আর্জেন্টিনাকে বোকা বানিয়ে ট্রফি নিয়ে যাচ্ছে ব্রাজিল

বোকা জুনিয়র্সের জালে গোলের পর সান্তোসের উইঙ্গার ইয়েফারসন সতেলদোছবি: এএফপি

কোপা লিবার্তাদোরেসের সেমিফাইনাল লাইনআপ নিশ্চিত হওয়ার পর সম্ভাবনা ছিল তিনটি। হয় ফাইনালটা ‘অল ব্রাজিলিয়ান’ হবে, নতুবা ‘অল আর্জেন্টাইন’, আর তা-ও না হলে ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার ক্লাব।

অল ব্রাজিলিয়ান বা অল আর্জেন্টাইন ম্যাচেরও আবার আলাদা আকর্ষণ ছিল। আর্জেন্টিনার ক্লাব দুটি ছিল বুয়েনস এইরেস শহরেরই দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী বোকা জুনিয়র্স ও রিভার প্লেট। আর ব্রাজিলের ক্লাব দুটি সাও পাওলো শহরের ‘ডার্বি’র দুই প্রতিপক্ষ পালমেইরাস ও সান্তোস!

আগের দিন সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে ভিএআরের বিতর্কিত কয়েকটি সিদ্ধান্তে রিভার প্লেটকে কোনোরকমে হারিয়ে দক্ষিণ আমেরিকার ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বসূচক টুর্নামেন্টটির (দক্ষিণ আমেরিকার চ্যাম্পিয়নস লিগ) ফাইনালে ওঠে পালমেইরাস।

এরপর সম্ভাবনা তিনটি থেকে নেমে আসে দুটিতে। হয় ফাইনালটা ‘অল ব্রাজিলিয়ান’ হবে, নতুবা ব্রাজিল বনাম আর্জেন্টিনার ক্লাব। প্রথমটিই হলো। নিশ্চিত হলো, আর্জেন্টাইনদের দর্শক বানিয়ে লাতিন ক্লাব ফুটবলের শ্রেষ্ঠত্বের ট্রফি নিয়ে যাচ্ছে ব্রাজিলিয়ানরা।

আগের দিন আর্জেন্টাইনদের যদি হারের পেছনে রেফারিংয়ের দায় নিয়ে কোনো ক্ষোভ থেকেও থাকে, আজ আর সেটির সুযোগ দিল না ব্রাজিলিয়ানরা।

বাংলাদেশ সময় ভোরে নিজেদের মাঠে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে ডিয়েগো ম্যারাডোনার ক্লাব বোকা জুনিয়র্সকে ৩-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছে পেলের সাবেক ক্লাব সান্তোস। ২০১১ সালে সর্বশেষ নেইমারের হাত ধরে লাতিন অঞ্চলের সেরা হয়েছিল সান্তোস।

গত সপ্তাহে ব্রাজিলের দুই ক্লাব গিয়েছিল আর্জেন্টিনায়। সেখানে পালমেইরাস ধসিয়ে দিয়েছিল রিভার প্লেটকে, ৩-০ গোলে জিতেছিল রিভারের মাঠে। আর সান্তোস গোলশূন্য ড্র করেছিল বোকার মাঠে।

এই সপ্তাহে আর্জেন্টিনার দুই ক্লাব এসেছে ব্রাজিলিয়ানদের মাঠে। এবার পুরোপুরি উল্টো গল্প। রিভার প্লেট দাপুটে ফুটবল খেলে পালমেইরাসকে হারিয়েছে ২-০ গোলে, ভিএআরের কয়েকটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত (গোল বাতিল, পেনাল্টি না দেওয়া, লাল কার্ড দেখানো) রিভারের বিপক্ষে যাওয়ায় আর জেতা হয়নি মার্সেলো গায়ার্দোর দলের।

আর কাল সান্তোসের মাঠে বোকা জুনিয়র্সকে ‘বোকা’ বানিয়েছেন পেলে-নেইমারের উত্তরসূরিরা।

প্রথম মিনিটেই সান্তোসের শট পোস্টে লাগায় বেঁচে যায় বোকা। কিন্তু বেঁচে যাওয়ার স্বস্তিটা ক্ষণিকের। ১৫ মিনিট যেতে না যেতেই দারুণ দাপটে শুরু করা সান্তোস এগিয়ে গেল।

উপস্থিত বুদ্ধির দারুণ প্রয়োগেই গোলটা করেছেন সান্তোসের ব্রাজিলিয়ান মিডফিল্ডার দিয়েগো পিতুকা। বোকার বক্সে এক ডিফেন্ডারের গায়ে হাত লাগায় পেনাল্টির আবেদন করে ওঠেন সান্তোসের খেলোয়াড়েরা।

রেফারির কোনো সিদ্ধান্ত তখনো আসেনি, এদিকে বোকার খেলোয়াড়েরা হতবুদ্ধি হয়ে মনোযোগটাই হারিয়ে ফেললেন! কিন্তু পিতুকা সুযোগটা ছাড়েননি। রেফারির সিদ্ধান্ত যেহেতু আসেইনি, বোকার খেলোয়াড়দের অনবধানতার সুযোগে বলটা জালে জড়িয়ে দেন পিতুকা।

‘রেফারির বাঁশি না বাজা পর্যন্ত খেলা বন্ধ করতে নেই’—ফুটবলীয় নীতিকথাটা আরেকবার চড়া মূল্যেই বোকা জুনিয়র্স ডিফেন্ডারদের শেখাল সান্তোস। এরপর পুরোটা সময়েই সান্তোসের আক্রমণ। কখনো সান্তোসের এক খেলোয়াড়ের শট যায় বার উঁচিয়ে, তো কখনো ঠেকিয়ে দেন বোকার আর্জেন্টাইন গোলকিপার এস্তেবান আনদ্রাদা।

দ্বিতীয়ার্ধের চতুর্থ মিনিটে আর ঠেকাতে পারেননি। বাঁ দিক থেকে ঢুকে দারুণ শটে যখন বল জালে জড়ান সান্তোসের ভেনেজুয়েলান উইঙ্গার ইয়েফারসন সতেলদো, আনদ্রাদার কিছুই করার ছিল না। দুই মিনিট পরই আবার উল্লাস ব্রাজিলিয়ানদের।

এবার গোল লুকাস ব্রাগার, তবে মূল কৃতিত্ব উইঙ্গার মারিনিওর। ডান দিক থেকে ঢুকে মারিনিও দারুণভাবে দুজন ডিফেন্ডারকে এড়িয়ে বাইলাইন থেকে বলটা পেছনে বক্সের ভেতরের দিকে ঠেলে দেন, পোস্টের ৬-৭ গজ দূর থেকে বল জালে জড়ান ব্রাগা।

বোকার রাতটা দুঃস্বপ্নের থেকে দুঃসহ হয়ে যায় তার পাঁচ মিনিট পর। এভাবে একের পর এক গোল খেতে খেতে মেজাজ হারিয়েই কিনা, বোকার লেফটব্যাক ফ্রাঙ্ক ফাবরা দৃষ্টিকটুভাবে মাড়িয়ে দেন সতেলদোর পেটে। ফল, সরাসরি লাল কার্ড।

মজার ব্যাপার, ১০ জন হয়ে যাওয়ার পরই বলের দখল, পাসিং আরও ভালো হয়েছে বোকার। কিন্তু অতটুকুই, গোলের সুযোগ সেভাবে আর তৈরি করতে পারেনি। সে কারণে ম্যাচের পরিসংখ্যান বলবে, বলের দখল ৫৫ শতাংশ ছিল বোকার।

কিন্তু সব মিলিয়ে ম্যাচে মাত্র ৮টা শট নিয়েছে আর্জেন্টাইন ক্লাবটি, প্রতিপক্ষ গোলপোস্টে রাখতে পেরেছে মাত্র একটি। উল্টো দিকে সান্তোস? শট নিয়েছে ২০টি! পোস্টে ৮টি!

নেইমারের সৌজন্যে ২০১১ সালে কোপা লিবার্তাদোরেস জেতা সান্তোস তো ১০ বছর পরই আবার শিরোপার ঘ্রাণ পাচ্ছে, পালমেইরাসের জন্য ফাইনালে ওঠা অবশ্য আরও বেশি আবেগের। ১৯৯৯ সালের পর যে এই লাতিন ক্লাব শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতিসূচক এই টুর্নামেন্ট আর জেতা হয়নি পালমেইরাসের।

করোনাভাইরাসের কারণে ২০২০ সালের কোপা লিবার্তাদোরেসই এবার পিছিয়ে এখন শেষ হচ্ছে, তাতে ২০১৬ সালের পর এই প্রথম কোনো ফাইনাল হচ্ছে কোনো আর্জেন্টাইন ক্লাবকে ছাড়া। ব্রাজিলিয়ানদের অবশ্য তা নিয়ে ভাবতে বয়েই গেছে!

৩০ জানুয়ারি ফাইনালটা এমনিতেই ব্রাজিলিয়ানদের জন্য আনন্দের উপলক্ষ, তাতে বাড়তি আকর্ষণ আছে আরেকটি। ফাইনালটা যে ব্রাজিলের রিওতে বিখ্যাত স্টেডিয়াম মারাকানায়!