কাতারে এক বাংলাদেশি রেফারির গল্প

সহকর্মীদের সঙ্গে রেফারি শিয়াকত আলী (ডান থেকে দ্বিতীয়)
ছবি: সংগৃহীত

কাতারে বিভিন্ন পেশায় যুক্ত আছেন অনেক বাংলাদেশি। তাঁদের মধ্যে আছেন একজন ফুটবল রেফারিও। শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের মোহাম্মদ শিয়াকত আলী কাতার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের একমাত্র তালিকাভুক্ত রেফারি।

গত ২৫ ও ২৮ নভেম্বর কাতারের স্থানীয় দলের সঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের দুটি প্রস্তুতি ম্যাচেই সহকারী রেফারি ছিলেন শিয়াকত।

চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়ার ছেলে শিয়াকত কাতারে আসেন ২০১৩ সালে। সেটা অবশ্য অন্য একটা পেশার ভিসায়। তখনো কাতারে রেফারি হিসেবে কাজ করবেন ভাবেননি তিনি। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, হয় আরেক।

শিয়াকতের জীবনে ভাগ্যের চাকা ঘুরে গেল দ্রুতই। তিনি জায়গা করে নিলেন কাতারের ধনাঢ্য ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম শ্রেণির রেফারি হিসেবে। ৩০ বছরে তরুণ নিজের অবস্থান শক্ত করে নিয়েছেন গত কয়েক বছরে।

দোহায় বসে আজ প্রথম আলোকে তিনি জানালেন ভিনদেশে রেফারি হয়ে ওঠার গল্প, ‘২০১৩ সালে অন্য একটি চাকরির ভিসায় দোহা এসে মাস দুয়েক ছিলাম এখানে থাকা আত্মীয়দের কাছে। ওই সময় বার্সেলোনার একটি প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচি চলছিল দোহায়। তাতে ১০ দিন প্রশিক্ষণ নিয়ে কোচ হিসেবে নিয়োগ পাই। সেখানে আসা কাতারের রেফারিদের বলি, আমি বাংলাদেশে খেলাধুলা করতাম। রেফারিংও করছি টুকটাক। সুযোগ পেলে রেফারিং করতে চাই।’

তারপর?

এখন রেফারিং নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটে শিয়াকতের।প্রতিদিনই খেলা আছে
ছবি: সংগৃহীত

শিয়াকত এগিয়ে নেন তাঁর গল্প, ‘ওরা কাতার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের ঠিকানা দিল। কাতার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের রেফারিং বিভাগের সিইও ১৯৯০ ও ১৯৯৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল পরিচালনা করা তিউনেশিয়ার রেফারি। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। কিছুদিন পর তিনি আমাকে ফোনে বলেন, “তোমাকে আমরা নেব। তবে একটা শর্ত। ছয় মাস প্রশিক্ষণ ও ক্লাস করতে হবে।” সেটা বিনা বেতনে। আমি রাজি হয়ে যাই।’

মানুষ তাঁর স্বপ্নের চেয়েও বড়—কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে শিয়াকত গর্বিত কণ্ঠে যোগ করেন, ‘এখানে রেফারিদের মাসিক বেতন আছে। একই সঙ্গে খেলা পরিচালনা করলে সম্মানি তো আছেই। বাংলাদেশে আমরা এটা ভাবতেই পারি না। আজ ভাবছি, আমি চ্যালেঞ্জ নিয়ে ভুল করিনি। আমি ভেবেছিলাম, আমি পারব। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে রেফারি হতে কাতার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনে পরীক্ষা দেয় নিউনেশিয়া, গাম্বিয়া, নাইজেরিয়া, সুদানসহ বিভিন্ন দেশের ১৬৫ জন রেফারি। আমি প্রথম হই।’

এখন রেফারিং নিয়েই ব্যস্ত সময় কাটে শিয়াকতের। এখানে বছরে ছয়-সাত মাস টানা ফুটবল ম্যাচ হয়। প্রতিদিনই খেলা আছে।

শিয়াকত বলছিলেন, ‘কাতারে ছোট–বড় ৪২টি লিগ হয়। অনূর্ধ্ব–৪-৬ থেকে শুরু। ৭-৯ বছরের একটা লিগ। ১০-১২ বছর বয়সীদের লিগ আছে। অনূর্ধ্ব-১৩ আলাদা লিগ। অনূর্ধ্ব-১৪, ১৫, ১৬, ১৭, ১৮, ১৯ এভাবে সব বয়সভিত্তিক লিগ হয়। তা ছাড়া স্থানীয় প্রেসিডেন্ট কাপ, আমির কাপ, কাতার সুপার কাপ, লিগ–১, লিগ-২, কাতারের শীর্ষ স্টারস লিগসহ অনেক আয়োজন। এ দেশের সাবেক তারকাদের কয়েকজনের নামেও লিগ আছে। শুধু খেলা আর খেলা।’

শিয়াকত সহকারী রেফারির দায়িত্ব বেশি পালন করলেও মূল রেফারির দায়িত্বও পান। বাংলাদেশের প্রস্তুতি ম্যাচ দুটিতে সহকারী রেফারি হিসেবে থাকতে পেরে তিনি খুশি। ম্যাচ দুটিতে মূল রেফারি ছিলেন কাতারের। যিনি একজন পুলিশ অফিসার।

আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্সের ম্যাচ পরিচালনা করছেন রেফারি শিয়াকত (ডানে)
ছবি: সংগৃহীত

শিয়াকতের সতীর্থ অন্য সহকারী রেফারি কাতারের এএফসি এলিট প্যানেলভুক্ত। তাঁদের সঙ্গে ম্যাচ পরিচালনা করে শিয়াকত গর্বিত, ‘আমার দেশের খেলা। ভিনদেশে সেই খেলা পরিচালনা করছি। ভাবতেই ভালো লাগে।’

কাতার ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের তালিকাভুক্ত ম্যাচ পরিচালনা তাঁর মূল দায়িত্ব। ফিফা রেফারি হওয়ার সুযোগ আপাতত নেই তাঁর। কারণ, এএফসিতে কাতারের কোটা ১৬ জন। তবে ফিফা আন্তর্জাতিক না হলেও ১৫০–এর ওপরে প্রীতি ম্যাচ চালিয়েছেন বলে জানান শিয়াকত।

রিয়াল মাদ্রিদ, এএস রোমা, এসি মিলানসহ অনেক বড় বড় ক্লাবের অনূর্ধ্ব-১৭ দল দোহায় আসে খেলতে। এই দলগুলোর ম্যাচ পরিচালনার অভিজ্ঞতা আছে তাঁর।আর্জেন্টিনার বোকা জুনিয়র্সের ম্যাচ পরিচালনা করছেন।

পাকিস্তান, ইরাক, ইরানের ম্যাচে থাকার সুযোগ হয়েছে। জানালেন, ‘কাতারে এখন পর্যন্ত বিভিন্ন স্তরে প্রায় দুই হাজার ম্যাচ পরিচালনা করেছি। সাত বছর ধরে কাতার মিলিটারি একাডেমির ম্যাচও পরিচালনা করছি।’

কাতারের ফুটবলে পরিচিত মুখ শিয়াকত আলী (সবার বামে)
ছবি: সংগৃহীত

শিয়াকত আজ এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা বলতে আসার আগেও কাতার আর্মির একটি ম্যাচ পরিচালনা করেন।

বাংলাদেশে হয়তো রেফারিদের সেভাবে সম্মান নেই। তবে কাতারে রেফারিং পেশাকে সবাই সম্মান করেন। পুলিশ কর্মকর্তা, সেনা কর্মকর্তারাও আছেন রেফারিদের তালিকায়। ‘তারা সম্মানের জন্য আসেন রেফারিংয়ে’, বলছিলেন গর্বিত বাংলাদেশি রেফারি শিয়াকত।

তবে প্রথম দিকে অবহেলার শিকার হয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশি হিসেবে সম্মান পেতেন না তেমন। সব বাধা জয় করে আজ শিয়াকত কাতারের ফুটবলে পরিচিতি পেয়েছেন। নিজেই বললেন, জীবনে এর চেয়ে বেশি কিছু চাইতে পারতেন না, ‘অনেক সুযোগ–সুবিধা পাই এখানে। আমার জীবনই আসলে বদলে গেছে। এর বেশি কিছু চাওয়ার ছিল না।’

শিয়াকত হতে পারেন আজকের তরুণদের জন্য বড় প্রেরণা।