গ্যারেথ বেলকে কি সবাই ভুলেই গেল?

এক সময় এটাই ছিল নিয়মিত দৃশ্য।ছবি : রয়টার্স

‘মাইকনকে ট্যাক্সি এনে দাও!’

তারস্বরে চেঁচিয়ে যাচ্ছেন মাঠভর্তি টটেনহাম সমর্থকেরা। আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলে বুঝি এমনই করে মানুষ! চোখের সামনে মাঠের বাঁ-প্রান্ত থেকে একের পর এক জাদু দেখিয়ে যাচ্ছেন গ্যারেথ বেল। সেই গ্যারেথ বেল, যে ছেলেটা আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের চোখের সামনে বড় হয়েছে। হ্যাংলা-পটকা একজন লেফটব্যাক থেকে বিদ্যুৎগতির এক উইঙ্গারে পরিণত হয়েছে। ছেলেটা যে তাঁদের বড়ই আপন! ঘরের ছেলে ভালো করলে কার না গর্ব হয়?

বিদ্যুৎগতির দৌড় তো আছেই, সঙ্গে মাপা ক্রস, সতীর্থদের সঙ্গে দ্রুত পাস আদান-প্রদান কিংবা হালকা ড্রিবলের ঝলকানি—বেলের কাছে প্রতি মুহূর্তে নাকানিচুবানি খাচ্ছিলেন ইন্টারের ব্রাজিলিয়ান রাইটব্যাক মাইকন; যে মাইকন তখন অনেকের মতেই নিজের পজিশনে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। যার জন্য বার্সেলোনার দানি আলভেস পর্যন্ত নিয়মিত জায়গা পান না জাতীয় দলে। বেলের সামনে সেই মাইকন দৌড়ে হাঁপিয়ে যাচ্ছেন, তাল মেলাতে পারছেন না—টটেনহাম সমর্থকদের গলা থেকে মাইকনকে ট্যাক্সি এনে দেওয়ার আরজি তো শোনা যাবেই, যাতে অপমানের মাত্রা আরও বেশি হওয়ার আগেই পাততাড়ি বাড়ি ফিরতে পারেন এই রাইটব্যাক!

একবিংশ শতাব্দীতে শুধু একটা ট্রফিই জেতা হয়েছে, তাও একটা লিগ কাপ। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, চেলসি, লিভারপুল কিংবা আর্সেনালের দৌরাত্ম্যে লিগ জয় তো দূর, শীর্ষ চারে থেকে পরের মৌসুমে চ্যাম্পিয়নস লিগে খেলার আশাটাও করা যায় না শান্তিমতো। এমন এক দলের সমর্থকদের সুখ তো এভাবেই খুঁজে নিতে হয়, ছোট ছোট জিনিস থেকে। ঘরের ছেলে বিশ্বসেরা এক তারকাকে এভাবে ঘোল খাইয়ে ছেড়ে দিচ্ছে, টটেনহাম সমর্থকদের জন্য সেটাই অনেক বেশি কিছু ছিল তখন। পেটের দায়ে সারা সপ্তাহে বেগার খাটার পর সপ্তাহান্তে হোয়াইট হার্ট লেনে তো এমন ছোট খাট সুখের সন্ধানেই আসেন তাঁরা!

সমর্থকদের ছোট খাট এমন অনেক স্বপ্নই পূরণ করেছিলেন তখন বেল। সে দিন নিজেদের মাঠে চ্যাম্পিয়নস লিগের গ্রুপপর্বে ইন্টারকে ৩-১ গোলে হারিয়েছিল টটেনহাম। ওই আসরে দুই দলের সেটা ছিল দ্বিতীয় দেখা। বেল গোল না করতে না পারলেও গোটা ম্যাচে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন। সবাইকে দেখিয়েছিলেন, বিদ্যুৎগতির কোনো উইঙ্গার ফর্মে থাকলে কেমন করতে পারে!

আচ্ছা, মাইকনের নিজের তখন কী মনে হচ্ছিল? সদ্য একুশে পড়া এক ছেলের কাছে এভাবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুই সপ্তাহে দুবার দৌড়ের পাঠ নিতে হচ্ছে, আগের বার তো তাও এটা বলে পার পাওয়া গিয়েছিল যে ম্যাচের আগে ‘২৪ ঘণ্টার ফ্লু’তে আক্রান্ত ছিলেন, তাই ঘরের মাঠে বেলের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। পরের মাঠেও যখন একই ভাগ্য বরণ করতে হলো, মাইকন নিজেকে এই বলে শাপশাপান্ত করতেই পারেন, যে অন্য কোনো রোগের নাম নিলে হয়তো সে বাহানা এবারও চালানো যেত!

ইন্টারের বিপক্ষে সেই ম্যাচ।
ছবি : এএফপি

বেলকে নিয়ে উত্তেজনা-উদ্দীপনা কিন্তু সেদিনই শুরু হয়নি। সে জন্য পেছনে ফিরতে হবে আরও দুই সপ্তাহ। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস লিগ খেলতে যাওয়া টটেনহাম প্রথম রাউন্ডেই পড়েছে চ্যাম্পিয়ন ইন্টার মিলানের গ্রুপে। আগের দুই ম্যাচে এফসি টোয়েন্টে ও ভের্ডার ব্রেমেন থেকে চার পয়েন্ট আদায় করা স্পার্সের মূল পরীক্ষাটা ছিল ইন্টারের মাঠে, গ্রুপপর্বের ঠিক পরের ম্যাচটায়। এ ম্যাচে আলো ছড়াতে পারলেই কেল্লাফতে, চারদিকে টটেনহামকে নিয়ে শোরগোল পড়ে যাবে, সবাই সমীহ করা শুরু করবে, স্বপ্নের মতো এক মৌসুম কাটবে, আজীবন নাতি-নাতনিদের শোনানোর জন্য পাওয়া যাবে গল্প।

সে ম্যাচের শুরুটাই হলো দুঃস্বপ্নের মতো। ফরাসি সেন্টারব্যাক উইলিয়াম গালাসের অবস্থানগত ত্রুটির সুযোগ নিয়ে স্ট্রাইকার স্যামুয়েল ইতোর কাছ থেকে আসা বল নিয়ন্ত্রণে রেখে দুই মিনিটেই ইন্টারকে এগিয়ে দেন কিংবদন্তি অধিনায়ক হাভিয়ের জানেত্তি। এর পাঁচ মিনিট পর আরও বড় যন্ত্রণা, ফরাসি উইঙ্গার জোনাথন বিয়াবিয়ানিকে অন্যায়ভাবে ফেলে দিয়ে লাল কার্ড দেখে বসেন মূল গোলরক্ষক হিউরেলিও গোমেস। অবস্থাটা বুঝুন, চ্যাম্পিয়নস লিগে নিজেদের প্রথম হাই প্রোফাইল ম্যাচের সাত মিনিটেই একজন মূল তারকা মাঠ থেকে বহিষ্কৃত! ৩৫ মিনিট যেতে না যেতে আরও দুই গোল খেয়ে বসে টটেনহাম। সর্বত্র তখন আলোচনা, এক ম্যাচে সবচেয়ে বেশি গোল খাওয়ার রেকর্ডটা কী এবার হয়েই যাবে?

ব্যাপারটা বেলের পছন্দ হলো না। ৪-৪-২ ছকে মিডফিল্ডের বাঁ দিকে শুরু করা বেল দ্বিতীয়ার্ধে একাই ম্যাচের মোড় ঘোরাতে শুরু করলেন। প্রথাগত লেফট উইঙ্গার চাইলে কী করতে পারেন, সেটা যেন চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন বেল। গুনে গুনে তিনটা গোল করলেন, প্রত্যেকটা গোলই হলো প্রায় একই ভাবে। বেলের বাঁধ-না-মানা দুরন্ত গতির কাছে জানেত্তি-মাইকনদের অসহায় আত্মসমর্পণ, ক্ষণিকের ব্যবধানে নিজেদের ডি-বক্স থেকে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সে ঢুকেই বাঁ পায়ের মাটিঘেঁষা এক জোরালো শট, দূরের পোস্টে সে বলের জালে জড়ানো, অতঃপর গোলরক্ষক জুলিও সিজারের হতাশায় মাথা নাড়ানো।

ইংল্যান্ডে বেল ঠিক কেমন খেলোয়াড় ছিলেন, এই ম্যাচটা তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ।
অথচ বেল যখন প্রিমিয়ার লিগে খেলা শুরু করলেন, তাঁকে ‘কুফা’ ছাড়া কিছুই ভাবা হতো না। অভিষেকের পর টানা চব্বিশ ম্যাচ খেলে জয়হীন থেকেছিলেন। ফলে একটা ধারণা হয়ে গিয়েছিল, বেল মাঠে থাকা মানেই দলের পরাজয়! শেষমেশ ইচ্ছে করে এই ‘কুফা’ কাটানোর ব্যবস্থা করলেন তৎকালীন স্পার্স কোচ হ্যারি রেডন্যাপ। বার্নলির বিপক্ষে এক ম্যাচে আইরিশ স্ট্রাইকার রবি কিনের চার গোলের সুবাদে ৫-০ গোলে জয় পেয়েছিল স্পার্স, সে ম্যাচের একদম শেষ মুহূর্তে বেলকে মাঠে নামিয়েছিলেন রেডন্যাপ। কারণ ওই যে, মাঠে থেকে ম্যাচে জয়লাভ করার স্বাদটা যেন পান বেল। ‘কুফা’টা যেন কাটে!

মরিনিওকেও মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন বেল। এখন খেলবেন মরিনিওর অধীনেই।
ছবি : রয়টার্স

এই ‘কুফা’ তারকাই পরে এমন দুর্দান্ত খেলা শুরু করলেন, ম্যানেজাররা তাঁকে ঘিরে পরিকল্পনা বানাতে লাগলেন। ম্যানেজারদের চিন্তা-ভাবনায় এক নতুন দিগন্ত এনে দিলেন বেল। কীভাবে? একটু আলোচনা করা যাক।

ঐতিহ্যগতভাবেই উইঙ্গারদের ক্ষেত্রে একটা বাঁধাধরা নিয়ম মানা হতো। উইঙ্গারদের কাজও ছিল অনেকটা একমাত্রিক। উইঙ্গারদের পক্ষেও যে গোল করা সম্ভব, এটা অনেকে মানতে চাইতেন না। দৌড়াতে দৌড়াতে একদম সাইডলাইনে যাও, সেখান থেকে বক্সে থাকা স্ট্রাইকার বা মিডফিল্ডারকে ক্রস দাও—এটাই ছিল উইঙ্গারদের প্রধান কাজ। ফলে, বাম পায়ের উইঙ্গারদের খেলানো হতো বাম উইংয়ে, ডান পায়ের উইঙ্গারদের ডান উইংয়ে। যাতে মাঠের এক প্রান্ত থেকে নিখুঁত ক্রস করতে সুবিধা হয়। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের দুই কিংবদন্তি উইঙ্গার রায়ান গিগস আর ডেভিড বেকহামের কথাই ধরুন। বেকহামের ছিল দুর্দান্ত এক ডান পা, ওদিকে গিগসের বাঁ পা ছিল তাঁর ডান পায়ের চেয়ে ভালো। দুজনকে যথাক্রমে ডান ও বাঁ প্রান্তে খেলানো হলে বক্সে থাকা অ্যান্ডি কোল, ডুইট ইয়র্করা একের পর এক নিখুঁত ক্রস পাবেন। এ আশায় বেকহামকে ডানদিকে আর গিগসকে বাঁ দিকে খেলিয়ে গেছেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন।

এরপর ফুটবল মাঠের অন্যান্য পজিশনের মতো উইঙ্গারদের ভূমিকা পরিবর্তিত হতে লাগল। উইঙ্গারদের শুধু ক্রসদাতা নয়, গোলদাতা হিসেবেও দেখা শুরু করলেন ম্যানেজাররা। ফলে উইঙ্গারদের পজিশন বদলে ফেলা হলো। ডান পায়ের উইঙ্গারদের বাঁ দিকে, আর বাঁ পায়ের উইঙ্গারদের ডান দিকে খেলাতে শুরু করলেন ম্যানেজাররা। বেল যে বছর নিজেকে চেনানো শুরু করলেন, সে বছর ম্যানচেস্টার সিটির ম্যানেজারই যেমন, ডান পায়ের ওয়েলস উইঙ্গার ক্রেইগ বেলামিকে খেলিয়েছেন বাম উইংয়ে, ওদিকে বাঁ পায়ের ইংলিশ উইঙ্গার অ্যাডাম জনসন খেলেছেন ডান উইংয়ে।

ডান পায়ের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো তত দিনে অধিক গোলের আশায় লেফট উইঙ্গার হিসেবে খেলা শুরু করে দিয়েছেন। ২০১০ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলা দুই দল এমন উল্টো উইঙ্গারই খেলিয়েছিল। ইন্টারের বাম পায়ের খেলোয়াড় স্যামুয়েল ইতো খেলেছিলেন ডান উইংয়ে, ডান পায়ের গোরান পানদেভ বাম উইংয়ে। বায়ার্নে ডান পায়ের ফ্রাঙ্ক রিবেরির লেফট উইংয়ে খেলা কিংবা বাম পায়ের আরিয়ান রোবেনের ডান দিকে খেলা তত দিনে চোখে সয়ে গেছে। ম্যানেজারদের আধুনিকতার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্যই যেন ছিল এটা।

‘বেলকে থামাও’—টটেনহামের বিপক্ষে ম্যাচ হলেই ম্যানেজারদের চিন্তার সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে থাকতও এই দুই শব্দ।

কিন্তু হ্যারি রেডন্যাপের অধীনে টটেনহাম আবার অত আধুনিকতার ধার ধারেননি। আগের ম্যানেজার হুয়ান্দে রামোস আধুনিক ফুটবল দিয়ে স্কোয়াডে বৈপ্লবিক একটা পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন, পারেননি। একপর্যায়ে আট লিগ ম্যাচে মাত্র দুই পয়েন্ট জুটেছিল স্পার্সদের কপালে। তাই রামোসের জায়গায় যখন রেডন্যাপকে আনা হলো, তাঁর দর্শনই ছিল, অতি আধুনিকতা অনুসরণকারী হাজারো দলের মধ্যে তাঁর দলই খেলবে প্রাচীন পন্থায়। যার প্রভাব পড়বে স্পার্স উইঙ্গারদের খেলাতেও। বাম পায়ের খেলোয়াড় খেলবেন বাম উইংয়ে, ডান পায়ের জন ডান উইংয়ে। বেলের দুরন্ত উত্থান রেডন্যাপকে প্রাচীনপন্থী করতে সাহায্য করেছিল সবচেয়ে বেশি। বাঁ পায়ের বেল তাই নিয়মিত খেলা শুরু করলেন বাঁ উইংয়ে।

উইঙ্গাররা তাঁদের সাবেক ভূমিকাতে ভালোভাবে খেললে যে আধুনিক যুগেও চূড়ান্ত সফল হতে পারেন, চোখে আঙুল দিয়ে দেখালেন বেল। প্রমাণ? ইন্টারের বিপক্ষে ওই দুই ম্যাচ!

স্পার্স সমর্থকের সঙ্গে হাসিমুখে বেল।
ছবি : রয়টার্স

আশ্চর্যের বিষয় যেটা, বেল শুরুতে কিন্তু লেফট উইঙ্গার ছিলেন না, ছিলেন লেফটব্যাক। ক্যামেরুনের লেফটব্যাক বেনোয়া আসু-ইকোতোর কারণে মূল একাদশে জায়গা পাবেন না, এ ভেবে একপর্যায়ে বার্মিংহাম সিটির মতো ক্লাবের সঙ্গে আলোচনা করা শুরু করে দিয়েছিলেন বেল। এমন সময় আশীর্বাদ হয়ে এল আসু-ইকোতোর চোট। লেফটব্যাক হিসেবে জায়গা পেলেন বেল। রেডন্যাপের অনুসন্ধানী চোখে ধরা পড়তে দেরি হলো না, লেফটব্যাক হিসেবে খেললেও বেলের প্রতিভার পূর্ণ বিকাশ তখনই ঘটে, যখন সে সামনে চলে যায়। ফলে আসু-ইকোতো চোট থেকে ফেরার পরেও বেল দল থেকে জায়গা হারালেন না, উল্টো তাঁর পদোন্নতি হলো লেফট মিডফিল্ডার/উইঙ্গার হিসেবে। ব্যস, আর্সেনাল ও চেলসির বিপক্ষে অসাধারণ খেলে বাগিয়ে নিলেন দুটি ম্যাচসেরার পুরস্কার।

‘বেলকে থামাও’—টটেনহামের বিপক্ষে ম্যাচ হলেই ম্যানেজারদের চিন্তার সবচেয়ে বড় অংশ জুড়ে থাকতও এই দুই শব্দ। হিসেবটা পরিষ্কার, বেল থামলেই থেমে যায় টটেনহাম। ফলে বেলকে আটকানোর জন্য ডান প্রান্তে দুজন করে খেলোয়াড় রাখা শুরু করলেন প্রতিপক্ষ ম্যানেজাররা। লেফট উইঙ্গার বেলকে আটকাতে হয় রাইটব্যাক/রাইট উইঙ্গার, না হয় রাইটব্যাক/সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের জুটি ব্যবহার করা শুরু করলেন অন্য দলের ম্যানেজাররা। এভারটনের ম্যানেজার ডেভিড ময়েস যেমন বেলকে আটকাতে লেলিয়ে দিলেন রাইটব্যাক ফিল নেভিল ও রাইট মিডফিল্ডার শেমাস কোলম্যানকে (যিনি আদতে আরেকজন রাইটব্যাক ছিলেন)। বোল্টনের রাইটব্যাক গ্রেটার স্টেনসনের সঙ্গে জুটি বেঁধে বেলকে আটকে দিতেন রাইট মিডফিল্ডার লি-চুং ইয়ং। ওদিকে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের ম্যানেজার স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের পরিকল্পনা ছিল একটু ভিন্ন। রাইটব্যাক রাফায়েলের সঙ্গে বেলকে আটকানোর জন্য সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার ড্যারেন ফ্লেচারকে দায়িত্ব দিলেন তিনি। অর্থাৎ, কোনোভাবেই ‘ওয়ান-টু-ওয়ান’ পরিস্থিতি পাচ্ছিলেন না বেল, খেলতে পারছিলেন না নিজের স্বাভাবিক খেলাও।

স্পার্সের ৪-৪-২, ৪-৪-১-১ কিংবা ৪-২-৩-১ ছকে সেন্ট্রাল অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার হিসেবে তখন খেলতেন ডাচ তারকা রাফায়েল ফন ডার ভার্ট। তাঁর একটা সমস্যা ছিল, মাঝখান থেকে নড়তে চাইতেন না। ফলে বেলও বামদিক থেকে সরে ভেতরে ঢুকে খেলতে পারতেন না। এ সমস্যার সমাধান হয় রেডন্যাপ যাওয়ার পর। নতুন কোচ আন্দ্রে ভিয়াস-বোয়াস এসে বেলকে ঘিরে নিজের পরিকল্পনা করা শুরু করেন, ফন ডার ভার্টের জায়গায় আমেরিকান তারকা ক্লিন্ট ডেম্পসি, জার্মানির লুইস হল্টবি কিংবা আইসল্যান্ডের গিলফি সিগুর্ডসনকে খেলানো শুরু করলেন এই পর্তুগিজ কোচ, যারা নিয়মিত জায়গা পরিবর্তন করে খেলতে পারতেন। ফলে সুবিধা হলো বেলের। বামদিকে একাধিক প্রতিপক্ষের করা মার্কিংয়ের শিকার হলে ম্যাচের মধ্যে কখনো ডানে, কখনো বাঁয়ে, কখনো মাঝে খেলতেন বেল। একমাত্রিক লেফট উইঙ্গার থেকে বেলের বহুমাত্রিক খেলোয়াড় হওয়ার সবচেয়ে বড় ধাপ ছিল এটাই।

তত দিনে বেলের দিকে নজর পড়ে গেছে রিয়াল মাদ্রিদের। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর সঙ্গে উইং-জুটি গড়ার জন্য বেলকে উপযুক্ত মনে করলেন তৎকালীন রিয়াল কোচ জোসে মরিনিও (বেল যাওয়ার আগেই যিনি বিদায় নিয়েছিলেন) ও ক্লাব সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজ। শুধু এক জায়গাতেই সংশয় ছিল। রিয়ালের মতো ক্লাবে খেলতে হলে, রোনালদোর সঙ্গে পাল্লা দিতে হলে দুই উইংয়েই সমানতালে খেলার যোগ্যতা থাকতে হবে। বেল কি সেটা পারবেন?

রিয়ালে গিয়েছিলেন বিশ্বের সবচেয়ে দামি তারকা হয়ে।
ছবি : রয়টার্স

চূড়ান্ত জবাব এল ২০১২-১৩ মৌসুমের একদম শেষ লিগ ম্যাচে। স্যান্ডারল্যান্ডের বিপক্ষে সে ম্যাচে পুরো সময়ে মাঠের ডানদিকে ছিলেন বেল। চেষ্টা করছিলেন ডান দিক থেকে ভেতরে ঢুকে বাঁ পায়ের দূরপাল্লার জোরালো শটে গোল করার জন্য। তেমন সুবিধা করতে পারছিলেন না। একদম শেষ মুহূর্তে এল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। স্যান্ডারল্যান্ডের তরুণ লেফটব্যাক অ্যাডাম মিচেলকে বোকা বানিয়ে বাম পায়ের জোরালো শটে গোল করে বসেন বেল। টটেনহাম ম্যাচ জেতে ১-০ ব্যবধানেই। বেচারা মিচেলের আর প্রিমিয়ার লিগে খেলার সৌভাগ্য হয়নি!

বেল ছিলেন এমনই। নিজের দিনে উইং-প্লে এর ভয়ংকরতম সৌন্দর্য দেখা যেত তাঁর বাঁ পায়ে। দয়ামায়াহীন খেলায় প্রতিপক্ষকে স্তব্ধ বানিয়ে দিতেন, শেষ করে দিতেন মাইকন-মিচেলদের ক্যারিয়ার। সাত বছর পর সেই বেল যখন আবারও লন্ডনে ফিরছেন, টটেনহাম সমর্থকদের আশা থাকবে একটাই।

কোচের সঙ্গে ঠান্ডা লড়াইয়ে নামা বা দিনরাত গলফে বুঁদ থাকা নয়, বেল যেন বুঁদ থাকেন ফুটবলে!