কিয়েভ থেকে রিও—ব্রাজিলের ১১ ফুটবলার যেভাবে প্রাণ নিয়ে দেশে ফিরলেন

শাখতার দোনেস্কের ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার দোদো সাও পাওলোর বিমানবন্দরে নামার পর তাঁকে জড়িয়ে ধরেন এক স্বজনছবি: এএফপি

সপ্তাহখানেক আগেও মারলন সান্তোসের সব ভাবনা ছিল ইউক্রেনিয়ান লিগের দ্বিতীয় ভাগের ম্যাচ নিয়ে। শাখতার দোনেৎস্কের ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার তুরস্কে মধ্যমৌসুম প্রস্তুতি ক্যাম্প শেষে ২০ ফেব্রুয়ারি দলের সঙ্গে কিয়েভে ফিরেছেন। তখন কী আর জানতেন, চার দিন পর তাঁদের দুনিয়া এভাবে উল্টেপাল্টে যাবে!

কিয়েভে তাঁরা ফেরার চার দিন পর রাশিয়ান বাহিনী কিয়েভে বোমা হামলা শুরু করলে ইউক্রেনের লিগগুলো স্থগিত হয়ে যায়। ৩০ দিনের জন্য লিগগুলো শেষ করার পেছনে হয়তো ইউক্রেনের ফুটবল কর্তৃপক্ষের আশা ছিল, আলোচনা শেষে যুদ্ধ থেমে যাবে।

কোথায় কী! রুশ বাহিনীর হামলা দিন দিন আরও বাড়ছে, ইউক্রেনিয়ানরাও পাল্টা জবাবের পথ খুঁজছে। এত সবের মধ্যে জীবনই যেখানে সংশয়ে, সেখানে ফুটবল কোন ছার!

মারলন, শাখতারে তাঁর সতীর্থ ১১ ব্রাজিলিয়ান আর লাখো ইউক্রেনিয়ানের জন্য দুঃস্বপ্নের সেটি ছিল শুরু।

‘পরিস্থিতির বর্ণনায় একটা শব্দই বলা যায়, বিশৃঙ্খলা’—গত বৃহস্পতিবার কিয়েভে নিজেদের হোটেলের বেজমেন্টে বাংকারে থাকা অবস্থায়ই স্প্যানিশ দৈনিক মুন্দো দেপোর্তিভোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এ কথা বলেছিলেন বার্সেলোনার সাবেক ডিফেন্ডার মারলন। রাশিয়ান বোমা আর আর্টিলারি থেকে বাঁচতে সেখানেই কিছুটা ‘নিরাপদ’ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছিলেন তাঁরা।

কিন্তু সে তো ঠেকায় কাজ চালানো, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা সেখানে সাময়িক। মারলনের কণ্ঠে তখন ছিল আকুতি, ‘হোটেলে আমরা নিরাপদেই আছি, কিন্তু একটা সমাধান তো লাগবে। খুবই বাজে একটা অবস্থা এখানে। ভয়ে আছি আমরা। এখানে আমাদের পরিবার, সন্তান, সঙ্গী। আমার শাশুড়িও এখানে। আমরা শুধু নিরাপদ জায়গায় যেতে চাই।’

ইউক্রেন থেকে দেশে ফেরার পর সংবাদমাধ্যমে কথা বলেন ব্রাজিলিয়ান ফুটবলার ফের্নান্দো
ছবি: এএফপি

পাঁচ দিন পর মারলন ও তাঁর ব্রাজিলিয়ান সঙ্গীদের চাওয়া পূরণ হয়েছে। রিও ডি জেনিরোর গ্যালিয়াও বিমানবন্দরে নেমেছে তাঁদের বিমান। শাখতারে মারলনের ব্রাজিলিয়ান সতীর্থদের পাশাপাশি নিরাপদে ইউক্রেন ছাড়তে পেরেছেন দুই আর্জেন্টাইন ক্লদিও স্পিনেল্লি ও ফ্রান্সিসকো ডি ফ্রাঙ্কোও। কিন্তু কিয়েভ থেকে রিওর এ যাত্রাপথ মোটেও স্বস্তির ছিল না! যুদ্ধক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে যাত্রার প্রতিটি সেকেন্ডে ভয় যে ঘিরে ছিল তাঁদের।

হোটেলের বাংকারে দুদিন কাটানোর পর একটা ট্রেনে চেপে কিয়েভ থেকে ইউক্রেনের দক্ষিণ-পশ্চিমে চেরনিভসিতে গেছেন মারলনরা। ট্রেন স্টেশনে যাওয়ার পথে গাড়ির জানালার বাইরে ব্রাজিলের পতাকা ঝুলিয়ে রেখেছিলেন, যাতে যুদ্ধরত দুই পক্ষই বোঝে, তাঁরা নিরপেক্ষ। চেরনিভসি থেকে বাসে চেপে মলদোভা, সেখান থেকে রোমানিয়া। দক্ষিণ আমেরিকার বিমানে মারলনরা উঠতে পেরেছেন রোমানিয়া থেকেই।

যাত্রাপথে প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁদের সাহায্য করার জন্য ব্রাজিলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আর উয়েফার কাছে মারলনের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। উয়েফা সভাপতি আলেক্সান্দর সেফেরিন নিজে হস্তক্ষেপে নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছেন, যাতে যাত্রাপথে এই ব্রাজিলিয়ানদের কোনো বিপদে পড়তে না হয়। তবু অজানা আশঙ্কা তো থাকেই! যাত্রাপথে প্রতিটি মুহূর্তে সে আশঙ্কা কতটা ঘিরে ছিল তাঁদের, ব্রাজিলে পৌঁছানোর পর সেটি জানা গেছে মারলনের কাছ থেকে, ‘প্রতিটি মুহূর্তে সেনাদের সামনে পড়ার ভয় ছিল, দ্রুত এ থেকে মুক্তির মরিয়া ভাব ছিল। চারপাশে গোলা বর্ষিত হচ্ছে, বোমা ফাটছে...দুঃস্বপ্ন!’

ব্রাজিলিয়ান ফুটবলাররা দেশে ফেরার পর বিমানবন্দরে এমন দৃশ্যের অবতারনা হয়
ছবি: এএফপি

তবে এ দুঃস্বপ্নের সময়ে এক সতীর্থকে নায়ক হতেও দেখেছেন মারলন। জুনিয়র মোরায়েস। ব্রাজিলেই জন্ম তাঁর, কিন্তু ইউক্রেনের এক্লাব-ওক্লাবে সেই ২০১২ সাল থেকে খেলার সুবাদে ২০১৯ সালের মার্চে জাতীয়তা বদলে ইউক্রেনিয়ান বনে যান মোরায়েস। ইউক্রেন জাতীয় দলের হয়ে ১১টি ম্যাচও খেলেছেন। কিন্তু জাতীয়তা বদলানোতেই উল্টো এখন ঝামেলায় পড়তে যাচ্ছিলেন ৩৪ বছর বয়সী মোরায়েস। স্থানীয় প্রশাসন যে ডিক্রি জারি করেছিল, ১৮ থেকে ৬০ বছর বয়সী প্রত্যেক সুস্থ সবল পুরুষকেই যুদ্ধে যেতে হবে। কেউই দেশ ছাড়তে পারবেন না!

অনেক লুকোচুরি করে মোরায়েস অবশ্য ইউক্রেন ছাড়তে পেরেছেন। আর ইউক্রেন থেকে বেরোনোর আগপর্যন্ত মোরায়েসের অনর্গল ইউক্রেনিয়ান ভাষা বলতে পারাই মারলনদের অনেক কাজে এসেছে, ‘কেউ কেউ নিজেকে ঝুঁকিতে ফেলেও অন্যের উপকার করেন, জুনিয়র মোরায়েস তাঁদের একজন। (কিয়েভে থাকার সময়ে) ও-ই বাইরে গিয়ে শিশুদের জন্য খাবার ও কম্বল জোগাড় করে এনেছে। সেটা আমাদের কিছুটা শান্তি দিয়েছে।’

ফুটবলারদের ফিরে পেয়ে স্বস্তি পেয়েছেন স্বজনরা
ছবি: এএফপি

মোরায়েস অবশ্য পরে ইউক্রেন সরকারকে ৫০ হাজার ডলার অনুদান দিয়েছেন। উয়েফা সভাপতি সেফেরিনের সঙ্গে তাঁর ফোনকলের কথাও যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক টাইমসে আলাদা করে বলেছেন মোরায়েস। কিয়েভে দুঃস্বপ্নের সময়ে সেফেরিনের সঙ্গে ফোনালাপই নাকি মোরায়েসের কাছে ‘ওই তিন মিনিটই ছিল আমার জীবনের সর্বশেষ ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সবচেয়ে শান্তির সময়।’