উত্তমের 'ধন্যি মেয়ে' থেকে 'দ্য ড্যামড ইউনাইটেড'

খেলা ভালোবাসেন যারা, তাদের খেলা নিয়ে সিনেমাও ভালো লাগার কথা। সব বাধা ডিঙিয়ে জয়, উঠে আসা, আশ্চর্য পতন কিংবা তারকা-জীবন…খেলার সিনেমা কোনো না কোনোভাবে প্রেরণার আঁধারও। নটরডেমের হয়ে কলেজ ফুটবল খেলা ড্যানিয়েল রুয়েটগারের জীবন অবলম্বনে বানানো সিনেমা ‘রুডি’-র চিত্রনাট্যকার অ্যাঞ্জেলো পিজ্জো একবার বলেছিলেন, ‘আবেগতাড়িত হয়ে মূল চরিত্রের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারে বলেই লোকে খেলার সিনেমা ভালোবাসে। লোকে রুডিকে ভালোবাসে কারণ ওর মধ্যে নিজেকে দেখতে পায়।’

খেলা নিয়ে তেমনি কিছু সিনেমার গল্প এই ধারাবাহিকে। আজ প্রথম পর্ব-

ধন্যি মেয়ে সিনেমার বড় অংশ জুড়ে আছে ফুটবল। ছবি: টুইটার
ধন্যি মেয়ে সিনেমার বড় অংশ জুড়ে আছে ফুটবল। ছবি: টুইটার

অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের (লেখক বলাই চাঁদ মুখোপাধ্যায়ের ভাই) ‘ধন্যি মেয়ে’ খেলার ছবি না। কিন্তু বাংলায় ফুটবল নিয়ে সিনেমার কথা উঠলে এ ছবির গল্প হবেই। ফুটবল আর প্রেমের সঙ্গে রসিকতার দমকে চোখ ভিজে আসে। উত্তম, সাবিত্রী, রবি ঘোষ, জয়া বচ্চন আর মান্না দে-র সেই গানটা ‘সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল…’ কে ভুলতে পারে!

মানু সেনের বানানো ‘মোহনবাগানের মেয়ে’-ও দম ফাটানো হাসির ছবি বটে নির্যাসটুকু ফুটবলের। সেই মোহনবাগান-ইস্ট বেঙ্গল আর ঘটি-বাঙাল দ্বন্দ্বের পারিবারিক ছবি। উৎপল দত্ত, ভানু, দীপঙ্কর দে, রবি ঘোষ, চিন্ময় রায়, তরুণ কুমারদের নিয়ে বানানো সিনেমা।

সরোজ দে-র পরিচালনায় ‘কোনি’ এর চেয়ে অনেক বেশি খেলাকেন্দ্রিক। মতি নন্দীর উপন্যাস থেকে বানানো সিনেমাটি এক সাঁতারুর উঠে আসার গল্প। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে অভিনয় করা শ্রীপর্ণা চট্টোপাধ্যায় ছিলেন পেশাদার সাঁতারু। ‘ফাইট! কোনি ফাইট!’ সংলাপটি এখনো অনেকের মুখে ফেরে। বিজয় বোসের ‘সাহেব’ এক উঠতি ফুটবলারের স্বপ্ন মেরে ফেলার গল্প। সাহেব চরিত্রে তাপস পাল। কলকাতার আগে ঢাকায় মিতা বানিয়েছিলেন সাহেব, নাম ভূমিকায় ফারুক।

কলকাতা কিংবা ঢাকায় ক্রিকেটের জোয়ার পুরোনো। কিন্তু খুঁড়তে খুঁড়তে দেখা যাবে অধিকাংশ ভালো সিনেমা ফুটবল নিয়ে। লোকে ফুটবলকে মন দিয়ে রাখলেও বাইশ গজে দাম্পত্যজীবন চালায়। ইংল্যান্ডে ছবির মতো সুন্দর এক গ্রামে ছিল এমনই এক বাইশ গজ। একদিন ম্যাচ গড়াল। এক দলে গ্রামের লোকজন। অন্য দলটা ওই গ্রামে অবকাঠামোগত উন্নয়নের দায়িত্ব পাওয়া লোকদের। দুই পক্ষের মধ্যে বিরোধের ভিত্তিতে নির্ধারিত এ ম্যাচের ফলের ওপর নির্ভর করছে গ্রামের ভবিষ্যৎ।

সাঁতারু হয়ে ওঠার সিনেমা কোনি। ছবি: সংগৃহীত
সাঁতারু হয়ে ওঠার সিনেমা কোনি। ছবি: সংগৃহীত

হাসির এ সিনেমার নাম ‘ব্যাজার্স গ্রিন’। ১৯৩৪ সালে মুক্তি পাওয়া এ ব্রিটিশ সিনেমার প্লট ‘লগান’কে মনে করিয়ে দেয়। যেখানে দিলীপ কুমারের ‘নয়া দৌড়’ সিনেমার প্রভাব স্পষ্ট। ১৯৫৭ সালের সেই সিনেমার চুম্বক অংশ একটি প্রতিযোগিতা। জমিদারের যন্ত্রচালিত গাড়ির সঙ্গে ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে পাল্লা দিয়েছিলেন ‘টোঙ্গাওয়ালা’ শংকর (দিলীপ)।

সে যাই হোক, ব্যাজার্স গ্রিন দেখা যাবে না। একটি নাটক থেকে বানানো সিনেমাটির কোনো কপি নেই। এটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইনস্টিটিউটের’ ৭৫ মোস্ট ওয়ানটেড’ সিনেমাগুলোর একটি। ১৫ বছর পর একই নামে বানানো সিনেমাটি অবশ্য আছে।

বলিউডে ক্রিকেট নিয়ে সিনেমার সংখ্যা বেড়েছে। মহেন্দ্র সিং ধোনি, শচীন টেন্ডুলকারের জীবনী নিয়ে সিনেমা হয়ে গেছে। আছে ‘ইকবাল’ ‘কাই পো চে’ ‘১৯৮৩ ’-র মতো দারুণ চিত্রনাট্য।

কোনো নির্দিষ্ট কোনো সিরিজ ধরলে ১৯৮৪ সালের অস্ট্রেলিয়ান মিনি সিরিজ ‘বডিলাইন’ থাকবেই। ১৯৩২-৩৩ মৌসুমে শরীর তাক করে বল করার কুখ্যাত সেই টেস্ট সিরিজ নিয়ে বানানো সাত পর্বের এই ধারাবাহিকে ইংল্যান্ড অধিনায়ক ডগলাস জার্ডিনের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন হুগো ওয়েভারিং। চেনা গেল? ম্যাট্রিকসের এজেন্ট স্মিথ। ডন ব্র্যাডম্যানের ভূমিকায় ‘দ্য ট্রাকার’-এর সেই ‘ফ্যানাটিক’ ডোনাল্ড সুইট। হ্যারল্ড লারউডের ভূমিকায় অস্ট্রেলিয়ান টিভি সিরিজ তারকা জিম হল্ট।

ব্র্যাডম্যানের কথা যেহেতু উঠলই তাহলে ‘দ্য ফাইনাল টেস্ট’ কেন নয়? ১৯৫৩ সালের এ সিনেমার মূল চিত্রনাট্য লেখা হয়েছিল টিভি সিরিজের জন্য। হ্যারো স্কুলের চৌকস ক্রিকেটার টেরেন্স র‍্যাটিগান বড় হয়ে ব্রাডম্যানের শেষ টেস্ট ধরে লিখেছিলেন এই চিত্রনাট্য। লেন হাটন, ডেনিস কম্পটন, অ্যালেক বেডসার, গডফ্রে ইভানস, জিম লেকারদের মতো ইংলিশ কিংবদন্তি অভিনয় করেছেন এ সিনেমায়। ধারাভাষ্যে জন আরলট।

ক্রিকেট নিয়ে হাসির এই সিনেমার কোনো কপি নেই। ছবি: সংগৃহীত
ক্রিকেট নিয়ে হাসির এই সিনেমার কোনো কপি নেই। ছবি: সংগৃহীত

ক্রিকেটের ক্যারিবিয়ান ঢেউ দেখতে চাইলে দেখতে হবে ‘ফায়ার ইন ব্যাবিলন’। সত্তর-আশির দশকে বিশ্বজয়ী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে নিয়ে বানানো তথ্যচিত্র। তেমনি ২০০৫ সালের অ্যাশেজ নিয়ে বানানো ‘দ্য অ্যাশেজ: দ্য গ্রেটেস্ট সিরিজ’। চ্যানেল ফোরের বানানো এই তথ্যচিত্র রোমাঞ্চ ও নাটকীয়তায় ভরপুর। মনে হবে মাঠ থেকে ড্রেসিং রুম পর্যন্ত সেখানে ছিলেন! ৫ টেস্ট ও ২৩ দিনের সেই সিরিজের নিষ্পত্তি হয়েছিল শেষ দিনে বিকেলে।

‘ওয়ান্ডারার্স অবলিভিয়ন’ দেখে শৈশব মনে পড়তে পারে। ছেলেটা ক্রিকেট বলতে পাগল। বাড়িতে গাদা গাদা খেলার সরঞ্জাম। সমস্যা হলো খেলাটা সেভাবে শেখা হয়নি। এমনিতে বিশেষ কিছু না হলে বাচ্চাদের খেলা শেখানোর ঝুঁকি কেউ নেয় না। তার চেয়ে ভবিষ্যতের জন্য তৈরি হয়ে ওঠায় গুরুত্ব বেশি। কিন্তু একদিন কপাল খুলল। এক জ্যামাইকান পরিবার এল প্রতিবেশী হয়ে। বাকিটা সপ্তম স্বর্গে ওঠার গল্প।

আছে নরকজয়ের গল্পও। কল্পনার থার্ড রাইখের স্বার্থ চরিতার্থে এক ফুটবল ম্যাচ আয়োজন করল হিটলারের জার্মানি। যুদ্ধবন্দীদের সঙ্গে প্রীতি (!) ম্যাচ খেলবে নাৎসিদের অলস্টার দল। পালানোর সিদ্ধান্ত নিলেন ইংরেজ অফিসার ও যুদ্ধের আগে পেশাদার ফুটবলার জন কোলবি। সিদ্ধান্ত হলো বিরতির সময় ভাগতে হবে। মাঠেও দেখল ওরা বন্দী ছাড়া কিছু না। নির্জলা গোল বাতিল। প্রাণঘাতী ফাউল দেখেও কেউ দেখে না। প্রথমার্ধ শেষে ৪-১ ব্যবধানে পিছিয়ে পড়া। তাতে কী! পালানোই মোক্ষধাম। কিন্তু দলের একজন (ইপসউইচ টাউনের সাবেক ফুটবলার রাসেল ওসমান) বলে উঠলেন, আমরা এখান থেকেও জিততে পারব। ব্যস, উসকে উঠল আগুন।

শেষ বাঁশি বাজার পর ম্যাচ ৪-৪ গোলে ড্র। দুর্দান্ত খেললেন পেলে, অসভালদো আরদেলিস, ববি মুর। ভুল পড়েননি। কেন পড়েননি সে কথায় পরে আসা যাবে। আগে জেনে রাখুন, খেলার স্পিরিটকে কীভাবে জাগিয়ে ড্র করার পরেও দর্শকদের কাছ থেকে ‘ভিক্টরি, ভিক্টরি’ উল্লাস আদায় করে নেওয়া যায় তার উদাহরণ ‘এসকেপ: টু ভিক্টরি’। কোলবিরা কিন্তু পালাতে পেরেছিলেন। কীভাবে তা নিজের চোখে দেখাই ভালো।

পেলে অভিনয় করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ সিনেমায়। ছবি: সংগৃহীত
পেলে অভিনয় করেছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের এ সিনেমায়। ছবি: সংগৃহীত

পেলে, ববি মুর, আরদেলিস ছাড়াও ইপসউইচ টাউনের অনেক ফুটবলার অভিনয় করেছেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্লটে তৈরি এ সিনেমায়। ছিলেন মাইকেল কেইন ও সিলভ্যালেস্টার স্ট্যালোনের মতো নামজাদা অভিনেতা। স্ট্যালোন গোলরক্ষকের পাঠ নিয়েছিলেন গর্ডন ব্যাংকসের কাছ থেকে। ১৯৮১ সালে মুক্তি পাওয়া জন হিউস্টনের এ সিনেমা হৃদয়কে উষ্ণ করে। কোথাকার কোন শুকনো পোড়া নদীতে যেন শীতল ধারা বয়ে যায়।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর জার্মানদের জীবন আবার এ ধারাকে চোখে ঝরায়। মানবেতর জীবনযাপন করা একটা পরিবার আদর্শিক জায়গায় খণ্ড খণ্ড। বাবা ছিলেন নাৎসি বন্দী, বড় ছেলে সমাজতান্ত্রিক, বাবার ভাবনাকে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ করে। মেয়েটার মন ব্রিটিশ সৈনিকদের প্রতি। শুধু ছোট ছেলেটার সঙ্গে বাবার মিল। দুজনেই ফুটবল ভালোবাসেন। বার্নে ছেলেকে নিয়ে বাবা ছুটলেন বিশ্বকাপ ফাইনাল দেখতে। লোকে সেই ফাইনালকে বলে ‘মিরাকল অব বার্ন’। সেদিন ছেলেটির জীবনেও নেমে এসেছিল অলৌকিকত্ব। ‘দ্য মিরাকল অব বার্ন’ জার্মানির অন্যতম সফল সিনেমাগুলোর একটি।

‘দ্য ড্যামড ইউনাইটেড’ কিন্তু সফলতার গল্প না। ব্রায়ান ক্লফ চরিত্রটাই তো আগুন। খ্যাপাটে মানুষ। ডার্বিকে প্রথম বিভাগে তোলা, শিরোপা জেতানো, নটিংহাম ফরেস্টকে টানা দুবার ইউরোপসেরা বানানো। কিন্তু এ গল্প সেসব নিয়ে নয়। ডন রেভির সময়ে শরীরনির্ভর ফুটবল খেলে কুখ্যাতি কুড়োনো লিডস ইউনাইটেডে ক্লফের ঝড়ের দিনগুলো নিয়ে এ সিনেমা। ফুটবল পছন্দ করলে ইংল্যান্ড জাতীয় দলকে কোচিং করানোর সুযোগ না পাওয়া অন্যতম বিখ্যাত এ কোচের সেই সময় নিয়ে বানানো সিনেমাটি দেখার দাবি রাখে। শর্ত থাকে যে, কোচিং মানিকজোড় ক্লফ-পিটার টেলরের প্রেমে পড়া যাবে না। ডেভিড পিসের বইয়ের ক্লফ চরিত্রে অনবদ্য ছিলেন ‘মিডনাইট ইন প্যারিস’-এর সেই পল—মাইকেল শিন।