কে বলবে সাইফের মিডফিল্ডে জামাল নেই?

সাইফের খেলোয়াড়দের গোলের উচ্ছ্বাস।ছবি: প্রথম আলো

জামাল ভূঁইয়া নেই! জামাল ভূঁইয়া খেলবেন না!

এবার ফেডারেশন কাপে সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব পাচ্ছে না অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়াকে। দলের সবচেয়ে বড় তারকা তিনি, সাইফ তো বটেই, জাতীয় দলেরই সবচেয়ে বড় তারকা। এবার সেই তারকাই দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে গিয়েছেন বাইরে, কলকাতা মোহামেডানের হয়ে এবার খেলবেন তিনি। জামালবিহীন মিডফিল্ডের রসায়নটা কেমন হবে সাইফের? জানার আগ্রহ তো সবার ছিলই। ফেডারেশন কাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে সাইফের জামালবিহীন মিডফিল্ড যেভাবে খেলল, তাতে আশাবাদী হওয়ার যথেষ্টই কারণ আছে।

জামালের অভাব পূরণ করতে এশিয়ান কোটায় দলে নেওয়া হয়েছিল উজবেকিস্তানের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার সিরোজিউদ্দিন রাখমাতুলেভকে। সেই রাখমাতুলেভই ম্যাচসেরা! বুঝে নিন, সাইফের মিডফিল্ড আদৌ জামালকে ‘মিস’ করেছে কি না!

বসুন্ধরা কিংস-রহমতগঞ্জের মধ্যকার উদ্বোধনী ম্যাচের মতো এই ম্যাচেও দুই দল অনুসরণ করেছিল চেনা সূত্র। আগের ম্যাচে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দল বসুন্ধরা খেলেছিল ৪-৩-৩ ছকে, এ ম্যাচে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী দল সাইফও তাই। নতুন কোচ পল পুট খেলিয়েছিলেন অনেকটা ৪-৩-৩ ছকে, আক্রমণে যা প্রায়ই ২-৩-৫–এর মতো রূপ নিচ্ছিল।

ওদিকে আগের ম্যাচের ‘আন্ডারডগ’ রহমতগঞ্জের মতো এ ম্যাচের ‘আন্ডারডগ’ উত্তর বারিধারার কৌশলকেও মনে হয়েছে অনেকটা প্রতিআক্রমণনির্ভর। বল পায়ে অনেক সময় ৩-৪-৩ কিংবা ৩-৫-২ ছকের মতো মনে হলেও বারিধারার মূল পরিকল্পনা ছিল সাইফের আক্রমণ সামলে হুট করে প্রতিআক্রমণে কোনো কিছু একটা ঘটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা।

রহমতগঞ্জের তিনজন বিদেশি ছিল না, উত্তর বারিধারার সেই সমস্যা নেই। দুই ম্যাচের স্কোরলাইন সমান হলেও রহমতগঞ্জের চেয়ে তাই তুলনামূলক ভালো খেলেছে বারিধারা। আর এই ভালো খেলার জন্য সবচেয়ে বড় ধন্যবাদটা প্রাপ্য দলের মিসরীয় ফরোয়ার্ড মোস্তফা মাহমুদ খালেকের।

জামাল ভূঁইয়ার অভাব বুঝতেই দেয়নি সাইফ।
ছবি: প্রথম আলো

মোহাম্মদ সালাহর দেশের এই খেলোয়াড় আক্রমণভাগের প্রায় সব জায়গাতেই ছিলেন গোটা ম্যাচজুড়ে। কখনো বাঁ উইংয়ে, কখনো ডান উইংয়ে, কখনো সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে কিংবা কখনো পুরোদস্তুর স্ট্রাইকারের মতো সাইফকে কাঁপানোর চেষ্টা করেছেন।

কিন্তু অল্প প্রস্তুতিতে ম্যাচ খেলতে নামলে যা হয়। মাত্র আট-দশ দিনের প্রস্তুতিতে খেলতে নামা বারিধারার আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের মধ্যে বোঝাপড়ার যথেষ্ট অভাব দেখা যাচ্ছিল।

জাতীয় দলের স্ট্রাইকার সুমন রেজা যে খারাপ খেলেছেন, বলা যাবে না। তবে মোস্তফা মাহমুদের সঙ্গে তাঁর, কিংবা আক্রমণভাগের আরেকজন—প্রথমার্ধে সুজন বিশ্বাস ও দ্বিতীয়ার্ধে নয়ন মিয়ার বোঝাপড়ার অভার ছিল স্পষ্ট। অনেক সময় দেখা গেছে সুমন কিংবা মোস্তফা আক্রমণভাগের একই দিকে চলে আসছেন, ফলে আরেক পাশ ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে। আবার কখনো দুর্দান্ত কোনো প্রতিআক্রমণে সাইফের দু-একজন ডিফেন্ডারকে ব্যস্ত রেখে মোস্তফা একা উঠে গেলেও পাশে বল পাস দেওয়ার জন্য কাউকে পাচ্ছিলেন না। ফলে ভালো খেলেও গোল বের করতে পারেননি মোস্তফা।

দ্বিতীয়ার্ধে আরেক ফরোয়ার্ড মারুফ আহমেদ নেমে ব্যক্তিগতভাবে কিছু করতে চাইলেও সে রকম দলগত সমন্বয় না থাকায় প্রত্যাশিত গোল বের করে আনতে পারেননি। বারিধারার খেলায় সবচেয়ে হতাশাজনক ব্যাপার ছিল, আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের মধ্যে সমন্বয় না থাকা। সে তুলনায় দলের আরেক বিদেশি, উজবেকিস্তানের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ইভেজিনি কোচনেভের সঙ্গে মোস্তফার রসায়ন ছিল তুলনামূলকভাবে ভালো।

কোনো দলের ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারও যে পাকা স্ট্রাইকারের মতো নয় নম্বর জার্সি পরতে পারেন, কোচনেভের কল্যাণে সেটাও দেখা গেল বাংলাদেশের মাটিতে। মনে পড়ে গেল গত মৌসুমে আর্সেনালের হয়ে খেলা উরুগুইয়ান ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার লুকাস তোরেইরাকে, যিনি ১১ নম্বর জার্সি পরতেন!

তবে দলের কোচ শেখ জাহিদুর রহমান যদি মোস্তফার সঙ্গে সুমন-নয়ন-মারুফদের রসায়নটা কাজে লাগানোর টোটকা বের করে ফেলতে পারেন, তাহলে উত্তর বারিধারা সামনে চমক দেখাতেও পারে।

আসা যাক সাইফের মিডফিল্ড নিয়ে আলোচনায়। জামালের পরিবর্তে দলে আসা উজবেকিস্তানের সিরোজিউদ্দিন রাখমাতুলেভ ম্যাচসেরা হলেও পাল্লা দিয়ে ভালো খেলেছেন নাইজেরিয়ান মিডফিল্ডার জন ওকোলি ও দেশীয় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার শাহেদুল আলম। অন্তত দ্বিতীয়ার্ধে তো বটেই।

দ্বিতীয়ার্ধে তুলনামূলক ভালো খেলেছে সাইফ।
ছবি: প্রথম আলো

প্রথমার্ধে সাইফের খেলোয়াড়েরা নিজেদের সামর্থ্যের প্রতি অতটা সুবিচার না দেখালেও, খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসেন দ্বিতীয়ার্ধে। ৪-৩-৩ ছকে তিন মিডফিল্ডার মাঝমাঠ জমাট রেখে দুই উইঙ্গারকে লাইসেন্স দিচ্ছিলেন একদম সাইডলাইন ঘেঁষে খেলার। ৪৯ মিনিটে সিরোজিউদ্দিনের কল্যাণেই আত্মঘাতী গোলে এগিয়ে যায় সাইফ। সিরোজিউদ্দিনের ক্রস মিসরের ডিফেন্ডার মাহমুদ সায়েদ আবদেল রহিমের পায়ে লেগে জালে জড়িয়ে যায়।

শাহেদের খেলার তেমন গতি না থাকলেও দুই সেন্টারব্যাক রিয়াদুল হাসান ও নাইজেরিয়ার ইমানুয়েল আরিয়াচুকুর মাঝখানে থেকে দুই উইংয়ে বারবার লং বল পাঠিয়েছেন, নিখুঁত পাস দিয়ে খেলার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন। শাহেদের দুপাশে সিরোজিউদ্দিন ও ওকোলির ভূমিকাটা অনেকটা আদর্শ বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডারের মতোই মনে হয়েছে।

সিরোজিউদ্দিনের ব্যাপারে তো বলা হলোই, ওকোলির সঙ্গে দেশীয় উইঙ্গার ফয়সাল আহমেদ ফাহিমের বোঝাপড়া ছিল দেখার মতো। সঙ্গে বারবার ওভারল্যাপ করে উঠে যাওয়া রহমতের ক্রস কিংবা লম্বা থ্রো-ইনও বেশ ভোগাচ্ছিল বারিধারাকে।

বিশেষ করে ফাহিমের কথা একটু না বললেই নয়। দুর্দান্ত খেলেছেন দেশীয় এই উইঙ্গার। সাইফের শেষ দুই গোলেই অবদান আছে এই তরুণের। শেষ গোলটা তো নিজেই করেছেন, এবারের ফেডারেশন কাপে দেশীয় তারকাদের মধ্যে যেটা প্রথম গোল।

২৭ বছর বয়সী নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার কেনেথ এনগোকে প্রতিপক্ষের রক্ষণ ভেদ করে যে গোলটা করলেন, সেটায় মাঝমাঠ থেকে বল কেড়ে নিয়ে এই ফাহিমই পাস দেন কেনেথকে। সামনে বল ঠেলে দিয়ে গতিতে ও বলের নিয়ন্ত্রণে প্রতিপক্ষ দুই ডিফেন্ডারকে পেছনে ফেলেই গোলটি করা।

ম্যাচসেরা সিরোজউদ্দিন।
ছবি: প্রথম আলো

৬ মিনিট পরে ৩-০ করলেন ফাহিম। মাঝমাঠের একটু ওপরে টাচ লাইনে পেয়ে বাঁ প্রান্ত দিয়ে ঝড়ের বেগে প্রবেশ করে জালে জড়িয়েছেন তরুণ এই ফরোয়ার্ড। প্রথমে সাইডলাইনে গতি দিয়ে মার্কারকে পরাস্ত করে পরে আস্তে আস্তে কাট ইন করে গোলরক্ষককে পরাস্ত করা, ফাহিমের খেলায় বেশ পরিপক্বতার ছাপ দেখা গিয়েছে।

প্রথমার্ধে নাইজেরিয়ান স্ট্রাইকার কেনেথ অত ভালো না খেললেও দ্বিতীয়ার্ধে বাকি দলের মতো তিনিও খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। প্রথমার্ধে তাঁর খেলা দেখে ডি-বক্সের মধ্যে প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের ভুলের অপেক্ষায় থাকা আর দশটা প্রথাগত নাম্বার নাইনের কথা মনে পড়লেও দ্বিতীয়ার্ধে কেনেথ দেখিয়েছেন, দলের দরকারে নিচে নেমে ওকোলি, সিরোজিউদ্দিনদের সঙ্গে রসায়ন করে খেলতেও পারেন বেশ।

প্রথমার্ধে নিষ্প্রভ সাইফের খেলা যে দ্বিতীয়ার্ধে বদলে গেল, এ জন্য বাহবা পাবেন দলটার বেলজিয়ান কোচ পল পুট। ম্যাচের পরিস্থিতি বিবেচনা করে যেভাবে দলের খেলাটা বদলে দিলেন, বোঝাই গেল, এই লোক অনেক ঘাটের জল খাওয়া!