কার ট্রফি ওঠে কার হাতে?

ক্লাব কর্মকর্তাদের হাতে ট্রফি তুলে দিচ্ছেন বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন।
ছবি: বাফুফে

ওই ম্যাচের স্মৃতি আজও ভুলতে পারেননি বাংলাদেশ জাতীয় দলের মিডফিল্ডার জাফর ইকবাল। ২০১৫ সালে খেলতেন দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের হয়ে। তৃতীয় বিভাগের ম্যাচ ছিল সেটি। চ্যাম্পিয়ন হয়ে দ্বিতীয় বিভাগে উঠতে হলে বিকেএসপির বিপক্ষে ড্র করলেই চলতো জাফরদের। ড্র নয়, জিতেই চ্যাম্পিয়নের উৎসব করেছিল দিলকুশা স্পোর্টিং। অবশ্য সেই উৎসবটা ছিল একেবারে সাদামাটা।

সেদিন যে কোনো ট্রফিই দেওয়া হয়নি মাঠে! ক্লাব কর্মকর্তারা আশায় থাকতেন, ফুটবল ফেডারেশন হয়তো কোনো একদিন ডেকে ট্রফি তুলে দেবে খেলোয়াড়দের হাতে। ফুটবলাররা আশায় থাকতেন সেই ট্রফি নিয়ে এক রাতে ‘পার্টি’ করবেন। উৎসবে মাতবেন। ট্রফি জড়িয়ে তুলবেন সেলফি। সে অপেক্ষায় একে একে কেটে গেছে পাঁচটি বছর।

পাঁচ বছরে ফুটবল ফেডারেশনে জমে ছিলমোট ২৩টি ট্রফি।

অবশেষে কাল বাফুফে ভবনে ঘটা করে ট্রফি তুলে দেওয়া হয়েছে সে বছরের তৃতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হওয়া দিলকুশা স্পোর্টিং ক্লাবের কর্মকর্তাদের হাতে। শুধু দিলকুশা নয়, গত পাঁচ বছরে জমে থাকা বিভিন্ন লিগের চ্যাম্পিয়ন-রানার্স আপ ক্লাবগুলো পেয়েছে তাদের প্রত্যাশিত সব ট্রফি। পাঁচ বছরে ফুটবল ফেডারেশনে প্রিমিয়ার লিগ, চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ, সিনিয়র ডিভিশন, প্রথম বিভাগ, দ্বিতীয় বিভাগ, তৃতীয় বিভাগের চ্যাম্পিয়ন ও রানার্স আপ মিলিয়ে মোট জমে ছিল ২৩টি ট্রফি।

ট্রফি বিতরণ অনুষ্ঠানে ছিলেন না কোনো ফুটবলার। ক্লাব কর্মকর্তারা এভাবে ট্রফি নিতে এসে বেশ বিব্রতই হয়েছেন। যাঁদের অবদানে এই ট্রফিটা জিতেছেন, সেই ফুটবলারদের ছাড়া এভাবে অনুষ্ঠানে এসে সময়টা মোটেও উপভোগ করতে পারেননি কর্মকর্তারা। দিলকুশার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নানের কণ্ঠে হতাশার সুর, ‘আমরা এভাবে ট্রফি নিতে চাইনি। আমাদের চ্যাম্পিয়ন করেছে যে খেলোয়াড়েরা, তাদের পাঁচজন এখন জাতীয় দলে খেলে—আবদুল্লাহ, সুফিল, জাফর, নাসির, আরিফ ও রবিউল। তাদের কাউকেই আজ আনতে পারিনি। তারা যদি আজ এখানে থাকত, তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যদি ট্রফিটা পেতাম, তাহলে যে আনন্দ পেতাম, তার কিছুই আজকে পাচ্ছি না।’

আমাদের ইচ্ছা ছিল শেষ ম্যাচটা খেলে যেন ট্রফিটা হাতে নিতে পারি। ট্রফি না পেয়ে সেদিন মন খারাপ করে ক্লাবে গিয়েছিলাম
রবিউল ইসলাম, জাতীয় দলের মিডফিল্ডার

মতিঝিলে যখন ট্রফি বিতরণ অনুষ্ঠান চলছিল, টাঙ্গাইলে ছুটি কাটাচ্ছেন জাতীয় দলের মিডফিল্ডার রবিউল ইসলাম। ঢাকার ফুটবলে রবিউলের প্রথম ক্লাবই দিলকুশা স্পোর্টিং। যে ক্লাবের হয়ে খেলে আজ জাতীয় দলে ঢুকেছেন, সেই ক্লাবের সঙ্গে মিশে আছে রবিউলের অনেক হীরন্ময় স্মৃতি। ক্লাবকে সেবার চ্যাম্পিয়ন করতে সেবার রবিউল দারুণ খেলেছেন। ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রফিটা জিতে অনেক আনন্দ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই সুযোগটা হয়নি। অবশেষে ট্রফি পাওয়ার খবরটা শুনে যেন ফিরে গেলেন ফেলে আসা দিনগুলোয়, ‘ওটা ছিল ফুটবল ফেডারেশনের অধীনে আমার ফুটবল ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রফি। এরপর আমি আরামবাগের হয়ে স্বাধীনতা কাপ চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। ফেডারেশন কাপে বসুন্ধরার হয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। কিন্তু ওই ট্রফিটা জেতার আলাদা আনন্দ ছিল।’

ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখতে না পারার কষ্ট ঝরল মুঠোফোনের অন্য প্রান্তে থাকা রবিউলের কন্ঠে, ‘সত্যি বলতে আমরা সবাই ট্রফির জন্যই খেলি। সবার লক্ষ্য থাকে যেন ভালো একটা অর্জন ক্লাবকে এনে দিতে পারি। সেবার স্বপ্নের মতো লিগ শেষ হয়েছিল। কিন্তু মাঠে ট্রফি নিয়ে উদযাপন করতে পারলাম না। কষ্টটা মনের মধ্যে রয়েই গেছে। আমাদের ইচ্ছা ছিল শেষ ম্যাচটা খেলে যেন ট্রফিটা হাতে নিতে পারি। ট্রফি না পেয়ে সেদিন মন খারাপ করে ক্লাবে গিয়েছিলাম।’ শেষ পর্যন্ত যে বাফুফে ট্রফি দিয়েছে এতেই খুশি রবিউল, ‘ওই সময়ে ট্রফিটা পেলে যে আনন্দ পেতাম এখন তো আর সেটা হবে না। তারপরও শেষ পর্যন্ত ট্রফিটা পেয়েছি এতেই খুশি।’

এভাবে ট্রফি নিতে চাননি ক্লাব কর্মকর্তারা। আজ বাফুফে ভবনে।
ছবি: বাফুফে

একটা ট্রফি শুধুই একটা ধাতব পদার্থ নয়, এর সঙ্গে মিশে থাকে একজন খেলোয়াড়ের অনেক আনন্দ–বেদনার কাব্য। ট্রফিটা কখনো কখনো হয়ে ওঠে ওই খেলোয়াড়ের পরে আরও ভালো খেলার অনুপ্রেরণা। ইউরোপ, দক্ষিণ আমেরিকা বলুন বা অন্য যে কোনো জায়গায়, খেলা শেষে মাঠে ট্রফি দেওয়াই নিয়ম। জাতীয় দলের গোলরক্ষক আশরাফুল ইসলাম তাই মাঠেই ট্রফি দেওয়ার সংস্কৃতি চালু করার দাবি করলেন, ‘আসলে মাঠের উদযাপন একরকম, আর মঞ্চের উদযাপন আরেক রকম। আমার মনে হয় মাঠের খেলা শেষ হওয়ার পরপরই মাঠে ট্রফি দিয়ে দেওয়া উচিত। এই ট্রফিটা খেলোয়াড়ের পারফরম্যান্সের অনুপ্রাণিত করে। ট্রফির প্রতি সম্মান রাখতেই তাঁর দায়িত্ববোধ বেড়ে যায়। তাছাড়া ট্রফি হাতে যখন কোনো খেলোয়াড় ছবি বা সেলফি তোলে ওই সময়ের আনন্দ বলে ব্যাখ্যা করা যাবে না। ওই সময় পৃথিবীর সবচেয়ে রোমাঞ্চিত মানুষ থাকে একজন খেলোয়াড়।’

জাতীয় দলের মিডফিল্ডার জাফর ইকবাল ২০১৫ সালে লিগে দিলকুশার জার্সিতে ছয়বার হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। ১১ গোল করে লিগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা হয়েছিলেন। সেবারের লিগের পারফরম্যান্স দেখেই তাকে পরের মৌসুমে দেশের শীর্ষ পেশাদার লিগে খেলার সুযোগ করে দিয়েছিল আরামবাগ। এরপর আরামবাগ থেকে চট্টগ্রাম আবাহনী হয়ে জাফর ইকবাল বর্তমানে সাইফ স্পোর্টিংয়ের ফুটবলার। কিন্তু ঢাকার ফুটবলে দিলকুশা স্পোর্টিং যেন জাফরের কাছে প্রথম প্রেমের মতো।

মাঠের ট্রফিটা মাঠে পেলে অনেক খুশি হতাম। কিন্তু সেটা হলো না। এই কষ্ট বলে বোঝাতে পারব না
জাফর ইকবাল, জাতীয় দলের মিডফিল্ডার

সেই ক্লাবের হয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার ট্রফিটা নিতে না পারার আক্ষেপ এখনও রয়ে গেছে জাফরের, ‘ওই সময় আমরা বয়সে অনেক ছোট ছিলাম। সবার জীবনে স্বপ্ন থাকে যেন সে প্রথমবার জাতীয় পর্যায়ের লিগে খেলেই চ্যাম্পিয়ন হতে পারে। আমরা সেবার দুর্দান্ত খেলেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। কিন্তু ট্রফিটা মাঠ থেকে নিতে পারিনি। মাঠের ট্রফিটা মাঠে পেলে অনেক খুশি হতাম। কিন্তু সেটা হলো না। এই কষ্ট বলে বোঝাতে পারব না।’
জাফর কদিন পর পরই ক্লাব কর্মকর্তাদের কাছে খোঁজ নিতেন ট্রফির ব্যাপারে, ‘আমরা প্রায়ই অফিশিয়ালদের কাছে বলতাম, স্যার কবে ট্রফি পাব? উনারা বলতেন, ট্রফিটা পেলেই একটা অনুষ্ঠান করব তোমাদের নিয়ে। পাঁচ বছরে সেই অনুষ্ঠানে আর যাওয়া হলো না।’

বর্তমানে বান্দরবানে নিজের বাড়িতে সময় কাটছে জাফরের। ট্রফি বিতরণের খবরটা কালই শুনেছেন। এবার ঢাকায় এসে ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছা জাফরের, ‘ক্যারিয়ারের প্রথম ট্রফি বলে কথা! এটা আমার কাছে অনেক আবেগের ট্রফি। ঢাকায় ফিরে প্রথমেই ক্লাবে যাব। ট্রফিটা ছুঁয়ে দেখব। ট্রফি সামনে করে ছবি তুলব।’