কেন ছাঁটাই হলেন ল্যাম্পার্ড?

শেষ পর্যন্ত ছাঁটাই–ই হলেন ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড।ছবি: রয়টার্স

চেলসি সমর্থকেরা যতই বিস্ময় প্রকাশ করুন না কেন, ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ড যে ছাঁটাই হবেন, এ ব্যাপারে সবাই প্রায় নিশ্চিত ছিলেন। প্রশ্নটা ছিল কখন ছাঁটাই হবেন?

বড়দিনের ছুটির আগেই ছাঁটাই হবেন, এমন শঙ্কা ছিল। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে বড়দিনের সময়টাই যে কোচ ছাঁটাইয়ের সবচেয়ে রমরমা সময়। মৌসুমের প্রায় অর্ধেক পার হয়ে যায় তখন। দল কতটা ভালো বা খারাপ করছে, সেটাও তখন বোঝা যায়। তবে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপ পর্বে শীর্ষস্থান পাইয়ে দেওয়া ল্যাম্পার্ডের ওপর আস্থা রেখেছিল চেলসি।

সে আস্থা উবে গেছে গত সপ্তাহে। লেস্টারসিটির কাছে হেরে যাওয়ার পর লিগে ৯ নম্বরে চলে যায় চেলসি। এরপরই ল্যাম্পার্ডকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন মালিক রোমান আব্রামোভিচ। ক্লাব কিংবদন্তি হতে পারেন, কিন্তু আব্রামোভিচের যে কোচদের ক্ষেত্রে খুব বেশি ধৈর্য দেখানোর অভ্যাস নেই। গতকাল ২৫ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে চেলসি থেকে বিদায় নিয়েছেন ল্যাম্পার্ড। ঠিক কী কারণে এই দশা ল্যাম্পার্ডের? কেন এক মৌসুম আগেও চূড়ায় ওঠা ভাবমূর্তিটা নষ্ট হলো তাঁর?

২০১৯ সালে ল্যাম্পার্ডের হাতে যখন চেলসির দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখনই প্রশ্ন তোলা হয়েছিল। বেশি দ্রুত হয়ে গেল কি না? ইংলিশ দ্বিতীয় বিভাগে ডার্বির হয়ে ভালো করেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিভাগ আর প্রিমিয়ার লিগ তো আর এক নয়। আর চেলসির মতো ক্লাব, যারা গত এক দশকে ১০ জন কোচকে দায়িত্ব নিতে দেখেছে। তাই ল্যাম্পার্ডের হাতে দায়িত্ব ওঠাটা একটু ঝুঁকিরই হয়ে গিয়েছিল।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল দলবদলের নিষেধাজ্ঞা। একই দলবদলে যেখানে ক্লাব কিংবদন্তি বনে যাওয়া এডেন হ্যাজার্ড বিদায় নিয়েছেন, সেই দলবদলেই নিষেধাজ্ঞার কারণে দলে কাউকে নিতে পারেনি ক্লাব। ল্যাম্পার্ডকে তাই ধার থেকে ফেরা খেলোয়াড় ও একাডেমির তরুণদের ওপরই ভরসা মানতে হয়েছে। সেই দল নিয়েই চমক দেখিয়েছেন ল্যাম্পার্ড। প্রিমিয়ার লিগে দলকে চতুর্থ স্থান এনে দিয়েছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ নিশ্চিত করার সঙ্গে আক্রমণাত্মক ফুটবলের প্রদর্শনী সমর্থকদের আশা বাড়িয়ে দিয়েছিল।

চেলসির অবস্থান এখন লিগ টেবিলের নয়–এ।
ছবি: রয়টার্স

ঝামেলার শুরু ২০২০-২১ মৌসুমে। আগের মৌসুমে দলবদল করতে পারেনি চেলসি। আর এবারের দলবদলে অন্য সব ক্লাবই করোনার ধাক্কা সামলাচ্ছিল। ফলে সুযোগ পেয়েই আর লোভ সামলাতে পারেনি তারা। দলের ভারসাম্য নষ্ট হতে পারে জেনেও একের পর এক আক্রমণাত্মক ফুটবলার এনেছে দলে। স্কোয়াডে ট্যামি আব্রাহাম, ক্রিস্টিয়ান পুলিসিক, অলিভিয়ের জিরু, কালাম হাডসন-ওডোই আগেই ছিলেন। এবারের দলবদলেই তাঁদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন টিমো ভের্নার, কাই হাভার্টজ ও হাকিম জিয়েশ।

রক্ষণেও অস্ত্র কম যোগ করা হয়নি। বেন চিলওয়েল, এদুয়ার্দ মেন্ডি ও থিয়াগো সিলভারা যুক্ত হয়েছেন চেলসিতে। ২০ কোটি পাউন্ডের বেশি খরচ করার পরপরই সবাই ল্যাম্পার্ডকে নিয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। কারণ, আব্রামোভিচের এত খরচ করার একটাই অর্থ, এবার শিরোপা চান তিনি। অর্ধেক মৌসুম পেরোনোর পর চেলসিকে ৯ নম্বরে দেখা তাই সহ্য হয়নি তাঁর। গতকাল চেলসির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, ‘ফলাফল ক্লাবের আশা পূরণ করতে পারেনি। স্থায়ী কোনো উন্নতির ছাপ নেই বলেই পয়েন্ট টেবিলের মাঝে অবস্থান।’

ল্যাম্পার্ড বিদায়বেলায় ক্লাবের এমন অভিযোগের কোনো জবাব দেননি। বরং গত ১৮ মাসের স্মৃতি নিয়েই কথা বলেছেন।। ইনস্টাগ্রামে লিখেছেন, ‘আমার জীবনের অনেক বড় এক অংশ হয়ে থাকা চেলসির দায়িত্ব পাওয়া অনেক গর্বের ও সম্মানের ব্যাপার ছিল। ১৮ মাস ধরে আমাকে এত চমৎকারভাবে সমর্থন দেওয়ায় ভক্তদের ধন্যবাদ দিতে চাই। আশা করি তাঁরা জানেন, এটা আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। যখন আমি দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন জানতাম কত কঠিন সময় অপেক্ষা করছে। যা অর্জন করেছি তা নিয়ে আমি গর্বিত। একাডেমির খেলোয়াড়েরা মূল একাদশে জায়গা করে নেওয়ায় এবং ভালো করায় আমি তাদের নিয়ে গর্বিত। ক্লাবের ভবিষ্যৎ ওরা। এই মৌসুমে ক্লাবকে এগিয়ে নেওয়ার এবং পরবর্তী ধাপে নিতে পারিনি বলে হতাশ আমি। আমি মিস্টার আব্রামোভিচ, বোর্ড, খেলোয়াড়, কোচিং দল এবং ক্লাবের সবাইকে তাঁদের পরিশ্রম, নিবেদনের জন্য ধন্যবাদ দিতে চাই। বিশেষ করে এমন অচিন্তনীয় কঠিন সময়ে। আমি ক্লাব ও দলের ভবিষ্যৎ সাফল্য কামনা করি।’

দলের মধ্যেই খেলোয়াড়দের আস্থা হারিয়েছেন সাবেক চেলসি–কিংবদন্তি।
ছবি: রয়টার্স

ল্যাম্পার্ড চাইলেই ক্লাবকে মনে করিয়ে দিতে পারতেন শুরুর প্রতিজ্ঞার কথা, যখন তাঁকে ফলাফলের কথা ভুলে তিন বছরের জন্য একটি প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল। তিন বছরে দলকে গুছিয়ে আনার দায়িত্ব পেয়েছিলেন ল্যাম্পার্ড। লিভারপুলে ইয়ুর্গেন ক্লপ যেমন প্রথম তিন বছরে কিছুই জেতেননি। কিন্তু এই সময়টায় ধীরে ধীরে এমন এক দল গড়েছেন, যা পরে চ্যাম্পিয়নস লিগে জিতেছে, ৩০ বছর পর প্রিমিয়ার লিগও জয় করেছে।

পেপ গার্দিওলা সবাইকে সেটা মনে করিয়ে দিয়েছেন। সবাইকে মনে করিয়ে দিয়েছেন, যতই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলা হোক, শেষ পর্যন্ত তাৎক্ষণিক সাফল্য না পেলে বিপদে পড়েন কোচরা, ‘তরুণ কিংবা অভিজ্ঞ ম্যানেজার যা-ই হোন না কেন, আপনাকে জিততেই হবে। মানুষ ভবিষ্যৎ প্রকল্প ও পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলে। কিন্তু বাস্তবে এসব কিছু নেই। আপনাকে জিততেই হবে; তা না হলে, চাকরি যাবেই। আমি চেলসির এ সিদ্ধান্তকে সম্মান করছি। কিন্তু ফ্র্যাঙ্কের জন্য ভালোবাসা জানাচ্ছি। আশা করি খুব শিগগির তাঁকে দেখব। লকডাউন শেষ হলে রেস্তোরাঁয় গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করে আসতে পারব।’

সবাই ল্যাম্পার্ডের অনভিজ্ঞতাকে ছাঁটাইয়ের কারণ বলে দেখালেও গার্দিওলার চোখে ওসব অজুহাত। মূল কারণ হলো, অধিকাংশ মালিকই দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পের জন্য ধৈর্য ধরতে পারেন না, ‘ডার্বি কাউন্টিতে দারুণ কাজ দেখিয়েই সে চেলসির দায়িত্ব পেয়েছিল। তার এটা প্রাপ্য ছিল। কিন্তু আমরা ফলের ওপর নির্ভরশীল। কীভাবে খেলছি, কী দর্শনে খেলি কিংবা দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কী, এসব কাজে দেয় না। আপনাকে ফল পেতেই হবে। যদি প্রত্যাশিত ফল এনে দিতে না পারেন, অন্য কোনো ম্যানেজার এনে আপনাকে বিদায় করা হবে।’

চেলসির হয়ে শুরুতে আক্রমণাত্মক ফুটবল খেললেও রক্ষণে বরাবরই মার খেয়েছেন ল্যাম্পার্ড। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রিমিয়ার লিগে প্রতিপক্ষের মাঠে চেলসির চেয়ে বেশি গোল হজম করেছে মাত্র একটি দল। চেলসির কোচ হিসেবে ম্যাচপ্রতি ১.৬৭ পয়েন্ট পেয়েছেন ল্যাম্পার্ড। লন্ডনের ক্লাবটিতে স্থায়ীভাবে দায়িত্ব পেয়েছেন এমন কোচদের মধ্যে গত ১০ বছরে লিগে ম্যাচপ্রতি এত কম পয়েন্ট কারও ছিল না। দলের খেলোয়াড়দের সঙ্গেও সম্পর্কে অবনতি ঘটছিল তাঁর। অনেক তারকাই তাঁদের ফর্ম খুঁজে না পাওয়ার পেছনে ল্যাম্পার্ডের পছন্দের ফরমেশন ও দল নির্বাচনকে দায়ী করেছেন। ওদিকে প্রকাশ্যে খেলোয়াড়দের সমালোচনা করেও ড্রেসিংরুমের সমর্থন হারিয়েছেন ল্যাম্পার্ড। বেশ কয়েকজন খেলোয়াড় তো প্রকাশ্যেই নিজেদের অসন্তুষ্টির কথা জানিয়েছেন।

ক্লাব কিংবদন্তি বলে সমর্থকদের পাশেই পাচ্ছিলেন ল্যাম্পার্ড। এমন একজন ক্লাব কিংবদন্তিকে ছাঁটাই করার সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়। কিন্তু দলে নতুন যোগ হওয়া তারকাদের সেরাটা বের করতে ব্যর্থ হওয়া, খেলোয়াড়দের অসহযোগিতা, দলের বাজে পারফরম্যান্স ও মাঠে দর্শকের অনুপস্থিতি আব্রামোভিচের কাজটা সহজ করে দিয়েছে। অথচ চারে থাকা লিভারপুল থেকেও মাত্র ৫ পয়েন্ট পিছিয়ে আছে চেলসি। করোনার কারণে প্রতি সপ্তাহেই ফর্ম উল্টেপাল্টে যাচ্ছে সব দলের। সেখানে এক মাসেই হয়তো শীর্ষ চারে খুব সহজেই চলে আসতে পারত চেলসি।

ল্যাম্পার্ড চাইলে এখন সাবেক চেলসি কোচ জোসে মরিনিওর কথায় সান্ত্বনা খুঁজে নিতে পারেন। সাবেক শিষ্যকে বাস্তবতা মেনে নিতে বলেছেন বর্তমান টটেনহাম কোচ, ‘ও ছাঁটাই হওয়ায় আমার মন খারাপ হয়েছে। কিন্তু ফুটবলের নিষ্ঠুরতা এখানেই। বিশেষ করে আধুনিক ফুটবলে। যখন আপনি ফুটবল ম্যানেজার হবেন, তখন ধরে নেবেন আগে হোক বা পরে, এটা আপনার ক্ষেত্রে ঘটবেই।’