কোটানের মতো অন্য বিদেশিরা কেন বাংলাদেশের হন না!

 বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ ছিলেন অস্ট্রিয়ান জর্জ কোটান।
 কোটানের হাত ধরেই ২০০৩ সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ। 
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের বর্তমান কোচ অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্ড্রু ওর্ড।
আবাহনী মাঠে ঘাস কাটছেন কোচ জর্জ কোটান। ছবি: রাশেদুল ইসলাম
আবাহনী মাঠে ঘাস কাটছেন কোচ জর্জ কোটান। ছবি: রাশেদুল ইসলাম

‘ইটস নট মাই জব’ কথাটি বলেই মাঠের পাশের রাস্তা দিয়ে হনহন করে হেঁটে চলে গেলেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ অ্যান্ড্রু ওর্ড। বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে (বিকেএসপি) পাঁচ দিন আগের এক বিকেলের কথা।

ফিটনেস কোচ মারিও লেমসের অধীনে অ্যাথলেটিকস টার্ফে ভারসাম্য সমন্বয়ের অনুশীলন করছিলেন ফুটবলাররা। চলল বল নিয়ে অল্পবিস্তর অনুশীলনও। এই শুকনো মৌসুমে পাশের মাঠ ছেড়ে অ্যাথলেটিকস টার্ফে অনুশীলন, অবাকই হতে হলো। কৌতূহলটা চেপে না রাখতে পেরে অনুশীলনে মাঠ ব্যবহার না করার কারণটা জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ওর্ডকে। অস্ট্রেলিয়ান কোচ কারণ হিসেবে কাঠগড়ায় তুললেন শক্ত মাঠকে। মাঠ শক্ত হলে অনুশীলন না করাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। কিন্তু ওর্ডকে পাল্টা জানানো হলো, আপনি কর্তৃপক্ষকে বললেই তো মাঠে পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে। বাংলাদেশ কোচ সাফ জানিয়ে দিলেন শুরুর কথাটি, ‘বলার কাজটা আমার নয়। যাদের কাজ তাদের করতে বলুন’—ব্যস, বলেই হাঁটা ধরলেন। আসলেই তো মাঠে পানি দিতে বলার কাজটা ওর্ডের নয়। ১০ হাজার ডলার মাইনের বিনিময়ে তাঁর কাজটা শুধু ফুটবলারদের অনুশীলন করানো। কোথায় করাবেন, না করাবেন, তা কর্তাদেরই খুঁজে দিতে হবে।

‘বুড়ো’ জর্জ কোটানের কথা মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, ২০০৩ সাফ ফুটবলজয়ী বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের কোচ অস্ট্রিয়ান কোটানের কথাই বলা হচ্ছে। সময়ের রথে চড়ে ফিরে গেলাম ২০১৬ সালের চৈত্রের এক দুপুরে। আগের দিন তাঁর দল আবাহনী লিমিটেড ফেডারেশন কাপের শিরোপা জয় করে ঘরে ফিরেছে। ভরদুপুরে আবাহনী ক্লাবটা তখনো ঘুমিয়ে। নিচতলার বারান্দা থেকে দাঁড়িয়ে একজন দীর্ঘদেহী ভিনদেশিকে দেখা গেল ফুটবল মাঠে। দূর থেকে স্পষ্ট চেনার উপায় নেই বলেই একটু কাছে গিয়ে দেখা। আরে, ইনি তো কোচ জর্জ কোটান!

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল অ্যাথলেটিকস টার্ফে অনুশীলন করছে। ছবি: বাফুফে
বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দল অ্যাথলেটিকস টার্ফে অনুশীলন করছে। ছবি: বাফুফে

দুপুরে সূর্যটা তখন মাথার ওপরে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রখর রোদের মধ্যে নিজেই মেশিন ঠেলে ঠেলে ঘামে ভেজা শ্রমিকের মতো ঘাস কেটে যাচ্ছেন। ৭০ বছর বয়সী আবাহনীর অস্ট্রিয়ান কোচ কোটানই ছিলেন ক্লাবের মাঠের একমাত্র ‘মালি’! ইমন বাবু, সানডেদের ফুটবল পাঠ শেখানো ছাড়াও মাঠের ঘাস লাগানো আর সময়মতো ঘাস ছেঁটে ছোট করাটাও নিজের দায়িত্ব বলেই মনে করতেন। এ কারণে অলস দুপুরে আরামের ঘুমকেও তাঁকে বিসর্জন দিতে হয়েছিল!

ঘাস কাটা কি আপনার কাজ? প্রশ্নটা শুনে এমন অবাক হয়ে তাকিয়েছিলেন! যেন তাঁর কাজই ঘাস কাটা। জবাবে যা বলেছিলেন, তা আজও কানে বাজে, ‘আমি কাউকে বলে ঘাস কাটাতে পারিনি। নিজেই ঘাস কাটছি। ভালো মাঠ ছাড়া ভালো খেলা সম্ভব নয়। কোচ হিসেবে কাজটা নিজেকেই করতে হচ্ছে।’

ওর্ডের সঙ্গে কোটানের পার্থক্যটা কোথায়, বোঝা গেল?

হাল আমলে বাংলাদেশের দায়িত্ব নিয়ে আসা ওর্ড বা লোডভিক ডি ক্রুইফরা মাঠে নেমে ঘাস কাটা তো দূরের কথা, বলতেও দ্বিধা করেন। অথচ কোটান শুধু নিজের টাকায় তেল কিনে এনে ঘাষই কাটেননি। এর আগে ন্যাড়া মাঠটাকে ফুটবলের উপযোগী করার জন্যও করেছেন কঠোর পরিশ্রম। নিজের হাতে পানি দিয়ে সার ছিটিয়েছেন, যেখানে ঘাস ছিল না, সেখানে নতুন করে লাগিয়েছেন ঘাস। মাঠে যাতে কেউ প্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য তৈরি করেছেন বেড়াও। তাঁর সামনে কেউ মাঠে এসে বসতে চাইলে হাতে টাকা ধরিয়ে দিয়ে বলেন, ‘এখানে নয়, ধানমন্ডি লেকে গিয়ে বাদাম কিনে খাও আর আড্ডা দাও!’ কেন করতেন? তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, ‘কোয়ালিটি ফুটবল ডিফেন্স কোয়ালিটি ফুটবল ফিল্ড’—এই হলো কোটান।

অস্ট্রিয়ান যেই মানুষটি কথায় কথায় বলতেন, ‘বাংলাদেশ তাঁর দ্বিতীয় দেশ।’ বাংলাদেশের প্রতি তীব্র ভালোবাসা ছিল বলেই তো মাঠে নেমে ঘাস লাগানো বা কাটা নিজের কাজ হিসেবে জ্ঞান করেছিলেন। কিন্তু এখন হাজার হাজার ডলার মাইনে পাওয়া বাংলাদেশে আসা ওর্ড বা ক্রুইফরা কি সেটা ভাবতে পারেন? মাঠের ঘাস আছে কি নেই, তা দেখার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন? দলকে অনুশীলন করাব, জয়-পরাজয়ের ফিরিস্তির জবাব দেব—ব্যস, এতটুকু হলেই যেন তাঁদের হয়!

তাঁদের কোচিং-জ্ঞান বা অনুশীলনের ধরন নিয়ে কোনো প্রশ্ন না থাকলেও আন্তরিকতার ঘাটতি নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। খেলোয়াড়েরা ডাইনিংয়ে কী খান, কী পোশাক পরেন, এগুলো নিয়ে ভাবতেই চান না বর্তমানে জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়া বিদেশি কোচরা। খেলোয়াড়দের ইতিবাচক মানসিকতা গড়তে অনেক সময় বড় ভূমিকা রাখে এই ছোট বিষয়গুলো। ক্রুইফ তো নিজের জন্য ভালো মানের টি-শার্ট পাননি বলে গালও ফুলিয়ে বসে থাকতেন! বাফুফের কাছ থেকে ভালো মানের পোশাক তিনি আশা করতেই পারেন। কিন্তু অভিভাবক হিসেবে খেলোয়াড়দের পোশাকের কথাটাও তো ভাবতে হয় কোচকে।

ভাবতে পারেন না বলেই একজন কোটান হতে পারেন না ওর্ড-ক্রুইফরা। না সাফল্যে বিচারে, না আন্তরিকতায়।