গুলি খাওয়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে...

১৯৭৮ বিশ্বকাপ ফাইনাল। উড়ে আসা বলের অপেক্ষায় লিওপোল্ডো লুকু (সবার সামনে)। ছবি: টুইটার
১৯৭৮ বিশ্বকাপ ফাইনাল। উড়ে আসা বলের অপেক্ষায় লিওপোল্ডো লুকু (সবার সামনে)। ছবি: টুইটার

১৯৭৮ বিশ্বকাপটা এমনিতেই বিতর্কিত। হোর্হে রাফায়েল ভিদেলার স্বৈরশাসন আর নির্যাতনের প্রতিবাদে অনেক দেশের আর্জেন্টিনায় ওই বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া নিয়ে আপত্তি, একই কারণে ডাচ কিংবদন্তি ইয়োহান ক্রুইফের শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ না খেলা, স্বাগতিক আর্জেন্টিনা গ্রুপ পর্বে নিজেদের ম্যাচগুলো সুবিধাজনক সময়ে রাখা, পেরুর বিপক্ষে বাঁচামরার ম্যাচে ৬-০ গোলের প্রশ্নবিদ্ধ জয়, এমন আরও অনেক কারণে ওই বিশ্বকাপটাকে সবচেয়ে কুৎসিত বিশ্বকাপ মনে করেন অনেকেই।


সেই বিশ্বকাপের ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়নও স্বাগতিক আর্জেন্টিনাই। তবে এসব বিতর্ক এক পাশে রেখে পারফরম্যান্সের কথা এলে আর্জেন্টাইন স্ট্রাইকার মারিও কেম্পেসের কথা আসে। আসার কথা লিওপোল্ডো লুকুর কথাও, তবে তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয় কমই। ৪ গোল করে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন আর্জেন্টিনার জন্য। এর মধ্যে দ্বিতীয় রাউন্ডের ফ্রান্সের বিপক্ষে দূরপাল্লার ভলিতে করা গোলটি সেরা। সে যাই হোক, এত দিন পর সেই লুকু মুখ খুলেছেন। স্মৃতিচারণ করেছেন স্বৈরশাসনের সেই ভয়ংকর সময়টার। আর্জেন্টাইন সংবাদমাধ্যম ক্লারিনকে তিনি বলেছেন, স্বৈরাচার হোর্হে রাফায়েল ভিদেলার সৈন্যদের দ্বারা তিনিও অপহরণের শিকার হয়েছিলেন। বেঁচে থাকাটা তাঁর কাছে অলৌকিক লাগে।

টেলিফোনে আলাপচারিতায় লুকু বলেন, ‘কখনো বলিনি এসব। শুরুতে ভয় ছিল। ওরা আমাকে চেনে, কোথায় থাকি জানে, নিশ্চয়ই ধরতে আসবে। তবে একটা কথা শুনে খুব রাগ লাগে, যখন সবাই বলে স্বৈরতন্ত্রের জন্যই আমরা চ্যাম্পিয়ন (১৯৭৮ বিশ্বকাপ) হতে পেরেছি। অপহরণের শিকার হয়েছি। ডাকাতিও। এবং অলৌকিকভাবে ওরা আমাকে হত্যা করেনি। শুধু একটা কথা বলি, হাঁটতে হাঁটতে বাইরের ফাঁকা মাঠে আসার সময় শুধু মনে হচ্ছিল গুলি করবে।’

১৯৭৯ সাল। মনুমেন্টাল স্টেডিয়াম। লুকুর মতে দিনটি ছিল বুধবার। রিভার প্লেট সতীর্থদের ম্যাচ দেখতে গিয়েছিলেন। খেলা শেষে তিনি ফিরছিলেন গাড়িতে করে। বাসার কাছে এসে মোড় ঘুরতেই রিয়ার ভিউ মিররে দেখতে পেলেন আরেকটি গাড়ি তাঁকে অনুসরণ করছে। গতি বেশ ভালো। রিভার প্লেটের ‘নম্বর নাইন’ এবার ছুটলেন। তবু গাড়িটাকে ছোটাতে পারলেন না। হাল ছেড়ে গতি কমিয়ে রাস্তার এক পাশ দিয়ে চালাচ্ছিলেন লুকু। গাড়িটা তাঁকে গিয়ে থামল সামনের ব্লকে। ভয় দানা বেঁধে উঠল লুকুর শিরদাঁড়া বেয়ে।

দুই বছর আগে মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামে লুকু। ছবি: ক্লারিন টুইটার
দুই বছর আগে মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামে লুকু। ছবি: ক্লারিন টুইটার

লুকুর ভাষায়, ‘এক হাতে পুলিশের ব্যাজ এবং অন্য হাতে পিস্তল নিয়ে একটা লোক নামল গাড়ি থেকে। কাছে এসে কাগজপত্র দেখতে চাইল। দেখালাম। এর মধ্যে অন্য একজন আমার পাশের সিটে বসে গ্লোভ বক্স থেকে সব কাগজপত্র নিয়ে নেয়। হুমকিও পেলাম “চুপচাপ বসে থাক, নইলে মাথা উড়িয়ে দেব।”’
অপহরণ-কাণ্ডে আরও একটি গাড়ি ছিল। অপহরণকারীদের সঙ্গে ছিল। এদিকে লুকুকে নিয়ে তাঁর-ই গাড়িতে চেপে উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরছিল অপহরণকারীরা।

৭১ বছর বয়সী সাবেক এ স্ট্রাইকারের ভাষায়, অপহরণকারীরা অন্ধকার নামার অপেক্ষায় ছিল। এরপর তাঁকে ফাঁকা মাঠে নিয়ে বন্দুক ঠেকিয়ে গাড়ি থেকে নামানো হয়। ‘তখন বুঝতে পারলাম অন্য গাড়িটা ওদেরই সঙ্গে’ বলে যান লুকু, কড়া গলায় নির্দেশ এল ‘হাঁটো’।

‘ফাঁকা মাঠে হেঁটে চলার সময় বারবার মনে হচ্ছিল এই বুঝি গুলি করবে! হাঁটছি, হাঁটছি...হঠাৎ টের পেলাম গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ। ঘুরে দেখি আমার গাড়িটাই। প্রাণ বেঁচে যাওয়ার শ্বাস নিলাম’ বলেন লুকু। গাড়ি তো গেলই সঙ্গে তাঁর চেইন ও আংটিও। ওদিকে বাসায় অপেক্ষায় তাঁর স্ত্রী।

পিরিনগুনদিন অঞ্চলে আসার পর কিছু লোকের দেখা পান লুকু। বুঝিয়ে বলেন যে ডাকাতির শিকার হয়েছেন। পুলিশের সাহায্য লাগবে। কিন্তু তারা সাফ বলে দেয়, পুলিশের সঙ্গে ঝামেলায় জড়ানো যাবে না। লুকু এরপর রাস্তায় গাড়ি থামানোর চেষ্টা করেন। এক চালক গাড়ি থামিয়ে তাঁকে জিজ্ঞেস করেন ‘লিওপোল্ডা লুকু না?’ সেই লোক তাঁকে পৌঁছে দেন বাড়িতে। এরপর শুরু হলো ঘটনার দ্বিতীয় পর্ব।

লুকুর বাসা থেকে কিছু দূরেই পুলিশ স্টেশন। সেখানে গিয়ে ঘটনাটা জানালেন তিনি। পুলিশ তাঁকে চিনতে পেরে খুব ‘ভালো আচরণ করে’ বলেন লুকু। পুলিশ কমিশনার পিস্তল বের করে জানতে চেয়েছিলেন ‘ওরা কি এই পিস্তল তাক করেছিল?’ লুকুর জবাব, ‘আমি কীভাবে জানব। অস্ত্র নিয়ে কিছু জানি না। কখনো ছিল না।’

মারিও কেম্পেসের সঙ্গে ক্লাব ম্যাচে লুকু। ছবি: টুইটার
মারিও কেম্পেসের সঙ্গে ক্লাব ম্যাচে লুকু। ছবি: টুইটার

কমিশনার এরপর অন্য এক পুলিশ সদস্যকে ডেকে আনেন। তাঁর চুল দেখিয়ে জানতে চান, ওদের চুল কি এমন ছিল? লুকু বলেন ‘হ্যাঁ, কিন্তু বোঝাতে চাচ্ছেন কি?’ কমিশনার জানান, ওরা পুলিশ অথবা সামরিক বাহিনীর সদস্য।

অপহরণের দুই মাস পর একদিন দুপুরে সতীর্থদের সঙ্গে অনুশীলন করছিলেন লুকু। সামনে ইউরোপ সফর। এক পুলিশ কর্মকর্তা এসে লুকুর সঙ্গে দেখা করে জানান, তাঁর গাড়িটা পাওয়া গেছে। অনিচ্ছাস্বত্ত্বেও পুলিশের সঙ্গে যেতে হয় লুকুকে। সেখানে একজন সন্দেহভাজন এক সামরিক সদস্যকে চিনতে পারেন তিনি। কিন্তু পরে আবার কোন ঝামেলা হবে, এই ভয়ে কিছু বলেননি।

’৭৮ বিশ্বকাপের ৪২ বছর পর স্বৈরশাসনের সেসব দিন নিয়ে লুকু সোজাসাপ্টাই বলেন, ‘আমরা জানতাম লাশগুলো নদীতে ফেলা হয়। শিশুদের অপহরণ করা হয়। হত্যা ও অত্যাচার তো ছিলই। কিন্তু এসব করেও তারা সবকিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। এমন না যে আমরা কিছুই জানতাম না। কিন্তু কেউ কিছুই বলেনি।’