এবার দলে থেকেও জেতাতে পারলেন না নেইমার

নেইমার এবার মাঠে থেকেও জেতাতে পারেননি।ছবি : রয়টার্স

ছবিটা এখনো ইন্টারনেটে ঘুরে বেড়ায় নিয়মিত। কালো জ্যাকেট আর একটা ক্যাপ পরে সাইডলাইন থেকে দলের খেলা দেখে যাচ্ছেন চোটগ্রস্ত নেইমার, হঠাৎ করে ম্যাচের একদম অন্তিমলগ্নে মার্কাস রাশফোর্ডের পেনাল্টি গোল হজম করে নিজেদের মাটিতে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের কাছে হেরে বসে পিএসজি। পার্ক দে প্রিন্সেসে হাজারো সাংবাদিকদের টিভি ক্যামেরা তাড়াতাড়ি নেইমারের চেহারার অভিব্যক্তি দেখাতে ভুল করেনি। ঘটনার আকস্মিকতায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এই ব্রাজিল তারকা, পড়ছিল না চোখের পলক। হয়তো দুষছিলেন পোড়ামুখো চোটকে, যে চোট সেদিন এমবাপ্পে-ডি মারিয়াদের সঙ্গে তাঁকেও মাঠে নামতে দেয়নি। হয়তো ভাবছিলেন, ‘আজ যদি আমি খেলতে পারতাম...।’

২০১৮-১৯ আসরের সে ম্যাচে ৩-১ গোলে হেরে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় পিএসজি। কিন্তু গত রাতে সে আক্ষেপটা থাকার কথা না নেইমারের। তিনি মাঠেই ছিলেন! এবার মাঠের ভেতর থেকেই দেখলেন ইউনাইটেড-রূপকথা। আর আগের ওই ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও পিএসজির হৃদয় ছত্রখান করে জয় ছিনিয়ে আনলেন ইংলিশ তারকা মার্কাস রাশফোর্ড। ইউনাইটেড জিতল ২-১ গোলে।

নিজেদের মাঠে পিএসজি যথারীতি আক্রমণভাগের সবটুকু শক্তি নিয়েই নেমেছিল। ৪-৩-৩ ছকে সবার ওপরে এমবাপ্পে, দুপাশে নেইমার আর আনহেল দি মারিয়া। গোলরক্ষক কেইলর নাভাসের ওপরে দুই ফরাসি সেন্টারব্যাক প্রেসনেল কিমপেম্বে ও আবদু দিয়ালোর জুটি। দুই ফুলব্যাক হিসেবে এই মৌসুমে রোমা থেকে ধারে আসা আলেসসান্দ্রো ফ্লোরেঞ্জি (ডান) ও লেভিন কুরজাওয়া (বাম)। তিন মিডফিল্ডারের মধ্যে সবার মাঝে খেলেছেন দলে নতুন আসা দানিলো পেরেইরা, দুপাশে আইভরি কোস্টের ইদ্রিসা গানা গেয়ে ও স্পেনের সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড মিডফিল্ডার আন্দের এরেরা।

মার্সিয়ালের সেই আত্মঘাতী গোল।
ছবি: রয়টার্স

ওদিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের যেন লক্ষ্যই ছিল, যে করেই হোক, গোল খাওয়া যাবে না। পিএসজির আক্রমণ সামলে দ্রুতগতির দুই স্ট্রাইকারের মুভমেন্টের সুবিধা নিয়ে প্রতি আক্রমণের মাধ্যমে গোল করতে হবে। কাগজে-কলমে ছকটা ৪-২-৩-১ দেখালেও গোলরক্ষক দাভিদ দে হেয়ার সামনে ডিফেন্ডার হিসেবে খেলেছেন মূলত পাঁচজন। তিন সেন্টারব্যাক লুক শ, ভিক্টর লিন্ডেলভ, অ্যাক্সেল তুয়ানজেবে, দুই ফুলব্যাক হিসেবে অ্যারন ওয়ান-বিসাকা (ডান) ও দলে নতুন আসা অ্যালেক্স তেয়েস (বাম)। মিডফিল্ডে ছিলেন এই ম্যাচে দলের অধিনায়ক হওয়া পর্তুগিজ তারকা ব্রুনো ফার্নান্দেস, ব্রাজিল তারকা ফ্রেড ও স্কটল্যান্ডের স্কট ম্যাকটমিনে।

ম্যাচের প্রথম থেকেই পিএসজি ইউনাইটেডের রক্ষণে আঘাত হানতে থাকে বারবার। কিন্তু ইউনাইটেড যেন পণ করে নেমেছিল, গোল খাওয়াই যাবে না! তাই প্রথম থেকেই দেখা গেছে, নেইমার-এমবাপ্পেরা বল নিয়ে যখনই ইউনাইটেডের ডি-বক্সের আশপাশে চলে আসছিলেন, নয় থেকে দশজন ইউনাইটেড খেলোয়াড় সে বিপদ সামলাতে নেমে আসছিলেন। ম্যাচের বারো মিনিটে ডি-বক্সের ঠিক বাইরে থেকে বাঁ পায়ে বাঁকানো এক শট নিয়েছিলেন দি মারিয়া, ঝাঁপিয়ে শট আটকে সে যাত্রায় ইউনাইটেডকে উদ্ধার করেন দে হেয়া। এর একটু পরেই আরেকবার দলকে সামলান এই স্প্যানিশ গোলরক্ষক। এমবাপ্পের ক্রস আয়ত্তে এনে কুরজাওয়া গোলমুখ বরাবর শট নিলেও বাধা হয়ে দাঁড়ান দে হেয়া।

পিএসজির মাঠ থেকে দারুণ জয়ই আদায় করে নিল ইউনাইটেড।
ছবি: রয়টার্স

তবে বিশ মিনিটে স্রোতের বিপরীতে গোল করার সুযোগ পেয়ে যায় ইউনাইটেড। এই ম্যাচে সেন্টারব্যাক হিসেবে খেলা লুক শ বল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন ডি-বক্সে থাকা মার্সিয়ালের উদ্দেশ্যে, বল দখলে এনে পেছনে থাকা পিএসজি ডিফেন্ডার দিয়ালোকে বোকা বানিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ঘুরতে গিয়েই পড়ে যান ফরাসি স্ট্রাইকার, অবশ্যই দিয়ালোর অন্যায় ট্যাকলের কারণে। সেখান থেকে পাওয়া পেনাল্টিতে গোল করে দলকে এগিয়ে দেন ম্যাচে অনুপস্থিত নিয়মিত অধিনায়ক হ্যারি ম্যাগুয়ারের জায়গায় অধিনায়কত্ব করা ব্রুনো ফার্নান্দেস। প্রথমবার অবশ্য নাভাস আটকে দিয়েছিলেন পেনাল্টি। কিন্তু ভিএআরের সাহায্যে দেখা যায়, পিএসজি গোলরক্ষক আগেই গোললাইন ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। ফলে আবারও পেনাল্টি নেওয়ার সুযোগ পায় ইউনাইটেড। এবার আর ভুল করেননি পর্তুগিজ তারকা।

৩৪ মিনিটে বাঁ প্রান্ত দিয়ে বিপজ্জনকভাবে ডি-বক্সে ঢুকে যাওয়া এমবাপ্পে তুয়ানজেবের সঙ্গে দৌড়ে না পেরে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পড়ে যান। নেইমাররা ভাবেন, তাঁদেরও পেনাল্টি এল বুঝি! সেটা হয়নি। উল্টো পেনাল্টির জন্য রেফারির সঙ্গে তর্কাতর্কি করতে গিয়ে হলুদ কার্ড দেখেছেন নেইমার। ৩৯ মিনিটে ডি-বক্সের ঠিক বাইরে থেকে ডান পায়ের এক বাঁকানো শটে নিজের দ্বিতীয় গোল করার চেষ্টা করেন ফার্নান্দেস। নাভাস রক্ষা করেন পিএসজিকে।

দ্বিতীয়ার্ধে আরও আক্রমণাত্মক খেলা শুরু করে পিএসজি। বক্সের মধ্যে দুজন ডিফেন্ডারকে কাটিয়ে ডান পায়ে নেওয়া এমবাপ্পের জোরালো শট আটকে দেন দে হেয়া। অতি আক্রমণের ফলে পিএসজির সবাই ওপরে উঠে আসছিল, ফলে প্রতি আক্রমণে প্রায় সময় অনেক জায়গা পেয়ে যাচ্ছিলেন রাশফোর্ড-মার্সিয়ালরা। ৫৫ মিনিটে গোল করেন মার্সিয়াল। তবে কোন পোস্টে গোল করতে হবে, গুলিয়ে ফেলেছিলেন। নেইমারের দুর্দান্ত এক কর্নারে মাথা ঠেকিয়ে যেভাবে গোল করলেন, দেখলে যে কেউই আদর্শ স্ট্রাইকারের গোল বলবেন। কিন্তু বিপত্তি হলো, গোলটা হয়েছে আত্মঘাতী। গোল আটকাতে গিয়ে উল্টো ইউনাইটেডকে বিপদে ফেলে দেন মার্সিয়াল, পিএসজি ফেরে সমতায়।

গোল পেয়েছেন রাশফোর্ডও।
ছবি: রয়টার্স

তবে শেষ হাসি হেসেছে ইউনাইটেডই। ম্যাচের ৮৭ মিনিটে বিকল্প হিসেবে মাঠে নামা ফরাসি মিডফিল্ডার পল পগবার ছোট পাস ধরে দুর্দান্ত মুভমেন্ট আর গতিশীলতার পসরা সাজিয়ে নাভাসকে পরাস্ত করেন রাশফোর্ড। আর তাতেই নিশ্চিত হয়ে যায় নেইমার-এমবাপ্পেদের হার। গ্রুপের প্রথম ম্যাচ, তাঁর ওপর গ্রুপের সবচেয়ে কঠিন দলটার সঙ্গে তাঁদের মাঠেই খেলা। সব বাধা টপকেই জয় নিয়েই মাঠ ছাড়ে ইউনাইটেড।

গ্রুপের আরেক ম্যাচে জার্মানির ক্লাব আরবি লাইপজিগ ২-০ গোলে হারিয়েছে তুরস্কের ইস্তাম্বুল বাশেকশেহিরকে। জোড়া গোল করেছেন ম্যানচেস্টার সিটির সাবেক স্প্যানিশ লেফটব্যাক আনহেলিনো।