‘কেউ ফিক্সিং করলেও সভায় এসে তো বলবে না ফিক্সিং করেছে’

কমলাপুর স্টেডিয়ামে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের ম্যাচের ছবি। এই লিগের কিছু ম্যাচ নিয়ে উঠেছে ফিক্সিংয়ের অভিযোগছবি: বাফুফে

কোনো ক্লাব ম্যাচ ফিক্সিং করে সভায় এসে বলবে না যে ফিক্সিং করেছে। স্বাভাবিকভাবেই তারা বিষয়টা অস্বীকার করবে। কাল বাফুফে ভবনে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ কমিটির জরুরি সভায়ও ছিল তারই প্রতিধ্বনি।

পেশাদার লিগের দ্বিতীয় স্তর চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ওঠা ম্যাচ ফিক্সিংয়ের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কাল জরুরি সভায় বসেছিল বাফুফের চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ কমিটি। সভায় চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের ১২টি ক্লাবের প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। তবে পাতানো খেলার অভিযোগ উঠেছে পাঁচটি ক্লাবের বিরুদ্ধে। ওই ক্লাবগুলোকে এরই মধ্যে নিজেদের অবস্থানও ব্যাখ্যা করতে বলেছে বাফুফে এবং যথারীতি ক্লাবগুলো তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করেছে।

অভিযুক্ত অন্যতম ক্লাব আজমপুর ফুটবল ক্লাব উত্তরার সভাপতি সাইদুর রহমান কালকের সভায় তাঁর দলের ফিক্সিংয়ে সম্পৃক্ততা নাচক করে দিয়েছেন। সভায় ঠিক কী বলেছেন তিনি জানতে চাইলে সাইদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘শুধু পাতানো খেলা নিয়ে কথা হয়েছে সভায়। যার যার অবস্থান থেকে সবাই পাতানো খেলার ব্যাপারটা অস্বীকার করেছে। সবাই নিজ নিজ দলের কথা বলেছে। সবাই বলেছে, তারা ফিক্সিংয়ে জড়িত নয়।’

সেদিন আজমপুর ক্লাবের সভাপতির আচরণও ছিল অস্বাভাবিক। আমি কোচ, আমি ডাগআউটে না থেকে ক্লাব সভাপতি থাকবে, এটা মানা যায় নাকি
ক্লাবের ম্যাচ পাতানোর অভিযোগ তুলে আজমপুর ক্লাবের কোচের পদ ছেড়ে দেওয়া সাইফুর রহমান

ম্যাচ ফিক্সিংয়ের ব্যাপারে আজমপুর ক্লাবের অবস্থান কী জানতে চাইলে ক্লাবটির সভাপতি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা সভায় বলেছি, আমরা এসবে জড়িত নই। আমরা খেলার জন্য দল গড়েছি। আর যদি আমরা পাতানো খেলতাম, তাহলে আমাদের অবস্থান লিগ টেবিলে চারে থাকত না।’

কিন্তু আজমপুর ক্লাবের সভাপতির দিকেই ম্যাচ ফিক্সিংয়ের আঙুল তুলে পদত্যাগ করেছেন ক্লাবটির কোচ সাইফুর রহমান (মনি)। তাহলে সাইফুর রহমান কি মিথ্যা বলেছেন? প্রশ্ন করা হলে আজমপুর ক্লাবের সভাপতি বলেন, ‘আসলে মনির কথাগুলো আমার বোধগম্য নয়। মনি বলছে মনি কথা। কী কারণে বলেছে, আমিও বুঝতে পারিনি। মনি আমার ভোজন ফ্রেন্ড।’

কিন্তু সাইফুর রহমান জোরালোভাবেই বলছেন, তাঁর মনে হয়েছে আজমপুর ক্লাব ম্যাচ ফিক্সিং করেছে। ক্লাবটির সভাপতির দাবি প্রসঙ্গে জাতীয় দলের সাবেক এই স্ট্রাইকারের কথা, ‘গত ২৪ মার্চ আজমপুর-ফরাশগঞ্জ ম্যাচের ভিডিও ফুটেজ দেখলে ব্যাপারটা স্পস্ট হয়ে যায়। আজমপুরের বিপক্ষে ফরাশগঞ্জ দৃষ্টিকটুভাবে গোল খেয়েছে। ফরাশগঞ্জের ডিফেন্ডার বলটা ক্লিয়ার করতে গিয়ে পা সরিয়ে নিয়েছে। ফরাশগঞ্জের গোলকিপার যেদিকে ডাইভ দেওয়ার কথা, সেদিকে না দিয়ে অন্যদিকে দিয়েছে। এগুলো না বোঝার কোনো কারণ নেই। এখন আপনি যদি মনে করেন ফিক্সিংয়ের আরও ক্লু লাগবে, সেটা ভিন্ন ব্যাপার। কত রকমের প্রমাণই আছে। কিন্তু আমি মাঠে থেকে যা দেখেছি, সেটা পরিষ্কার। ম্যাচ ফিক্সিং হয়েছে, এর চেয়ে পরিষ্কার আর কিছু হতে পারে না।’

কাল বাফুফে ভবনে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ কমিটির সভায় উপস্থিত ছিলেন ১২ ক্লাবের কর্মকর্তারা
ছবি: বাফুফে

এরপর যোগ করেন, ‘আমার দলের ম্যানেজার, গোলকিপার কোচ, সহকারী কোচ—সবাই পরিষ্কার যে ফিক্সিং হয়েছে। তা ছাড়া খেলোয়াড়েরা বিরতির সময় এসে ফিক্সিংয়ের ব্যাপারটা আমাকে বলেছে। হয়তো এখন তারা সেটা বলতে চাইবে না স্বাভাবিক। তারা আমাকে বলেছে, এসব কী হচ্ছে? সেদিন আজমপুর ক্লাবের সভাপতির আচরণও ছিল অস্বাভাবিক। আমি কোচ, আমি ডাগআউটে না থেকে ক্লাব সভাপতি থাকবে, এটা মানা যায় নাকি।’

পাতানো খেলার অভিযোগ নেই এমন ক্লাবগুলোর মধ্যে নোফেল স্পোর্টিংয়ের সাধারণ সম্পাদক ও টিম ম্যানেজার শাখাওয়াত হোসেন কাল চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ কমিটির সভায় উপস্থিত ছিলেন।

সভা শেষে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় লেখালেখি দেখে কাল একটা জরুরি সভা ডাকা হয়েছিল চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ কমিটির। যেসব ক্লাব নিয়ে নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে, তাদের বক্তব্য শোনা হয়েছে। ওরা অস্বীকার করেছে। ফেডারেশন বলেছে, এগুলো তদন্ত করা হচ্ছে। দোষী হলে শাস্তি দেওয়া হবে। ভবিষ্যতে পাতানো না খেলার ব্যাপারেও সতর্ক করা হয়েছে ক্লাবগুলোকে।’

গত বছর আরামবাগের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও ক্লাব কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছিল। পরে তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় আরামবাগ ক্লাবকে বড় শাস্তি দেওয়া হয়েছে।

এই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘কে পাতানো খেলে, কে খেলে না, এগুলো আসলে আমরা জানিও না। প্রতিটি ক্ষেত্রেই সিন্ডিকেট চলছে। খেলার মাঠে অনেক সময় কর্মকর্তারা জানেও না, খেলোয়াড়েরা ফিক্সিং করছে। কে কোথায় কী করছে, বোঝা কঠিন। একটা ক্লাবের ঘরদুয়ার না থাকলে টিম চালানো অনেক কষ্টকর। আমরা বয়েজ ক্লাব ভাড়া করে খেলোয়াড়দের রাখি, কত কষ্ট করতে হয়। অনুশীলনের জায়গা নেই। এগুলো নিয়েই আমরা অশান্তিতে আছি। সবকিছু শুনে বাফুফে বলেছে, অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তি পাবে দলগুলো। দেখা যাক কী হয়।’

শাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘১২টি টিমের মধ্যে যদি ৫-৬টির বিরুদ্ধেই অভিযোগ আসে, তাহলে আর বাকি থাকে কী? তবে এটা ঠিক, কেউ ফিক্সিং করলেও সভায় এসে তো বলবে না ফিক্সিং করেছে।’

সভা শেষে বাফুফের পেশাদার লিগ কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান ও এই সভার সভাপতি আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পত্রপত্রিকায় নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ক্লাবগুলোর কাছে জানতে চেয়েছি, ঘটনাটা কী? কিছু কর্মকর্তার ভাষ্য, দলে সুযোগ পায় না এমন খেলোয়াড়েরা ফিক্সিংয়ের অভিযোগ করে। কোনো কোনো কোচও এমন অভিযোগ করছে। বিচ্ছিন্নভাবে কোনো খেলোয়াড় বা কোচ বা নির্দিষ্ট কোনো ব্যক্তি এর সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। কিন্তু ক্লাব কখনো ফিক্সিং করেনি। ক্লাব এসব থেকে দূরে আছে। ক্লাব কর্মকর্তারা বলেছেন, তাঁরা অনেক টাকা দিয়ে দল গড়ছেন পাতানো খেলার জন্য নয়।’

গত বছর আরামবাগের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগও ক্লাব কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করেছিল। পরে তদন্তে দোষী প্রমাণিত হওয়ায় আরামবাগ ক্লাবকে বড় শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এবারের অভিযোগও এখন তদন্ত করছে বাফুফের পাতানো খেলাসংক্রান্ত কমিটি।