এক সময়ের চ্যাম্পিয়নদের দল গড়াই অনিশ্চিত

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর থেকেই তালা ঝুলছে গুলিস্তানের মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্রের গেটে।ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ভেতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। লোহার শিকের ফাঁকে চোখ রেখে কিছুই দেখা গেল না। গত রোববার সন্ধ্যায় গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র ভবন চত্বরে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতাই হলো। অথচ ১৩ মাস আগেও ওসমানী উদ্যানে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র ক্লাবটি জমজমাট ছিল। এখন সবই স্তব্ধ। ক্লাব ফটকে বসা এক চা-দোকানি বললেন, ‘কেউ এইখানে আর আহে না। মেলা দিন হইছে বন্ধ।’

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গত বছর ১৮ সেপ্টেম্বর র্যাব ক্লাবটি সিলগালা করে দেয়। ওয়ান-ইলেভেনের সময়ও জুয়াবিরোধী অভিযোগে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী হানা দেয় এই ক্লাবে। তখন জুয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকলেও কিছুদিন পরই আবার যে-সে অবস্থা। তবে ওয়ান-ইলেভেনের সময় মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবে তালা পড়েনি। পড়েছে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে।

১৯৮৭ সালে এরশাদ সরকার ২০ কাঠার জায়গাটি দেয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে। শুরুর দিকে এখানে ক্লাবটির ফুটবল দলকে রাখা হতো। কয়েক বছর পরই এটি জুয়ার আখড়ায় পরিণত হয়। অনেকে বলেন, ওয়ানটেনসহ নানা ধরনের জুয়া মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব থেকেই শুরু।

১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযোদ্ধা ফুটবল দলটি চালাত মুক্তিযোদ্ধা সংসদ। কিন্তু সংসদের অতীতের বেশির ভাগ কর্মকর্তাই ক্লাব থেকে সুবিধা লুটেছেন। সংসদের কমিটি না থাকলে সরকারি কর্মকর্তারা আপৎকালীন দায়িত্বে থাকেন। কিন্তু ক্লাব নিয়ে তাঁদের আগ্রহ তেমন থাকে না।

গুলিস্তানের স্থাপনার ভাড়ার টাকার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতাও মুক্তিযোদ্ধার আজকের চরম সংকটের একটি বড় কারণ। চাইলে এখানে ফুটবলারদের জন্য স্থায়ী আবাসনের ব্যবস্থা করা যেত। কিন্তু ক্লাব ভবন নির্মাণের কিছুদিন পরই জায়গাটি ভাড়া দেওয়া হয় জুয়ার আসর বসানোর জন্য। বছর দশেক আগে আলী আহমেদ নামের এক ব্যক্তি এটি ভাড়া নিয়ে জুয়া-ক্যাসিনো চালাতেন। দৈনিক ভাড়া ছিল দেড় লাখ টাকা, মাসে ৩৫ লাখ। পুরো টাকাটাই পেত মুক্তিযোদ্ধা দল। অবশ্য ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পর ১২ কোটি ৮০ লাখ টাকার মতো বাকি রেখেই ওই ব্যক্তি গা ঢাকা দিয়েছেন। তাঁর নামে মামলাও হয়েছে।

মন্ত্রীর কথা: নতুন মৌসুমে মুক্তিযোদ্ধার ফুটবল দল গঠন নিয়ে ক্লাবটির ফুটবল–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা তাকিয়ে আছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের দিকে। তিনি মুক্তিযোদ্ধা ফুটবল দলের প্রধান উপদেষ্টাও। কিন্তু মন্ত্রীর কথায় সমস্যা সমাধানের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের স্থাপনাটি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিলের অধীনে, মন্ত্রণালয়ের নয়। এখন গুলিস্তানের স্থাপনাটি বন্ধ। তবে পৃষ্ঠপোষণা পেলে ফুটবল দল চলতে পারে। এর জন্য সরকারের কোনো বরাদ্দ নেই। ক্লাবের একটি সূত্র জানায়, মন্ত্রী ফুটবল–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বলেছেন, স্পনসর পেলে মাঠে নামতে। কিন্তু স্পনসর না পেলে? এই প্রশ্নের সরাসারি উত্তর না থাকলেও সে রকম পরিস্থিতিতে মাঠে না নামার সম্ভাবনাই নাকি বেশি।

মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকেও টাকা পেত ক্লাব। সারা দেশে হাটবাজার ইজারা থেকে সরকারের পাওয়া অর্থের ৪ শতাংশ আসত মুক্তিযোদ্ধা সংসদের তহবিলে। প্রিমিয়ার ফুটবল লিগে মুক্তিযোদ্ধা যখন চ্যাম্পিয়ন দল গড়ার চেষ্টা করত, তখন এই টাকার একটা বড় অংশ পেত ফুটবল দল। ছয়-সাত বছর হলো সরকার থেকে সেই টাকা আর পায় না মুক্তিযোদ্ধা সংসদ।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের পরও অবশ্য মুক্তিযোদ্ধা ফুটবল দলের জন্য তিন কোটি টাকা জোগাড় করা হয়। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও সরকারের শীর্ষ স্তরের বিশেষ সহায়তা ছিল তাতে। বসুন্ধরা কিংসও ৫০-৬০ লাখ টাকার মতো দিয়েছে বলে জানা যায়। মার্চে করোনায় খেলা বন্ধ হওয়ার আগপর্যন্ত খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের অর্ধেক দিয়ে দেয় ক্লাব কর্তৃপক্ষ। ১৯ ডিসেম্বরে ফেডারেশন কাপ দিয়ে নতুন ফুটবল মৌসুম শুরু হচ্ছে। পুরোনো কিছু বকেয়া এবং এবারের ক্যাম্প খরচ মিলিয়ে মুক্তিযোদ্ধার প্রায় ছয়-সাত কোটি টাকা লাগবে বলে জানিয়েছেন এক কর্মকর্তা।

তবে এত টাকা কোথা থেকে আসবে, তা জানেন না মুক্তিযোদ্ধা ফুটবল দলের তরুণ ম্যানেজার আরিফুল ইসলাম। আগামী বছর স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি। তার আগে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাবের অনিশ্চিত পরিস্থিতি চিন্তিত করে তুলছে তাঁকে, ‘এমন ঐতিহাসিক উপলক্ষে মুক্তিযোদ্ধা খেলবে না, তা কীভাবে হয়! যেভাবেই হোক মুক্তিযোদ্ধা ফুটবল দলকে মাঠে নামাতে হবে। কিন্তু কীভাবে দল গঠন হবে জানি না। এ অবস্থায় আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তিনি হস্তক্ষেপ করলে সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করি।’

মুক্তিযোদ্ধা সংসদের প্রশাসক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব জহুরুল ইসলাম। পদাধিকার বলে তিনি মুক্তিযোদ্ধা ক্রীড়াচক্রেরও সভাপতি। গতকাল যোগাযোগ করা হলে জহুরুল ইসলাম ফোন ধরেননি, খুদে বার্তায়ও সাড়া দেননি। তবে ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সুফি আবদুল্লাহেল মারুফ বলেন, ‘সভাপতি যেভাবে চালাবেন, সেভাবেই আমরা চালাব। মুক্তিযোদ্ধা দল গঠনের প্রক্রিয়া চলছে।’