করোনাকালে অন্য রকম এক ফুটবল–ভ্রমণ

কাতার বিমানবন্দরে নামার পর বাংলাদেশ ফুটবল দলছবি: সংগৃহীত

দোহা বিমানবন্দরে দাঁড়িয়ে তাঁরা দিব্যি হিন্দি বলে চলেছেন। ‘এধার মে আও, পাসপোর্ট দেখাইহঙ্গে’–জাতীয় হিন্দি শুনে থমকে দাঁড়ান যাত্রী।

একটু আগে ঢাকা থেকে কাতার এয়ারওয়েজের যে ফ্লাইট দোহার হামাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে নামল, এর কিছুক্ষণ পর একঝাঁক বাংলাদেশি ক্রীড়া সাংবাদিকের চোখ বারবার আটকে যাচ্ছিল দোহা বিমানবন্দরের ওই কর্মীদের দিকে।

বেশির ভাগই ভারতীয়। ফাঁকে ফাঁকে বাংলাদেশি কর্মীও চোখে পড়ে। যাত্রীদের ব্যাগপত্তর দেখভালের দায়িত্বে থাকা নোয়াখালীর বেগমগঞ্জের এক তরুণ বাংলায় কথা বলছিলেন। বিদেশের মাটিতে বাংলা শুনতে ভালোই লাগে।

করোনাকালে খাঁ খাঁ ফাকা দোহা বিমানবন্দর
ছবি: লেখক

রোববার স্থানীয় সময় দুপুরে দোহা বিমানবন্দরে নামার পর থেকেই অবশ্য নানা নিরাপত্তাচৌকি পেরোতে পেরোতে রীতিমতো গলদঘর্ম অবস্থা।

বাংলাদেশের ১৭ জনের বিশাল সাংবাদিক বহর এসেছে বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপের বাছাইপর্বে ৪ ডিসেম্বর দোহায় বাংলাদেশ-কাতার ম্যাচ কাভার করতে। কিন্তু ম্যাচটা হচ্ছে ব্যতিক্রমী এক সময়ে; যখন কিনা অনেক বেশি কোভিড -১৯ সাবধানতা অবলম্বন করা প্রাত্যহিক জীবনেরই অংশ।

বিমানবন্দরে সেই সাবধানতা অনেক বেশি। সঙ্গে কাতার আসার ভিসার সঙ্গে ‘এক্সসেপশনাল এন্ট্রি পারমিট’ কাগজটি উল্টেপাল্টে দেখেন সংশ্লিষ্ট কর্মীরা। এই সময়ে কাতার সরকার দেশটিতে পেশাগত কাজ করতে বিশেষ ভিসা দিচ্ছে, যার নাম ইইপি। সেটিই মূলত দেখার পালা চলে কয়েক দফা।

তবে মহাগুরুত্বপূর্ণ কাজটি অন্য। বিমান থেকে নেমে আসার পর স্থানীয় দুই তরুণী ডাকতে থাকেন, ‘পথে আসুন, এ পথে আসুন।’

একজনের জ্যাকেটের পেছনে লেখা কাতার রেড ক্রিসেন্ট , তিনি সবার উদ্দেশে একটাই বাণী দেন, ‘ভাইসব, সবাই সিমকার্ড কিনুন। ওই যে ওখানটায় যান। সিমটি নিন। অ্যাক্টিভেট করুণ। নইলে কাতারের আপনি ঢুকতেই পারবেন না।’

কোভিড পরিস্থিতিতে কাতার আসা বিদেশি যাত্রীদের বিমানবন্দরে প্রথম কাজ সিমকার্ড কেনা (যার মূল্য ৩৫ কাতারি রিয়াল বা ১০ মার্কিন ডলার) বাধ্যতামূলক।

মুঠোফোনে প্রথমে একটি অ্যাপস ডাউনলোড করতে হবে। সেটিতে সিম নিবন্ধন করতে ভিসা নম্বর চায়। নম্বর দেওয়ার পর নিবন্ধন সম্পন্ন এবং ভ্রমণসংক্রান্ত কাগজপত্র বাছাইয়ের পর কোভিড নমুনা দিতে যাত্রীদের পাঠানো হয় নির্ধারিত কক্ষে।

দোহা বিমানবন্দরে করোনাকালে ভীষণ সাবধানতা অবলম্বন করা হয়েছে
লেখা: লেখক

এই পরীক্ষার ফল পরদিন মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে জানিয়ে দেওয়া হয় সরকারের তরফে। নির্ধারিত অ্যাপসে ফল আসে। সেই ফল দেখিয়েই আপনি হয়তো বাইরে কেনাকাটা করতে পারবেন।

ক্রীড়া সাংবাদিকদের জন্য অনেক দেনদরবারের পর কাতার সরকারের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নেওয়া হয়েছে যে কোভিড নেগেটিভ হলে কাজে নামা সম্ভব। অর্থাৎ বিশেষ অনুমতিতে কোয়ারেন্টিন মাত্র এক দিন। তবে অন্য পেশার ক্ষেত্রে সময়টা আরও বেশি।

কোভিড নমুনা দিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করে যখন বিমানবন্দর ত্যাগের পথ খোঁজা হচ্ছে, নিরাপত্তাকর্মী আটকে দেন বাংলাদেশি সাংবাদিক বহরকে। কাতার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে স্থানীয় কোনো প্রতিনিধি তখনো বিমানবন্দরে আসেননি।

স্থানীয় কেউ না এলে এই দলকে ছাড়া হবে না জানিয়ে দেন ওই কর্মী। ১৯ নভেম্বর বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলও সহজে পেরোতে পারেনি দোহা বিমানবন্দর। এ নিয়ে বাংলাদেশের দু–তিন ফুটবলারের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের বাগ্‌বিতণ্ডাও হয়েছে।

করোনার সতর্কতায় গোটা দুনিয়াই আসলে এখন বদলে গেছে। কাতার ব্যতিক্রম থাকবে কেন! পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মাথাপিছু আয়ের দেশটি বরং একটু বেশিই সতর্ক বিদেশি যাত্রীদের দোহায় প্রবেশের ক্ষেত্রে।

সে যা–ই হোক, সাংবাদিক বহর শেষ মুহূর্তে আটকে যাওয়া পর ফোনে যোগাযোগ করলে কাতার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পক্ষে কাতারে বসবাস করা এক বাংলাদেশি এলেন বিমানবন্দরে।

তাঁর সহায়তায় বিমানবন্দরে শেষ ধাপ পেরিয়ে দোহার মাটিতে পা রাখতেই দেখা গেল কেমন গুমোট পরিবেশ। বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব দোহার আকাশে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও হলো একটু। ছবির মতো সাজানো–গোছানো শহরটা বেশ লাগছিল সেই বৃষ্টিতে।

করোনার মধ্যে সাবধানতা অবলম্বন করে বিমানবন্দর ছাড়তে হয়েছিল জাতীয় দলের ফুটবলারদের
ছবি: লেখক

তবে সবকিছুই অনেকটা নীরব। কোভিড পরিস্থিতিতে খুব প্রয়োজন না হলে লোকে এখন বাসা থেকে কম বেরোয়। উপরন্তু, ভ্রমণের ওপর দেশে দেশে রয়েছে নানা বিধিনিষেধ।

তাই দোহা বিমানবন্দরে যাত্রী খুবই কম। বিশাল বিমানবন্দর অনেকটাই ফাঁকা। আগের সেই ব্যস্ততা হারিয়ে জায়গা নিয়েছে খানিকটা ভয়। কোভিড সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় বিমান সংস্থাগুলো নিয়েছে বাড়তি সতর্কতা।

ঢাকা থেকে বিমানে ওঠার সময়ই কাতার এয়ারওয়েজের কর্মীরা যাত্রীদের সবাইকে একটি করে ফেসশিল্ড দিলেন এবং এটি পরে থাকা বাধ্যতামূলক জানিয়ে দেন।

না পরলে জরিমানা বিধান আছে বলেও তাঁরা জানান। যাত্রীরা এর বরখেলাপ করে জরিমানা গোনার পাশাপাশি নিজেকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলতে চাইবেন কেন!

তবে শরীরের তাপমাত্রা মাপা হলো না কোথাও। এটাই আশ্চর্যের লাগল। কোভিড নেগেটিভ সনদ না হলে ভ্রমণ করা যাবে না—এটা জানাই। তবে সেই সনদ ঢাকায় শুধু এক জায়গায় দেখা হয়েছে। আর কোথাও দেখা হয়নি।

যদিও স্বাস্থ্যঝুঁকির বার্তাটাই সবার কাছে আজকের দিনে জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান বার্তা। দোহার হোটেলগুলোও তা মানছে ষোলো আনা। হোটেলে বুফে বন্ধ করে নতুন আসা অতিথিদের রুমে রুমে খাবার পৌঁছে দেন হোটেলকর্মীরা।

বাংলাদেশ দল দোহা এসে এই অভিজ্ঞতার মুখে পড়েছিল। অবশ্য এক দিন বাদেই হোটেল কর্তৃপক্ষকে বলেকয়ে ডাইনিংয়ে গিয়ে খাওয়ার অনুমতি মেলে বাংলাদেশ দলের। ফুটবলারদের চলাফেরা একেবারেই সীমিত। হোটেল আর মাঠেই আপাতত সীমাবদ্ধ জীবন।

বিমানবন্দরে সবাই মাস্ক পরিহিত। করোনা পাল্টে দিয়েছে পৃথিবী
ছবি: সংগৃহীত

দোহায় দেখা মেলে বাংলাদেশি অনেকের, যাঁরা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত। স্থানীয় পাঁচতারকা হোটেলে দেখা গেল কিরগিজস্তানের তরুণী অভ্যর্থনাকেন্দ্রে বসে কাজ করছেন। তাঁর সঙ্গী কর্মীটি পাকিস্তানের পেশোয়ারের তরুণ।

খানিক দূরে বাংলাদেশি কর্মী হোটেলে অন্য কোনো অভ্যর্থনা কাজে ব্যস্ত। রাতে খাবার রুমে রুমে পৌঁছে দিচ্ছেন বাংলাদেশি কর্মী। বাংলাদেশে না থেকেও বাংলাদেশের স্বাদ মেলে ঠিকই।

তবে করোনাকালে দোহায় ফুটবলের স্বাদ কতটা মিলবে, তা বোঝা যাবে আগামী কয়েক দিনে। যদিও ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক দেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তাই সবচেয়ে বেশি। তবে এখন সময়টা ভিন্ন।

আর ভিন্ন এই সময়ে ফুটবল-সফরও হচ্ছে ভিন্নভাবে। অন্য সময়ে চাইলেই যেখানে ইচ্ছা যাওয়ার সুযোগ ছিল; কিন্তু বদলে যাওয়া পৃথিবীতে সেটা আর সম্ভব নয়। দোহা হয়তো আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে, কিন্তু অলক্ষ্যে ঝুলিয়ে দিচ্ছে চলাফেরায় নানা বিধিনিষেধ।

এটাই আসলে আজকের পৃথিবী। তা সেটা করোনাকালের ফুটবল-ভ্রমণ হোক আর অন্য কিছু, তাতে কী!