কিংবদন্তিদের এমন বিদায় বার্সেলোনায় নতুন নয়

বার্সেলোনা থেকে বিদায় কারওরই খুব সুখকর ছিল না।ফাইল ছবি

মেসি ও বার্সেলোনার দ্বন্দ্ব চমকে দিয়েছে সবাইকে। ক্লাবের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা খেলোয়াড় ক্লাব ছাড়তে চাইছেন, ওদিকে বার্সেলোনা তাঁকে সহজে যেতে দিতে রাজি নয়। একদিকে ক্লাব অসম্ভব এক মূল্য সেঁটে দিয়েছে যাতে মেসিকে কেউ নিতে না পারে, ওদিকে অধিনায়কের দাবি চুক্তির শর্তানুযায়ী মুফতেই ছাড়তে পারবেন ক্লাব। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাপারটা আদালতে না গড়ায়, এমন শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন সমর্থকেরা।

ক্লাব পরিচালনা নিয়ে ক্ষোভ থেকে মেসির বিদায় নেওয়ার এ সিদ্ধান্তে অবশ্য বিস্মিত নন কেউ। বরং ক্লাবকে নিজের সর্বস্ব দেওয়া এক খেলোয়াড়ের ইচ্ছা পূরণ না করে কেন জল ঘোলা করছে বার্সেলোনা, এ নিয়েই আপত্তি জানাচ্ছেন অনেকেই। কারও অনিচ্ছায় ক্লাবে রেখে দিয়ে লাভ হয় কখনো। আর সেটা যদি হয় মেসির মতো তারকা, তাহলে তো সেটা আরও অসম্ভব এক চেষ্টা। বরং এমন টানাহেঁচড়া ১৯ বছর ধরে গড়ে ওঠা এক সম্পর্কের শেষটায় কালি লেপে দেওয়া হচ্ছে।

বিস্ময়কর হলো, মেসি বলেই ব্যাপারটা চোখে লাগছে বেশি। না হলে ক্লাব কিংবদন্তিদের সঙ্গে বার্সেলোনার অতীত ইতিহাস কিন্তু বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। চলুন দেখে নেওয়া যাক ক্লাবের সেরা সব তারকাদের সঙ্গে কেমন আচরণ করেছে বার্সেলোনা—

ডিয়েগো ম্যারাডোনা
সময়ের সেরা খেলোয়াড়কে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে নিয়ে এসেছিল বার্সেলোনা। কিন্তু মাত্র দুই বছর টিকতে পেরেছিলেন ম্যারাডোনা। রিয়াল মাদ্রিদের মাঠে এমনই এক ম্যাচ খেলেছিলেন, শত্রুতা ভুলে বার্নাব্যুর গ্যালারি উঠে দাঁড়িয়েছিল তাঁর সম্মানে। কিন্তু বোর্ডের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় ১৯৮৪ সালে নাপোলিতে গিয়েই সাম্রাজ্য গড়েছেন ম্যারাডোনা।


বার্নড সুস্টার
এই জার্মান মিডফিল্ডারে মুগ্ধ ছিল বার্সেলোনা সমর্থকেরা। কিন্তু তাঁকেও ক্লাব থেকে সুন্দরভাবে বের হতে দেয়নি বার্সেলোনা। ১৯৮৬ ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে গোলশূন্য সমতার দিকে এগোচ্ছিল ম্যাচ। স্টুয়া বুখারেস্টের বিপক্ষে সে ম্যাচে পেনাল্টিতে প্রথম শট নেওয়ার কথা ছিল তাঁরই। কিন্তু ৮৫ মিনিটে তাঁকে তুলে নেন ম্যানেজার। শুটআউটে চারটি শটের একটিও কাজে লাগাতে না পেরে ২-০ ব্যবধানে হেরেছিল বার্সা। সেটা অবশ্য সুস্টার মাঠে বসে দেখেননি। রেগেমেগে মাঠ ছেড়ে হোটেলে গিয়েই দেখেছেন ম্যাচের বাকি অংশ। ক্লাব সভাপতি সেদিনই তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। বার্সেলোনা ছেড়ে সরাসরি রিয়ালে গিয়েছিলেন সুস্টার।

মাইকেল লাউড্রপ
আরেক খেলোয়াড় যিনি ক্লাবের ওপর রাগ করে রিয়ালে গিয়েছিলেন। এবারে ঝামেলার সূত্রপাত অবশ্য কোচ ইয়োহান ক্রুইফ। তাঁর সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় রিয়ালে যান ক্রুইফ। টানা চার বছর বার্সাকে লিগ জেতানো স্ট্রাইকার পরের মৌসুমেই রিয়ালকেও এনে দিয়েছিলেন লিগ!

রোমারিও
বার্সেলোনা ও ব্রাজিলিয়ান ফুটবলারদের দ্বন্দ্বের গল্পের প্রথম পর্ব এটি। প্রথম মৌসুমে লিগে ৩০ গোল করা রোমারিও বিশ্বকাপ জেতার পর দ্বিতীয় মৌসুমে বাড়তি ছুটি নিয়েছিলেন। ফলে প্রাক-মৌসুমে দেরি করে ফিরেছেন ক্লাবে। কোচ ক্রুইফের সঙ্গে এ নিয়ে ঝামেলা হওয়ায় দ্বিতীয় মৌসুমের মাঝপথে ক্লাব ছেড়ে দেন।

রোনালদো
‘দ্য ফেনোমেনন’ যা করেছিলেন সেটা ওই যুগে কেউ কল্পনা করতে পারত না। ১৯৯৬ সালে প্রথম মৌসুমেই ৪৯ ম্যাচে ৪৭ গোল করেছিলেন রোনালদো। বার্সেলোনাতেই থাকার ইচ্ছা ছিল তাঁর। কিন্তু ইন্টার মিলানের কাছ থেকে বিশ্ব রেকর্ড গড়া এক প্রস্তাব পেয়ে বিক্রি করে দেয় তাঁকে বার্সা। সেই রোনালদো পরে শুধু রিয়ালে যোগই দেননি, পরবর্তীতে নিজেকে রিয়ালের কিংবদন্তি হিসেবেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। বার্সেলোনার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক চুকে গিয়েছিল ১৯৯৭ সালেই।

লুইস ফিগো
বার্সেলোনার সেরা খেলোয়াড় ছিলেন। কদিন আগেও বলেছিলেন সেখানেই থাকবেন। এমন এক খেলোয়াড় কিনা আচমকা রিয়ালের হয়ে গেলেন দলবদলের মৌসুম শুরু হতেই। বেতন নিয়ে বার্সেলোনার সঙ্গে সমঝোতা না হওয়াতেই নাকি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের পক্ষে ফিগোকে টেনে নেওয়া সম্ভব হয়েছিল। সেটা অবশ্য দলবদলের বিশ্ব রেকর্ড গড়েই।

রোনালদিনহো
বার্সেলোনার দ্বিতীয় খেলোয়াড় যিনি রিয়ালের মাঠে এসে দর্শকের অভিবাদন পেয়েছেন। রোনালদিনহোর আবির্ভাব ক্লাবকে অন্য উচ্চতায় তুলেছিল। কিন্তু তাঁর উদ্দাম রাত্রি-জীবন বার্সেলোনার পক্ষে আর মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। পেপ গার্দিওলার আবির্ভাব তাঁকে এসি মিলানে ঠাঁই নিতে বাধ্য করে।

জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ
সদ্য ট্রেবলজয়ী স্যামুয়েল ইতোর সঙ্গে আরও ৭৮ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে তাঁকে এনেছিল বার্সেলোনা। টিকেছেন মাত্র এক মৌসুম। গার্দিওলার সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে এক মৌসুম পরই মাত্র ২৪ মিলিয়নে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হয় বার্সেলোনা।

নেইমারকে বার্সেলোনায় ফেরাতে না পারা রাগিয়েছে মেসিকে।
ফাইল ছবি

দানি আলভেজ
মৌসুম প্রতি ট্রফির হিসেবে এই ব্রাজিলিয়ান রাইটব্যাক বার্সেলোনার ইতিহাসের সেরা খেলোয়াড়। মাত্র ৮ মৌসুমে ২৩টি ট্রফি জিতেছেন। ক্লাব কিংবদন্তির বিদায়টা হয়েছে বেশ দুঃখজনকভাবে। তাঁর ক্লাব ছাড়ার ইচ্ছে না থাকলেও বারবার এমন গুঞ্জন উঠেছে। ক্লাব কখনো তাঁকে চুক্তি নবায়নের প্রস্তাব দেয়নি। দলবদলের নিয়ম ভাঙায় শাস্তি পাওয়ার পর টনক নড়ে ক্লাবের। তখন আলভেজের সঙ্গে চুক্তি নবায়নের চেষ্টা চালায় বার্সেলোনা। কিন্তু ক্ষিপ্ত আলভেজ ২০১৫-১৬ মৌসুম শেষে ক্লাব ছেড়ে জুভেন্টাসে চলে যান। এখনো সুযোগ পেলেই বার্সেলোনার পরিচালকদের দুকথা শুনিয়ে দেন আলভেজ। তারা নাকি খেলোয়াড়দের মানুষ মনে করে না!

নেইমার
নেইমারের ঘটনায় অবশ্য বার্সেলোনার দায় খুব কম ছিল। মেসির ছায়ায় থাকতে রাজি না হওয়া ও নিজেই সর্বেসর্বা হওয়ার আশায় পিএসজিতে গিয়েছেন নেইমার। দলবদলের বিশ্ব রেকর্ড গড়া সে ঘটনায় রিলিজ ক্লজের অর্থ দেওয়ায় বার্সেলোনার পক্ষে সে দলবদল আটকানো সম্ভব ছিল না। কিন্তু এর পর দুই পক্ষই একে অপরের বিপক্ষে মামলা করে জল আরও ঘোলা করেছেন। নেইমার যখন আবার বার্সেলোনায় ফিরতে চেয়েছেন, তখন মেসির আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও নেইমারের দলবদলকে প্রাধান্য নাদিয়ে আঁতোয়ান গ্রিজমানকে কিনেছে বার্সেলোনা। যে দলবদল শেষ পর্যন্ত মেসির ক্লাব ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পেছনে কিছুটা হলেও ভূমিকা রেখেছে।