আশা-নিরাশার এমিলি

বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বের ঘড়ির কাঁটা টিক টিক ঘুরছে। দেশের ফুটবলে একটা আকাঙ্ক্ষাও বাড়ছে দ্রুতলয়ে। ঘরের মাঠে ১১ জুন কিরগিজস্তান ও ১৬ জুন তাজিকিস্তানের সঙ্গে জয়ের ছবি আঁকছেন অনেকেই। কিন্তু জেতার জন্য গোল চাই। সেই গোলটা করবে কে?
এটা কোনো প্রশ্ন হলো! সাদা চোখে বাংলাদেশ দলের পক্ষে গোল করার মূল দায়িত্ব স্ট্রাইকার জাহিদ হাসান এমিলির। প্রত্যাশার ঘোড়া সব সময় তাঁকে কেন্দ্র করেই ছোটে। কিন্তু গোল করে তিনি আলোচনায় আসেন কালেভদ্রে। ১০ বছর জাতীয় দলে খেলে ফেললেও দেশের শীর্ষ স্ট্রাইকারের কাছে গোল যেন পরম কাঙ্ক্ষিত বস্তু। অনেকটা সোনার হরিণের মতো!
পরিসংখ্যানই বলছে সব। লাল-সবুজ জার্সিতে সর্বশেষ ১৪ ম্যাচে এমিলির গোল মাত্র ৪টি। এগুলো এসেছে গত সাফে পাকিস্তান, বঙ্গবন্ধু কাপের ফাইনাল এবং শ্রীলঙ্কার সঙ্গে প্রীতি ম্যাচে যশোর ও রাজশাহীতে। ঘরোয়া লিগে নিয়মিত গোল করার অভ্যাস থাকলে তবেই তো জাতীয় দলকে গোল এনে দেবেন। সেই ঘরোয়া লিগটা কয়েক বছর ধরেই তাঁর কাছে অনুর্বর জমি। যেখানে ফসল ফলাতে পারছেন না।
প্রথম তিনটি পেশাদার লিগে অবশ্য উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছিলেন। ওই তিন লিগে করেছিলেন ১২, ১৩, ১৯ গোল। দু-তিনটি হ্যাটট্রিক, ম্যাচে ৪ গোল, এমিলির সম্ভাবনার বার্তাই ছড়িয়েছে সে সময়। সেই এমিলিকে ঘিরে আশার বেলুন ফুলেছে, নিরাশাও ঘিরে ধরেছে এরপর। গত চার লিগে দুই অঙ্কে পৌঁছায়নি তাঁর গোল—৬, ৫, ৭, ৯। এবার এখন পর্যন্ত ৯ ম্যাচে ৪ গোল।
গোলক্ষুধা কি তাহলে কমে গেল দেশের প্রধান স্ট্রাইকারের! এমিলি শান্ত গলায় নানা যুক্তি দিয়ে বলেন, ‘গোলক্ষুধা কমবে কেন, স্ট্রাইকার সব সময়ই চায় গোল পেতে। আমিও ব্যতিক্রম নই।’
কিন্তু এই কি সেই এমিলি? ২০০৫ করাচি সাফ ফুটবলে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টেই ভারতের সঙ্গে দূরপাল্লার এক গোল করে যিনি কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন? সাম্প্রতিক সময়ে এমিলি গোল করলে সেটি হয়ে ওঠে বড় খবর!
এমিলির পাল্টা যুক্তি আছে, ‘মাঝে চোট ছিল। শেখ জামালে গিয়ে বিদেশিদের ভিড়ে প্রায় বসেই ছিলাম। তা ছাড়া লিগে এখন প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ায় গোল করা সহজ নয়। আমি নিজেও শুধু স্ট্রাইকার হিসেবে খেলি না। টিম গেমে অংশ নিই, প্রয়োজনে রক্ষণও করি। আমার ভূমিকাই তো বদলে গেছে।’
সেই ভূমিকা নির্ধারণ করেন কোচ। লোডভিক ডি ক্রুইফের ৪-২-৩-১ ছকে প্রথাগত ‘নাম্বার নাইন’ এমিলি। কিন্তু ক্রুইফ বরাবরই শিষ্যের পাশে, ‘ও তো প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের ডিস্টার্ব করে। এতে অন্যদের সামনে সুযোগ তৈরি হয়। সেটাও কম নয়।’ বঙ্গবন্ধু কাপে শ্রীলঙ্কার কোচও তা-ই বলে গেছেন।
দেশি কোচদের মূল্যায়নও এক। তাঁকে ছাত্র হিসেবে পাওয়ার অভিজ্ঞতায় শেখ জামাল কোচ মারুফুল হক বলছেন, ‘স্ট্রাইকারের কোয়ালিটির ওপর নির্ভর করে খেলার ধরন। ওর গতি একটু কমলেও মিডফিল্ডের সামনে লিংকআপ এবং উইং প্লে করে সে গোলমুখে গেলে মার্কিংয়ে পড়ে। তখন সে ওই ডিফেন্ডারকে সরিয়ে নিতে পারে, অন্যরা সুযোগ পায় গোল করার। সেই হিসেবে এমিলিকে কার্যকরই বলব।’
মুক্তিযোদ্ধায় এমিলিকে পেয়েছেন শফিকুল ইসলাম মানিক। এমিলি-মিঠুন-সানডেকে ব্যবহার করতে সেবার ফর্মেশনও বদলে ফেলেন এই কোচ। ওই লিগে চোটাঘাত সয়েও ৫ গোল করেছিলেন এমিলি। মানিক ভালো নম্বরই দিচ্ছেন তাঁকে, ‘একক স্ট্রাইকার হিসেবে হয়তো সে চাপে থাকে। বাক্সবন্দী করে রাখে প্রতিপক্ষ, সতীর্থরা হয়তো সুযোগ কাজে লাগায়। এমিলি তাই ব্যর্থ নয়। পুরো ফিট থাকলে সে অবশ্যই মেধাবী স্ট্রাইকার।’
মানিকের চোখে, ‘এমিলির হেড ওয়ার্ক খুব ভালো।’ শেখ আসলাম, ইমতিয়াজ আহমেদ নকীবরা ছিলেন ‘হেড মাস্টার’। এমিলি শুধু বক্সেই থাকেন না, নিচেও নামেন। মানিক চান এমিলির সতীর্থরাও গোল করুক, ‘উইং থেকে জাহিদ-সোহেল রানা গোলের কাছেও সেভাবে আসে না। ওদের ট্রাই করা উচিত।’ উইং থেকে রোনালদো গোলের মালা গাঁথেন, অথচ বাংলাদেশের উইঙ্গারদের গোল নেই! গত ১৪ ম্যাচের এই পর্বে জাতীয় দলে জাহিদ গোলহীন, সোহেল রানার গোল মাত্র একটি!
তবে সতীর্থদের দিকে না তাকিয়ে এমিলি স্বীকার করেন, ‘হ্যাঁ, বছর বছর দল পাল্টালে নতুন খেলোয়াড়দের সঙ্গে বোঝাপড়ায় সমস্যা হয়।’ ২০০৬-০৭ প্রথম পেশাদার লিগে আবাহনীতে ইব্রাহিমের সঙ্গে তাঁর রসায়নটা জমেছিল, এমিলি-ইব্রাহিম-এমেকা ত্রয়ীও পরের বছর সমীহ কেড়েছে। ১৯ গোল পাওয়ার বছরে মোহামেডানে বুকোলার সঙ্গেও জমেছে ভালো। জাহিদ-মামুনুল-সনিদের সঙ্গে শেখ রাসেলে খেলে গোল তেমন পাননি।
সব সরিয়ে একটা জায়গায় তাঁর প্রশংসা করাই উচিত। পেনাল্টি নষ্ট করেননি কখনোই! মেসির মতো মানুষেরও পেনাল্টি মিস হয়, এমিলি এই জায়গায় মেসিকেও ছাড়িয়ে, ‘ক্যারিয়ারে কখনোই পেনাল্টি মিস করিনি। সংখ্যাটা ২৫-এর মতো হবেই।’
পেনাল্টি আসে মাঝেমধ্যে। কিন্তু এমিলির কাছে বাংলাদেশ তো নিয়মিত গোল চায়!