আলিসনের মতোই গোল করে ম্যাচ জেতাতেন যে গোলরক্ষকেরা

ওয়েস্ট ব্রমের বিপক্ষে ম্যাচটা ১-১ ড্রতেই শেষ হবে বলে সবাই ধরে নিয়েছিলেন। যোগ করা সময়েরও প্রায় শেষ মুহূর্তে লিভারপুল কর্নার পেল। গোলরক্ষক আলিসন বেকারকে ওয়েস্ট ব্রমের বক্সে উঠে আসতে দেখে হয়তো অনেক লিভারপুল সমর্থকই প্রমাদ গুনেছিলেন। শেষ পর্যন্ত না কোনো প্রতি আক্রমণে গোল খেয়ে আম-ছালা দুই-ই খোয়া যায়!

কিন্তু একি! ট্রেন্ট আলেকজান্ডার-আরনল্ডের কর্নারে মাথা ছুঁইয়ে আলিসনই জয় এনে দিলেন লিভারপুলকে। শীর্ষ চারে থেকে পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার আশা তো তিনি বাঁচিয়ে রাখলেনই, গড়লেন ইতিহাসও। লিভারপুলের ১২৯ বছরের ইতিহাসে আলিসনই প্রথম গোলরক্ষক, যিনি গোল করে লিভারপুলকে জিতিয়েছেন।

আলিসন ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছেন। তবে ফুটবলে ব্রাজিলীয় তারকাই একমাত্র গোলরক্ষক নন। আরও বেশ কয়েকজন আছেন, যাঁরা গোলরক্ষার পাশাপাশি গোল করে দলকে জেতাতেও দারুণ পটু ছিলেন। এক-দুবার নয়, কেউ কেউ তো দলের গোল স্কোরিংয়ের অন্যতম অস্ত্র হয়ে উঠেছিলেন। পাঠকদের কাছে এই গোলরক্ষকদের নাম অজানা নয়। আলিসনের ইতিহাস গড়া গোলের পর সেই গোলরক্ষকদের নামগুলোও নিশ্চয়ই মনে পড়ছে তাদের !

রেনে হিগুইতা ছিলেন এমনই।
ফাইল ছবি, রয়টার্স

রেনে হিগুইতা

কলম্বিয়ার সেই ‘পাগলা’ গোলরক্ষককে সহজে ভুলে যেতে পারবেন না ফুটবলপ্রেমীদের অন্তত কয়েকটি প্রজন্ম। ভাবা যায়, পেশাদারি ক্যারিয়ারে তাঁর ৪১ খানা গোল আছে। তাঁকে ‘পাগলা গোলরক্ষক’ বলা হয় তাঁর প্রচণ্ড ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতার কারণে। মাঝেমধ্যে এমন ঝুঁকি নিতেন, যাতে সমর্থকদের আত্মা শুকিয়ে যাওয়ার অবস্থা ঘটত। সুইপার হিসেবে রক্ষণভাগের একজন হয়ে তিনি খেলতেন। অনেক সময় ভূমিকা রাখতেন শেষ রক্ষণসেনার। অচিন্তনীয় সব সেভের জন্য তিনি বিখ্যাত হয়ে উঠেছিলেন। বল হাত দিয়ে গ্রিপ না করে ‘স্করপিয়ান’ স্টাইলে দুই পা পেছনে বেঁকিয়ে গোল লাইন থেকে বল ফিরিয়ে দেওয়ার দৃশ্যটি তো ফুটবলের চিরদিনের দৃশ্যগুলোর একটি। ক্যারিয়ারে কোপা লিবার্তোদোরেসসহ অসংখ্য ট্রফি জিতেছেন। তবে হিগুইতা ফুটবল হল অব ফেমে অমর হয়ে থাকবেন আরও একটা মুহূর্তের জন্য। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ক্যামেরুনের বিপক্ষে সুইপার ডিফেন্ডারের ভূমিকা রাখার সময় রজার মিলার কাছে বল হারিয়ে দলকে ডুবিয়েছিলেন।

হোসে লুই চিলাভার্ট ছিলেন পরিপূর্ণ এক ফুটবলার। গোল ঠেকাতের দুর্দান্ত, গোল করতেনও তেমনই।
ফাইল ছবি

হোসে লুই চিলাভার্ট

তিনি রেনে হিগুইতারই আরও এক সংস্করণ ছিলেন। তবে গোল করায় তিনি ছাপিয়ে গিয়েছিলেন কলম্বিয়ান গোলরক্ষককেও। প্যারাগুইয়ান এই কিপার তাঁর পেশাদার ক্যারিয়ারে গোল করেছেন ৬৭টি। তাঁর অসাধারণ ব্যাপার ছিল নেতৃত্ব দেওয়ার ক্ষমতা। দলের খেলোয়াড়দের সবার পেছনে থেকেও তিনি ছিলেন সবার চেয়ে এগিয়ে। ফ্রি কিক থেকে গোল করাকে তিনি রীতিমতো প্রবাদের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি হ্যাটট্রিকও করেছেন। যে কৃতিত্ব আর কোনো গোলরক্ষকেরই নেই। ক্যারিয়ারে আটটি আন্তর্জাতিক গোল করে নিজেকে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তির কাতারে। গোলরক্ষক হিসেবে তাঁর সেভগুলোরও তুলনা হয় না। অসম্ভব সব সেভ তাঁকে বানিয়েছেন একজন পরিপূর্ণ ফুটবলার।

মেক্সিকান গোলরক্ষক হোর্হে ক্যাম্পস ছিলেন ফ্যাশন আইকনও।
ফাইল ছবি

হোর্হে ক্যাম্পোস

১৯৯৪ বিশ্বকাপে ফুল আঁকা রঙিন বাহারি জার্সিতে ব্যাপক আলোচিত ছিলেন ছোটখাটো গড়নের এই মেক্সিকান গোলরক্ষক। ফুটবল মাঠে গোলরক্ষকদের জার্সিতে বিপ্লবই ছিল তাঁর সেই ফ্যাশন। নব্বইয়ের দশকে যখন প্রায় সব গোলরক্ষকই ফুলহাতা জার্সি পরে খেলতেন, তখন ক্যাম্পস পরতেন হাফহাতা জার্সি। সে জার্সিও ছিল শরীরের মাপের চেয়ে একটু বড়। বল পায়ে নিয়ে অবলীলায় এগিয়ে যেতেন তিনি। প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের একে একে কাটিয়ে আক্রমণ রচনা করতেন। সেট পিসগুলোতে পোস্ট ছেড়ে প্রতিপক্ষের বক্সে এসে ওত পেতে থাকতেন গোল করার জন্য। পেনাল্টি বিশেষজ্ঞ হিসেবেও দুভাবেই বিখ্যাত ছিলেন। পেনাল্টি তো ঠেকাতেনই, পেনাল্টি থেকে গোল করতে ডাক পড়ত তাঁরই। মেক্সিকোর হয়ে জিতেছেন আন্তর্জাতিক ট্রফিও।

গোলরক্ষকদের ‘মেসি’ চেনি
ফাইল ছবি

রজেরিও চেনি

অনেকেই তাঁকে গোলরক্ষকদের ‘মেসি’ বলতে পছন্দ করেন। ব্রাজিলীয় ক্লাব সাও পাওলোর এই গোলরক্ষক তাঁদের হয়েই গোল করেছেন ১৩১টি! ২২ বছরের ক্যারিয়ারে ৬০টির বেশি ফ্রি কিক গোল আর ৭০টি পেনাল্টি থেকে গোল আছে চেনির। গোলরক্ষক হিসেবে গোল করার ব্যাপারে তাঁর সেরা সময় ছিল ২০০৫ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যকার সময়টি। এ সময় তিনি ৪৫টির বেশি গোল করেছিলেন একাই। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এ সময় সাও পাওলোর মূল স্ট্রাইকারদের গোল সাকল্যে ১৫টিও ছিল না। চেনিই ফুটবল ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি গোল করা গোলরক্ষক। তাঁর ধারেকাছেও নেই কেউই।

বুলগেরীয় গোলরক্ষক ইভানকভ পেনাল্টি থেকে গোল করার বিশেষজ্ঞ ছিলেন।
ফাইল ছবি

দিমিতার ইভানকভ

বুলগেরিয়ান গোলরক্ষক দিমিতার ইভানকভ। জাতীয় দলে একসময় ১ নম্বর জার্সি নিয়ে তাঁর তীব্র লড়াই হতো অন্যের সঙ্গে। জ্রাদকো জ্রাদকভ নামের সেই গোলরক্ষক পিছিয়ে পড়েছিলেন অনেক জায়গাতেই। যে গোলরক্ষক দলে থাকলে একজন ডিফেন্ডার কিংবা একজন স্ট্রাইকারের অভাব অনুভূত হয় না, সে তো যেকোনো দলের জন্যই সম্পদ। ইভানকভ ছিলেন তেমনই এক গোলরক্ষক। তিনি গোল ঠেকাতেন দুর্দান্ত। গোলও করতেন নিয়মিত। পেশাদারি ক্যারিয়ারে তাঁর গোলসংখ্যা ৪২। পেনাল্টি থেকে গোল করার ব্যাপারে ছিলেন দুর্দান্ত।