্রমণে কিছুটা ভুগতে হতে পারে। রক্ষণ সামলে আকুনিয়া-ওকাম্পোসরা কত দ্রুত ওপরে উঠতে পারেন, সেটির ওপর নির্ভর করবে আর্জেন্টিনার আক্রমণের ধার।

অনুশীলনে দিবালা, দে পল ও পারেদেসের সঙ্গে হাস্যরসে মগ্ন মেসি।
ছবি: ওলে

তবে দুদিন আগে আর্জেন্টিনা কোচ স্কালোনি বলেছিলেন, তাঁরা মেসিকে এমন জায়গায় খেলাতে চান, যেন তাঁর সামনে দুজন খেলোয়াড় থাকেন। তাতে সুবিধাটা হলো, মেসির দেওয়া রক্ষণচেরা থ্রু ধরে গোলমুখে এগিয়ে যাওয়ার দায়িত্বটা শুধু মার্তিনেজের একার ওপর পড়বে না। গোলের সম্ভাবনা বাড়বে। সে কারণেই আর্জেন্টিনাকে ৪-৩-১-২ বা ৪-১-২-১-২ ছকে দেখার সম্ভাবনা বেশি মনে হচ্ছে। মাঝমাঠে পারেদেস-দে পল-আকুনিয়া, তাঁদের সামনে স্বাধীন ‘প্লেমেকার’-এর ভূমিকায় মেসি। তাঁর সামনে জুটি বাঁধবেন মার্তিনেজ ও ওকাম্পোস।

তা আর্জেন্টিনার প্রতিপক্ষ কীভাবে দল সাজাবে? ওলে জানাচ্ছে, ইকুয়েডর খেলে ৪-৩-২-১ ছকে। সবার সামনে থাকবেন ২০১৪ বিশ্বকাপে নাম কুড়ানো স্ট্রাইকার এনার ভ্যালেন্সিয়া। ওই বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ডের ওয়েস্ট হাম, এভারটনের মতো ক্লাবে খেলেছেন, এখন তাঁর ঠিকানা তুরস্কের ফেনেরবাচে। তাঁর পেছনে দুই উইঙ্গার রেনাতো ইবারা ও আনহেল মেনা। তাঁদের পেছনে মাঝমাঠের তিনে সেবাস্তিয়ান মেন্দেজ, মইসেস কাইসেদো ও ইয়োর্দি আলসিভার। রক্ষণে চারজন—পেরভিস এস্তুপিনিয়ান, রবার্ত আরবোলেদা, ফ্রাঙ্কলিন গেরা ও এরিক ফেরিগ্রা। আর গোলকিপার আলেক্সান্দার দমিঙ্গেজ।