আর্জেন্টিনার রত্ন এখন খসখসে পাথর

আর্জেন্টিনার জার্সিতে দিবালা এখনো একেবারে প্রতিষ্ঠিত তারকা নন।
ছবি: এএফপি

পাওলো দিবালা সর্বশেষ কবে মাঠে নেমেছেন?

ফুটবলবিষয়ক ভালো একটা কুইজ হতে পারে এটি। দিন-তারিখ হিসাব করলে উত্তরটা হবে ১০ জানুয়ারি, লিগে সাসসুয়োলোর বিপক্ষে ম্যাচে সর্বশেষ খেলতে নেমেছিলেন ২৭ বছর বয়সী আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ড। কিন্তু গত মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগের শেষ ষোলোতে জুভেন্টাস বাদ পড়ার দিনে চোট নিয়ে মাঠ ছাড়ার পর থেকে যে অনিয়মিত হয়ে পড়েছেন দিবালা, মাঠে কখন থাকেন আর কখন পড়েন চোটে, সেই হিসাব রাখতে রীতিমতো মাইক্রোসফট এক্সেলে আলাদা শিট খুলতে হয়!

একসময় যাঁকে আর্জেন্টিনার জার্সিতে লিওনেল মেসির পাশে আরেক মহাতারকা ভাবা হচ্ছিল, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জুভেন্টাসে যাওয়ার পর ক্লাবে যাঁর সঙ্গে রোনালদোর জুটি নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিল ইতালিয়ান ক্লাবটি, সেই দিবালা কি ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছেন?

সেই পালের্মোতে খেলার সময় থেকে মাঠে রত্নের মতো আলো ছড়াতেন, যে কারণে তাঁর ডাকনামই হয়ে গিয়েছিল ‘লা জয়া’ বা রত্ন। প্রশাসনিক, আর্থিক জটিলতায় পালের্মো এখন ইতালিয়ান ক্লাব ফুটবলে বিস্মৃত এক নাম, দিবালারও কি সেই দশাই হচ্ছে? আর্জেন্টিনার রত্ন যে এখন খসখসে পাথরের মতো, আলো তো নেই-ই, তাঁর স্পর্শে ফুটবল প্রাণ পাওয়ার খবরও অনেক দিন আসে না।

২০১৮ সালে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো জুভেন্টাসে যাওয়ার পর মেসি-রোনালদো দ্বৈরথেও নতুন একটা সুতো পেয়ে গিয়েছিলেন দুজনের ভক্তরা। মেসির কারণে আর্জেন্টিনায় দিবালা খেলতে পারেন না বলে ফোড়ন কাটেন রোনালদো–ভক্তরা, রোনালদো জুভেন্টাসে যাওয়ার পর তাই তাঁদের যুক্তি ছিল, এমন প্রতিভাবান একজনকে পাশে নিয়ে খেলাতে মেসিকে পেছনে ফেলবেন রোনালদো।

মেসি–ভক্তরাও ছেড়ে কথা বলবেন কেন! যদিও মেসি-রোনালদো দ্বৈরথে যুক্তির গুরুত্ব আবেগের কাছে হার মানে বারবার, তবু তাঁরা তুলে ধরেন অকাট্য যুক্তি। কার্যকারিতায় অনেক ব্যবধান থাকলেও মেসি আর দিবালার খেলার ধরন অনেকটা একই, মাঠে দুজন প্রায় একই জায়গা দখল করেন। যে কারণে আর্জেন্টিনার জার্সিতে দুজনকে একসঙ্গে খেলাতে হিমশিম খেতে হয়েছে প্রায় সব আর্জেন্টাইন কোচকেই।

রোনালদোর সঙ্গে তো সে ঝামেলা নেই। রোনালদোর পাশে দিবালা ভালো খেললে সে কারণে এখানে মেসিকে টেনে আনা অপ্রাসঙ্গিক, এমনই যুক্তি ছিল মেসি–ভক্তদের।

কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, রোনালদোর পাশেও আলো ছড়াতে ব্যর্থ দিবালা! ফুটবল শুধু গোল করা আর করানোর পরিসংখ্যান দিয়ে বুঝতে যাওয়া অনেক বড় ভুল, তবু সেটি একটা মানদণ্ড তো বোঝায়! আর সে মানদণ্ড বলছে, রোনালদো যাওয়ার পর জুভেন্টাসে ক্রমশই পিছিয়ে গেছেন দিবালা।

এই মৌসুমের পরিসংখ্যান দেখুন। এখন পর্যন্ত মৌসুমে ১৬ ম্যাচ খেলেছেন দিবালা, এর মধ্যে ৬টিতেই নেমেছেন বদলি হিসেবে। তাতে গোল মাত্র ৩টি, করিয়েছেন ২টি। গত মৌসুমে অবশ্য ভালোই খেলেছিলেন। ৪১ ম্যাচে গোল করেছেন ১৪টি, করিয়েছেন আরও ৮টি। রোনালদোকে টপকে ইতালিয়ান লিগের সেরা ফুটবলারের পুরস্কারও তাই এসেছে। তবে রোনালদো জুভেন্টাসে যাওয়ার পর প্রথম মৌসুমেও দিবালা ছিলেন অনুজ্জ্বল। ৩৯ ম্যাচে ১০ গোল, ৪ অ্যাসিস্ট।

কাকতাল ভাবতে পারেন, চোটের ধাক্কাটা রোনালদো জুভেন্টাসে যাওয়ার পর থেকেই বেশি। এ পর্যন্ত রোনালদো যাওয়ার পরের তিন মৌসুমে চোটের কারণে ২০৩ দিন মাঠের বাইরে ছিলেন দিবালা!

রোনালদো যাওয়ার আগের পারফরম্যান্স যদি তুলনা করে দেখতে চান? ফুটবলের পারফরম্যান্সের হিসাব রাখায় বিশ্বস্ত ওয়েবসাইট হুস্কোরডের হিসাব বলছে, রোনালদো জুভে যাওয়ার ঠিক আগের মৌসুম, অর্থাৎ ২০১৭–১৮ মৌসুমেই ৪১ ম্যাচে ২৩ গোল করেছিলেন দিবালা, সতীর্থদের দিয়ে করিয়েছেন আরও ৫টি।

রোনালদো যাওয়ার আগের যে তিন মৌসুম খেলেছেন জুভেন্টাসে, তাতে ১২৪ ম্যাচে তাঁর গোল ৫৮টি, করিয়েছেন ২১টি। অর্থাৎ গোল করা ও করানো মিলিয়ে ৭৯ গোলে অবদান, ম্যাচপ্রতি গড়ে ০.৬৪টি। রোনালদোর যাওয়ার পরের তিন মৌসুমে এখন পর্যন্ত ম্যাচপ্রতি গড় গোল অবদানটা নেমে এসেছে ০.৪২তে।

মূল দায়টা এখানে চোটের। ডাকনামে রত্ন হলেও দিবালার শরীরটা যেন কাচের। পলকা। হালকা আঘাতেই যা ভেঙে যায়। ফুটবলবিষয়ক ওয়েবসাইট ট্রান্সফারমার্কেটের হিসাব জানাচ্ছে, শুধু এই মৌসুমেই এখন পর্যন্ত চোটের কারণে মাঠের বাইরে ছিলেন ১২০ দিন, মিস করেছেন ২১টি ম্যাচ।

কাকতাল ভাবতে পারেন, চোটের ধাক্কাটা রোনালদো জুভেন্টাসে যাওয়ার পর থেকেই বেশি। এ পর্যন্ত রোনালদো যাওয়ার পরের তিন মৌসুমে চোটের কারণে ২০৩ দিন মাঠের বাইরে ছিলেন দিবালা! অথচ ক্যারিয়ারে এর আগে চার মৌসুমে সব মিলিয়ে চোটের কারণে দিবালা মাঠের বাইরে ছিলেন ১২১ দিন!

এর পাশাপাশি মেসি-রোনালদোর পাশে অন্য কোনো বড় তারকাকে খেলানোর ক্ষেত্রে যে ঝামেলা কোনো কোচকে পোহাতে হয়, সেটি তো আছেই—খেলোয়াড়ের স্বাধীনতা।

আধুনিক ফুটবলে দৌড়ঝাঁপ অনেক বেশি করতে হয়। প্রতিপক্ষের পায়ে বল গেলে সেটি কেড়ে নেওয়া, প্রতিপক্ষের আক্রমণের সময় নিচে নেমে রক্ষণে সাহায্য করা, ছক ঠিক রাখা...কত্ত খাটুনি! এমন ক্ষেত্রে খুব বেশি হলে হয়তো একজন খেলোয়াড়কে ‘ফ্রি রোল’ বা স্বাধীনভাবে মাঠে খেলার সুবিধা দিতে পারেন কোচ। এর বেশি হলে রক্ষণে-মাঝমাঠে চাপ পড়ে। দলে মেসি-রোনালদোর মাপের খেলোয়াড় থাকলে সে স্বাধীনতা কে পাবেন, তা নিয়ে বিতর্ক করাই অর্থহীন।

রোনালদো ও দিবালা জুটি সেভাবে উপভোগ করতে পারেননি জুভ ভক্তরা।
ছবি: এএফপি

যে কারণে বার্সেলোনায় মেসির পাশে কুতিনিও-গ্রিজমানরা মানিয়ে নিতে খাবি খাচ্ছেন। নেইমার পেরেছিলেন কোচের খেলানোর কৌশলের বদলের কারণে। পাশাপাশি মেসি-নেইমার-সুয়ারেজ তিনজনই তখন নিজেদের মতো করে মানিয়ে নিতে পেরেছিলেন। নেইমার নিজেও রক্ষণে নামতে রাজি ছিলেন। গ্রিজমান বার্সায় এখন কিছুটা ভালো করছেন বার্সা কোচ রোনাল্ড কোমান কৌশলে বদল এনে মেসির পাশে তাঁকে খেলানোর মতো ব্যবস্থা করে দেওয়াতে।

রোনালদোর পাশে রিয়াল মাদ্রিদে করিম বেনজেমা আলো ছড়াতে পেরেছেন বেনজেমা নিজে মাঝমাঠ আর আক্রমণের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব অনেকটা নিয়ে নেওয়ায়। গ্যারেথ বেল নিচে নেমে রক্ষণে সাহায্য করতে রাজি হওয়াতে বেল-বেনজেমা-ক্রিস্টিয়ানো বা বিবিসি রিয়াল মাদ্রিদে ইতিহাস গড়তে পেরেছিল।

কিন্তু দিবালার শারীরিক গঠন এভাবে দৌড়ঝাঁপ করার মতো নয়। পাশাপাশি নিজেকে ‘প্লেমেকার’ হিসেবেই বেশি দেখতে চান দিবালা, আর স্বাধীনভাবে খেলতে চাওয়া প্লেমেকাররা আধুনিক ফুটবলে ধুঁকছেন। কুতিনিও, হামেস রদ্রিগেজরা যেটির প্রমাণ। জুভেন্টাসে রোনালদোকে স্বাধীনতা দিতে গেলে দিবালার পারফরম্যান্সে তাই ভাটা পড়াই স্বাভাবিক।

রোনালদো যাওয়ার পর এ নিয়ে তিন মৌসুমে জুভেন্টাসে তিনবার কোচ বদলানোও রোনালদো-দিবালার সমন্বয়টা জমে উঠতে দেয়নি। ২০১৮–১৯ মৌসুমে মাসিমিলিয়ানো আলেগ্রি, গত মৌসুমে মরিসিও সারির পর এই মৌসুমে জুভের দায়িত্ব পেয়েছেন কোচিংয়ে এর আগে অনভিজ্ঞ ক্লাবের কিংবদন্তি মিডফিল্ডার আন্দ্রেয়া পিরলো।

গত জানুয়ারিতে চোটে পড়ার পর থেকে মাঠের বাইরে দিবালা।
ছবি: এএফপি

তবে চোট কাটিয়ে মৌসুমের শেষ ভাগে দিবালাকে আবার মাঠে দেখার আশায় বুক বাঁধতে পারেন জুভেন্টাস ও আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা। গতকাল লিগে বেনেভেন্তোর কাছে অঘটনের শিকার হয়েছে জুভেন্টাস, নিজেদের মাঠে হেরে গেছে ১-০ গোলে। সেই ম্যাচের পর জুভ কোচ পিরলো বলেছেন, ‘আমরা সবাই ওর জন্য অপেক্ষা করছি। (আন্তর্জাতিক বিরতির কারণে) এখন ও এক-দুই সপ্তাহ পাবে দলের সঙ্গে থাকার।’

ডান হাঁটুর চোটে পড়া দিবালার চোটের সর্বশেষ অবস্থাও জানিয়েছেন পিরলো, ‘এখন ডান পায়ে বল ছোঁয়ানো ছাড়াই অনুশীলন করছে ও। দুই মাস ধরে কাজ করে যাচ্ছে। ওর অবস্থার উন্নতি যে হচ্ছে, তা নিয়ে আমাদের সংশয় নেই। কিন্তু এখনো বলে পা লাগলে ও পায়ে কিছু একটা অনুভব করে, দিক বদলে ফেলে। ওকে ফুটবল মাঠে দেখতে পাওয়ার আগে (চোটের পুনর্বাসনের) আরও একটা ধাপ এখনো বাকি আছে।’

গত জানুয়ারিতে হাঁটুর চোটটাতে পড়ার পর থেকে এ পর্যন্ত লিগে ১১টি ম্যাচ মিস করেছেন দিবালা। চ্যাম্পিয়নস লিগে শেষ ষোলোতে পোর্তোর বিপক্ষে দুই লেগে খেলতে পারেননি। তবে চোট আর ফর্ম নিয়ে ধুঁকতে থাকা দিবালাকে নিয়ে বেশ ঝামেলায় পড়েছে জুভেন্টাস। গত দুই মৌসুমেই তাঁকে বেচে দিতে অনেক চেষ্টা করেছে জুভ, শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এখনো চুক্তিতে এক বছর বাকি আছে দিবালার, তবে আগামী মৌসুমের শুরুতে আবার তাঁকে বেচতে চাইবে জুভেন্টাস, এমনটাই গুঞ্জন ইতালিতে।

আর্জেন্টাইন ফরোয়ার্ডের জন্য সাড়ে পাঁচ কোটি দাম পেলেই খুশি থাকবে জুভ, গুঞ্জন চাউর হয়েছে এটিও। আর তাঁকে পেতে চায় চেলসি, টটেনহামের মতো ক্লাব। দিবালা জুভেন্টাসে থাকবেন? উত্তর দেবে সময়।