কোচ লুকাতে দেননি বলে হাতে গোল করেও ‘ম্যারাডোনা’ হওয়া হলো না তাঁর

ছিয়াশি বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার হ্যান্ড অব গডছবি: সংগৃহীত

বাংলাদেশে ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনার ভক্তদের কাছে একসময় বিতর্কের বড় দুটি ‘অস্ত্র’ ছিল তাঁর দুই গোল। একসময় কেন, এখনো তো হয়! সেই গোল দুটির বয়স ৩৬ বছর হয়ে গেছে, তার রূপকার ডিয়েগো ম্যারাডোনার অন্যলোকে চলে যাওয়ারও এক বছর হয়ে গেছে, কিন্তু এখনো বিতর্কে গোল দুটির কী জোরাল অবস্থান! হয়তো গোল দুটিই ’৮৬ বিশ্বকাপজয়ী আর্জেন্টাইন কিংবদন্তিকে সবচেয়ে ভালো বোঝায় বলে।

কোন দুটি গোল, আলাদা করে বলতে হবে? ১৯৮৬ বিশ্বকাপ, কোয়ার্টার ফাইনাল, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সুমেরু-কুমেরু ব্যবধানের দুই গোল। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা আর পেলে-ম্যারাডোনার শ্রেষ্ঠত্বের তর্কে বাংলাদেশের অনেক ব্রাজিলভক্তের যুক্তিতে ম্যারাডোনাকে পেছনে টেনে রাখে প্রথম গোলটি—ম্যারাডোনার নিজের বর্ণনায় যেটি ছিল ‘হ্যান্ড অব গড’!

আর তর্কে আর্জেন্টিনার ভক্তদের পাল্টা দেওয়ার উপাদান হয়ে আসে ওই গোলেরই চার মিনিট পরে ম্যারাডোনার চোখধাঁধানো কয়েক সেকেন্ড। মাঝমাঠ থেকে বল টেনে নিয়ে ইংল্যান্ডের চার ডিফেন্ডার আর গোলকিপার পিটার শিলটনকে ড্রিবলিংয়ে হতবুদ্ধি করে রেখে ‘গোল অব দ্য সেঞ্চুরি’!

কারাবাগের স্ট্রাইকার ওয়াদজি (কালো জার্সি)
ছবি: রয়টার্স

ওই ম্যাচের কিংবা ম্যারাডোনার কোনো বর্ষপূর্তি নয় আজ, তবু গোল দুটি হঠাৎ প্রাসঙ্গিক হলো কী কারণে? গত পরশু ইউরোপা কনফারেন্স লিগে হয়ে যাওয়া মার্শেই-কারাবাগ ম্যাচ। কারাবাগের ইব্রাহিমা ওয়াদজি যে ম্যারাডোনার ‘হ্যান্ড অব গড’ মুহূর্তের স্মৃতি ফিরিয়েছিলেন হাতে গোল করে। তবে কারাবাগ কোচের হস্তক্ষেপে ওয়াদজির আর ‘ম্যারাডোনা’ হয়ে ওঠা হয়নি, রেফারির কাছে স্বীকার করায় গোলটা শেষ পর্যন্ত বাতিল হয়েছে।

ইউরোপের মহাদেশীয় টুর্নামেন্টের মর্যাদায় চ্যাম্পিয়নস লিগ ও ইউরোপা লিগের পর তৃতীয় স্তরের টুর্নামেন্ট হিসেবে এই মৌসুমেই চালু হয়েছে কনফারেন্স লিগ। সেটির শেষ ষোলোর প্লে-অফের প্রথম লেগে নিজেদের মাঠে ৩-১ গোলে জেতা মার্শেই পরশু কারাবাগের মাঠে জিতেছে ৩-০ গোলে।

ওয়াদজি পরশু যখন বলটা জালে জড়ান, বাকুতে ম্যাচের ৩৪তম মিনিট চলছে। গোলটা স্বীকৃতি পেলে ম্যাচে ১-১ সমতায় ফিরতে পারত কারাবাগ। গোলটা ওয়াদজি যেভাবে করেছেন, সেটির সঙ্গে অবশ্য ম্যারাডোনার নয়, ২০০৭ সালে এসপানিওলের বিপক্ষে লিওনেল মেসির হাত দিয়ে গোল করার ধরনটা বেশি মেলে। বক্সের বাঁ প্রান্ত থেকে ভেসে আসা ক্রসে হেড করার জন্য লাফিয়েও হাত দিয়ে বল জালে জড়ান ওয়াদজি। মেসির ক্ষেত্রে পার্থক্যটা শুধু এই যে ক্রসটা এসেছিল ডান প্রান্ত থেকে।

কিন্তু হাত দিয়ে গোলের উদাহরণে তো মেসি নয়, ম্যারাডোনার নামটাই আসবে! মেসি-ম্যারাডোনার গোলগুলোয় বলে হাত লাগানো ইচ্ছাকৃত হলেও ওয়াদজি ইচ্ছা করে বলে হাত লাগাননি বলেই দাবি করেছেন!

ওয়াদজির গোলটার সময় বল যে হাতে লেগেছে, সেটি রেফারিরা দেখেননি। কনফারেন্স লিগের এই পর্যায়ে ভিএআর না থাকায় সেটি আরেকবার পরীক্ষা করে দেখার সুযোগও ছিল না। মার্শেই খেলোয়াড়েরা রেফারির কাছে প্রতিবাদ জানালেও রেফারি গোলের স্বীকৃতি দিয়ে দেন। ম্যাচ তখন কিছুক্ষণ বন্ধ ছিল। শেষ পর্যন্ত কারাবাগ কোচ গুরবান গুরবানভ এগিয়ে আসেন।

গোলদাতা ওয়াদজি আর দলের অধিনায়ক মাকসিম মেদভেদেভকে টাচলাইনে ডাকেন কারাবাগ কোচ। কিছুক্ষণ আলোচনার পর ওয়াদজিকে গুরবানভ নির্দেশ দেন রেফারির কাছে সব স্বীকার করে নিতে। ওয়াদজি রেফারির কাছে গিয়ে বল হাতে লাগার কথা স্বীকার করলে রেফারি গোল বাতিল করে মার্শেইয়ের পক্ষে ফ্রি-কিক দিয়ে খেলা শুরু করেন।

ম্যাচ শেষে ফরাসি চ্যানেল আরএমসি স্পোর্তে ঘটনাটার ব্যাখ্যা দিয়েছেন ওয়াদজি, ‘পরিস্থিতিটা জটিল ছিল, আমার অধিনায়কের সঙ্গে কথা বলতে হতো। জানতাম বল আমার হাতে লেগেছে, কিন্তু এটা আমি ইচ্ছা করে করিনি। (দৌড়ে এসে লাফিয়ে ওঠার পর শরীরের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়াতেই) হাতটা মাথার সঙ্গে চলে আসে। মেদভেদেভকে আমি বললাম যে বল আমার হাতে লেগে গোল হয়েছে। অন্য সতীর্থরা জিজ্ঞেস করার পর তাদেরও বলেছি বল আমার হাতে লেগেছে।’

ম্যারাডোনা অনন্তলোকে পাড়ি জমিয়েছেন এক বছরের বেশি হয়ে গেছে
ছবি: রয়টার্স

কী করবেন যখন বুঝতে পারছিলেন না ওয়াদজি-মেদভেদেভ, কোচের সঙ্গে আলোচনাই সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ করে দিয়েছে তাঁদের জন্য। ওয়াদজির বর্ণনা, ‘কোচ আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমার কী মনে হয়েছে। তাঁকে বলেছি যে বল আমার হাতে লেগেছে। তিনি আমাকে বললেন, “এটা ঠিক নয়, তোমাকে নিজের কাজের দায় নিতে হবে। রেফারিকে জানাও এটা।”’ রেফারি গোল বাতিল করায় সঠিক কাজটা করার তৃপ্তি পাচ্ছেন, তবে একটু আফসোসও আছে ওয়াদজির, ‘(এভাবে গোল বাতিল হতে দেখাটা) আমার সতীর্থদের জন্য একটু কষ্টের ছিল। কারণ, আমরা অন্তত নিজেদের মাঠের এই ম্যাচটা জিততে চেয়েছিলাম।’

তবে নিজেই স্বীকার করে নেওয়ায় সেনেগালিজ স্ট্রাইকার ওয়াদজি ম্যাচ শেষে প্রতিপক্ষের বাহবাও পেয়েছেন, ‘মার্শেই আমাকে পরে ধন্যবাদ জানিয়েছে। (মার্শেইয়ে খেলা) আমার সেনেগালিজ ভাই—পাপা ও বাম্বার সঙ্গে পরে জার্সি বদল করেছি।’

কারাবাগ কোচ গুরবানভ ম্যাচ শেষে সংবাদ সম্মেলনে এই গোল নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দেওয়া তাঁর জন্য কঠিন হবে জানিয়ে প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করেছেন। তবে পরে বললেন, ‘আমি শুধু একজন আজারবাইজানির মতো কাজ করতে চেয়েছি। ঠিক সিদ্ধান্তটা নেওয়াটা তো সহজই!’

প্রতিপক্ষ মার্শেইয়ের কোচ হোর্হে সাম্পাওলির ভাবনার জগতেও বড় প্রভাব ফেলেছে কারাবাগের এমন কাণ্ড। ২০১৮ বিশ্বকাপে মেসির আর্জেন্টিনার কোচ সাম্পাওলি স্বীকার করে নিয়েছেন, তিনি কারাবাগের কোচ হলে এভাবে গোল বাতিল হতে দিতেন না! মেসি-ম্যারাডোনার দেশের মানুষ বলে কথা! ‘এমন কিছু আমার জীবনে দেখিনি। এ রকম একটা টুর্নামেন্টে এত মানবিক একটা সিদ্ধান্ত! সত্যি বলতে, আমার দলে এমনটা হলে আমি রেফারিকে সিদ্ধান্ত বদলানোর অনুরোধ করতাম না। গোল নিয়েই খুশি থাকতাম। আমার জন্য একটা ভালো শিক্ষা হয়ে থাকল ঘটনাটা’—সাম্পাওলির সহজ স্বীকারোক্তি।

গতকাল কনফারেন্স লিগের শেষ ষোলোর ড্র হয়ে গেছে, সেখানে উয়েফার যুগ্ম মহাব্যবস্থাপক জর্জো মারচেত্তিও কারাবাগের খেলোয়াড়ি চেতনার এই দৃষ্টান্তের প্রশংসা করে বলেছেন, ‘অনেক বিশেষ একটা মুহূর্ত ছিল এটা!’