ক্লাবই যখন খেলেছে 'বাংলাদেশ' নামে

কাতারের সেই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ডাগ আউট। সৌজন্য ছবি
কাতারের সেই প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের ডাগ আউট। সৌজন্য ছবি

ক্লাব দল বিদেশে খেলতে যায়। সারা দুনিয়ায় আয়োজিত হয় ক্লাবভিত্তিক আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা। কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় যেখানে পূর্ণাঙ্গ জাতীয় দলের খেলার কথা, সেখানে কোনো ক্লাবকে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘটনা ফুটবল ইতিহাসে খুব বেশি কি আছে? বাংলাদেশের ফুটবলে এমন ঘটনা ঘটেছিল একবার।

আজ থেকে ২৩ বছর আগে কাতারে একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ জাতীয় দলের নামে খেলেছিল একটি ক্লাব! কেবল অংশ নিয়েই বসে থাকেনি দলটি, হারিয়েছিল ইয়েমেনের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষকেও।

১৯৯৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস। কাতারের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়োজিত হয়েছিল ‘কাতার ইন্ডিপেনডেনস কাপ’। স্বাগতিক কাতার ছাড়াও খেলেছিল ওমান, ইয়েমেন, সুদান, ভারত ও বাংলাদেশ। সৌদি আরব ও কুয়েতের খেলার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে তারা নাম প্রত্যাহার করে নেয়। আয়োজকেরা তখন তড়িঘড়ি করে আমন্ত্রণ জানান সাফ অঞ্চলের দুই দেশ ভারত ও বাংলাদেশকে।

সে বছর বাংলাদেশের ফুটবলে ঘটে যায় আরেক নজিরবিহীন ঘটনা। মৌসুমের শুরুতে দলবদলে তিন প্রধান দল আবাহনী লিমিটেড, মোহামেডান স্পোর্টিং ও ব্রাদার্স ইউনিয়ন এককাট্টা হয় তারকা খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিকের বিষয়ে। ক্লাব তিনটি নিজেদের সেরা তারকাদের নিয়ে একটি ‘পুল’ গঠন করে। যার উদ্দেশ্য ছিল কোনোভাবেই খেলোয়াড়দের পারিশ্রমিক যেন একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের ওপর না ওঠে। বাংলাদেশের ফুটবলে এটি ‘জেন্টেলম্যান অ্যাগ্রিমেন্ট’ নামে পরিচিত।

তারকা খেলোয়াড়েরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন—এমন একটা শঙ্কার মধ্যে এগিয়ে আসে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়াচক্র। আগের মৌসুম পর্যন্ত ঢাকার ফুটবলে মাঝারি মানের দল হিসেবে যে ক্লাবের পরিচিতি ছিল, তারাই টাকার থলে নিয়ে এগিয়ে আসে। তিন প্রধানের ঘর ভেঙে মুক্তিযোদ্ধা নিজেদের তাঁবুতে ভেড়ায় ১২ জন তারকা ফুটবলারকে। এই ১২ ফুটবলারের সবাই ছিলেন সে সময় জাতীয় দলের নিয়মিত মুখ। মোহাম্মদ মহসিন, রিজভী করিম রুমি, জুয়েল রানা, মাসুদ রানা, মামুন জোয়ারদার, আতাউর রহমান, সাইফুল বারী টিটো, বরুণ বিকাশ দেওয়ান, মিজানুর রহমান, রকিব হোসেন, ইমতিয়াজ আহমদ নকীব, আরমান মিয়া ও আরিফ হোসেন মুনদের মতো খেলোয়াড়দের নিয়ে সে মৌসুমে মুক্তিযোদ্ধা লিগ লড়াইয়ে হয়ে ওঠে আবাহনী, মোহামেডান ও ব্রাদার্সের দুর্দান্ত প্রতিদ্বন্দ্বী। মৌসুমের প্রথম বড় টুর্নামেন্টে ফেডারেশন কাপের শিরোপাটাও জিতে নেয় মুক্তিযোদ্ধা।

লিগ চলার একটা পর্যায়ে কাতার থেকে আমন্ত্রণ আসে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের কাছে (বাফুফে)। কাতারে পাঠাতে হবে জাতীয় দল। বাফুফে সভাপতি তখন সে সময়কার যোগাযোগমন্ত্রী কর্নেল (অব.) অলি আহমদ। তিনি কাতারের এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলেন। এদিকে ১৯৯৩ সালের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ সাফ গেমসে ব্যর্থতার পর দীর্ঘ সময় জাতীয় দল কোনো ম্যাচও খেলেনি। কিন্তু এত অল্প সময়ে কীভাবে জাতীয় দল গঠন করে পাঠানো যাবে? সে সময় ফেডারেশনের মাথায় বুদ্ধিটা খেলে। মুক্তিযোদ্ধাকেই জাতীয় দলের নামে কাতারে খেলতে পাঠিয়ে দিলেন কেমন হয়! দলটা কাগজে-কলমে বাংলাদেশ জাতীয় দলই। তা ছাড়া ভরা মৌসুমে প্রত্যেক খেলোয়াড় যে ছিলের খেলার মধ্যেই।

খুব অল্প দিনের নোটিশে কাতার পাঠানো হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধাকে। তখনকার স্মৃতি আজও জ্বলজ্বলে মুক্তিযোদ্ধা ও জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার সাইফুল বারী টিটোর, ‘মনে আছে লিগ চলছিল। তিন-চার দিনের একটা হালকা প্রস্তুতি নিয়ে আমরা কাতার গিয়েছিলাম। ঢাকায় আমরা খেলছিলাম বৃষ্টি-আবহাওয়ায় ভেজা ও কাদা মাঠে। কাতারে গিয়ে প্রচণ্ড গরম আর শুষ্ক মাঠ পেয়েছিলাম। কাতার থেকে আমন্ত্রণটা এসেছিল বাফুফের কাছে। ওরা জাতীয় দল চেয়েছিল। ফেডারেশন মুক্তিযোদ্ধাকেই পাঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ১৯৯৪ সালে মুক্তিযোদ্ধা তো অলিখিতভাবে জাতীয় দলই ছিল।’

সেবার মুক্তিযোদ্ধার কোচ ছিলেন আজকের বাফুফে সভাপতি কাজী সালাউদ্দিন। কাতারের সেই স্মৃতি সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রথম আলোকে সালাউদ্দিন বলেন, ‘২৩ বছর আগের কথা। সবকিছু মনে নেই। তবে এটা ঠিক, আমরা কাতারে খেলেছিলাম। আমি তখন মুক্তিযোদ্ধার কোচ।’

কেন, কোন প্রেক্ষাপটে জাতীয় দল না পাঠিয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে কাতারে পাঠানো হয়েছিল, সেটি মনে করতে পারলেন না সালাউদ্দিন, ‘আমি মনে করতে পারছি না। অনেক দিন হয়ে গেছে।’

কাতারে প্রথম ম্যাচেই বাংলাদেশ নামের মুক্তিযোদ্ধা খেলেছিল ভারতের বিপক্ষে। ম্যাচটির প্রথমার্ধ ছিল রীতিমতো দুর্যোগের। ২৩ মিনিটের মধ্যেই বাংলাদেশ পিছিয়ে গিয়েছিল ৩-০ গোলে। অভিজ্ঞ গোলরক্ষক ও দলের অধিনায়ক মোহাম্মদ মহসিনের ভুলে দুটি গোল হজম করতে হয়েছিল দলকে। ৩, ৯ ও ২৩ মিনিটে তিন গোল খেয়ে দ্বিতীয়ার্ধের ৫৫ মিনিটে আরও একটি গোল। এরপর গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে বাংলাদেশ। ৬৩ ও ৭৪ মিনিটে ইমতিয়াজ আহমেদ নকীবের দুটি দর্শনীয় গোলে লড়াই জমিয়ে দিলেও ম্যাচটি ৪-২ গোলে হারতে হয় বাংলাদেশকে।

দ্বিতীয় ম্যাচে ইয়েমেনকে ১-০ গোলে হারিয়ে হইচই ফেলে দেয় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র গোলটি করেছিলেন মিজানুর রহমান। ইয়েমেনকে হারিয়ে অবশ্য আফসোসই করতে হয়েছিল দলকে। পরের ম্যাচে ইয়েমেন ২-০ গোলে ভারতকে হারিয়ে দিলে গোলগড়ে বাংলাদেশকে টপকে সেমিফাইনালে উঠে যায় ভারত। প্রথম ম্যাচে ভারতের কাছে ৪-২ গোলের হারটিই কাল হয়েছিল কাজী সালাউদ্দিনের শিষ্যদের।

কাতারে খেলতে যাওয়ার আগে ব্রাদার্স থেকে ধারে দুইজন খেলোয়াড় নিয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা। তাঁরা হলেন সত্যজিৎ দাস রুপু ও  শহীদুল আহমেদ রঞ্জন।

সেই ঘটনার বর্ষপূর্তিতে এটিও সবার মনে ফিরে এল, সে সময় বাংলাদেশের ক্লাব ফুটবলও কতটা দাপটের মধ্যে দিয়ে চলত!

কাতার সফরের সেই দলটি
কোচ: কাজী সালাউদ্দিন
মোহাম্মদ মহসিন, অরুণ বিকাশ দেওয়ান, সাইফুল বারী টিটো, জুয়েল রানা, আতাউর রহমান, মাসুদ রানা, মামুন জোয়ারদার, বরুণ বিকাশ দেওয়ান, রিজভী করিম রুমি, রকিব হোসেন, ইমতিয়াজ আহমদ নকীব, মিজানুর রহমান, মোহাম্মদ আরমান মিয়া, কাজী মিজানুর রহমান, পরিমল চন্দ্র পণ্ডিত, সত্যজিৎ দাস রুপু, আরিফ হোসেন মুন, শহীদুল আহমেদ রঞ্জন।