ঘন ঘন পিঠ বদলালেও উপেক্ষিত 'বাংলার ম্যারাডোনা'

>

ফুটবলে ১০ নম্বর জার্সির কথা উঠলেই ভেসে ওঠে কিছু কিংবদন্তির মুখ। বিশ্ব ফুটবলে পেলে-ম্যারাডোনা থেকে শুরু করে রোনালদিনহো-জিদান হয়ে বর্তমানের লিওনেল মেসি-নেইমারের গায়ে শোভা পায় ১০ নম্বর। বাংলাদেশের জাতীয় দলের ইতিহাসে যাঁদের গায়ে উঠেছে মর্যাদার এই ১০ নম্বর জার্সি, তাঁদের কয়েকজনকে নিয়েই নতুন এই ধারাবাহিক ‘বাংলাদেশের ১০ নম্বর’

রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। ছবি: সংগৃহীত
রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বির। ছবি: সংগৃহীত

পায়ের কাজ, বল নিয়ন্ত্রণ, রক্ষণচেরা পাস—আশির দশকের মিডফিল্ডার আশিষ ভদ্র বাংলার ফুটবলে আলো কেড়েছিলেন সহজেই। তাঁর নেতৃত্বে ইতিহাসে প্রথম বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে খেলে বাংলাদেশ দল। অধিনায়কত্বের বাহুবন্ধনীর সঙ্গে গায়ে ছিল ১০ নম্বর জার্সি। অবশ্য এর আগে ১৯৮৪ সালের এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব দিয়েই বাংলাদেশের ১০ নম্বর গায়ে অভিষেক ঘটে এই মিডফিল্ডারের।

১৯৭৩ থেকে ১৯৮৩ সাল পর্যন্ত জাতীয় দলের ১০ নাম্বার জার্সি ছিল সালাউদ্দিনের গায়ে। পরের ১৫ বছর ১০ নম্বর জার্সি হাত বদল হয়েছে মিউজিক্যাল চেয়ারের মতো। ১৯৯৯ সালে আলফাজ আহমেদ যুগ শুরুর আগপর্যন্ত বাংলাদেশের ১০ নম্বর দেখা গিয়েছে খন্দকার ওয়াসিম ইকবাল, রিজভী করিম রুমি, মামুন জোয়ার্দ্দার, মিজানুর রহমান, ইমতিয়াজ আহমেদ নকীবদের গায়ে। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত ১০ নাম্বার জার্সিতে স্থায়ী হতে পারেননি কেউই ।

১৯৮২ সালে প্রেসিডেন্ট গোল্ডকাপে বাংলাদেশ লাল দলের হয়ে বাদল রায়ের গায়ে ১০ নম্বর উঠেছিল। কায়েদ-ই-আজম ট্রফিতে সালাম মুর্শেদীর জার্সি ১০ নম্বর থাকলেও তিনি একাদশে প্রথম পছন্দ ছিলেন না। আবার কোচের সঙ্গে মনোমালিণ্যে ‘বাংলার ম্যারাডোনা’খ্যাত রুম্মান বিন ওয়ালি সাব্বিরের দেশের হয়ে ১০ নাম্বার জার্সিতে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সৌভাগ্য হয়নি। এ ছাড়া দেশের অন্যতম সেরা স্ট্রাইকার বা ফরোয়ার্ড হওয়া সত্ত্বেও ১০ নাম্বার জার্সির প্রতি ঝোঁক ছিল না শেখ মোহাম্মাদ আসলাম ও আশরাফউদ্দিন চুন্নুর। তাঁরা তাদের ক্লাবের জার্সি নম্বরেই জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পছন্দ করতেন।

বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার বলা হয় আশিষকে। মাঝমাঠ থেকে খেলাতে পারতেন অন্যদেরও। ১৯৭৮ থেকে থেকে টানা ১৯৯০ পর্যন্ত খেলেন জাতীয় দলে। দেশকে নেতৃত্বও দিয়েছেন বেশ কয়েক বছর। তাঁর গায়ে ১০ নম্বর উঠেছিল এশিয়ান কাপের বাছাইপর্ব ছাপিয়ে বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ বাছাইপর্বের মতো আসরেও। সে হিসাবে ১০ নম্বর জার্সিতে আশিষ ভদ্রের মোট ১১টি ম্যাচ খেলার তথ্য পাওয়া যায়। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে কলকাতায় ভারতের বিপক্ষে ২-১ গোলে হেরে যাওয়া ম্যাচে বাংলাদেশের পক্ষে একমাত্র গোলটি ছিল তাঁর।

তবে আশিষের কণ্ঠে বিনয়, তিনি নাকি ১০ নম্বর জার্সির যোগ্যই ছিলেন না, ‘এশিয়ান কাপ বাছাইপর্ব ও বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলেছি। তবে আমি মনে করি ১০ নম্বর পরার যোগ্য আমি ছিলাম না। এর জন্য বিশেষ খেলোয়াড় হতে হয়। সব ম্যাচে ভালো খেলতে হয়। ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে হয়। আমি সে রকম কোনো খেলোয়াড় ছিলাম না বলে এই জার্সি গায়ে অস্বস্তি বোধ করতাম।’

আশিষের হিসাবে জাতীয় দলের হয়ে তিনি ২৫ টির ওপরে ম্যাচ খেলেছেন। গোল আছে ৮-১০ টির মতো। ১৯৮২ সালে দিল্লি এশিয়ান গেমসে মালয়েশিয়ার বিপক্ষে ২-১ গোলে জেতা ম্যাচে করা গোলটিকেই নিজের সেরা মানেন আশীষ, ‘দিল্লি এশিয়ান গেমসে আমরা প্রথম মালয়েশিয়াকে হারাই। প্রথমে আমার গোলেই এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। সেটিই আমার ক্যারিয়ারের সেরা গোল।’

ক্লাব ফুটবলে সালাউদ্দিনের মতো আবাহনীর ঘরের ছেলে হয়ে ওঠেন আশিষও। তাঁর পরে জাতীয় দলে ১০ নম্বর জার্সি ওঠে ব্রাদার্স ইউনিয়নের ঘরের ছেলে ওয়াসিম ইকবালের গায়ে। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সাল—পুরো এক দশক জাতীয় দলের হয়ে খেলেন এই উইঙ্গার। ১৯৮৭ সালে কলকাতা সাফ গেমসে ছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। গায়ে ছিল ১০ নম্বর জার্সিও। এক জরিপে ১৯৮০ এর দশকের সেরা খেলোয়াড়ের তকমা পাওয়া ওয়াসিমের দখলে জাতীয় দলের ১০ নম্বর জার্সি ছিল ১৯৯০ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও।

তবে আশিষের মতো ওয়াসিমের কণ্ঠেও বিনয়, ‘আমি কলকাতা সাফ গেমস ও বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ১০ নম্বর পরে খেলেছিলাম। আসলে ওই জার্সি পরার মতো আর কেউ ছিল না বলেই হয়তো আমাকে দেওয়া হয়েছিল। ১০ নম্বর জার্সি পরে সালাউদ্দিন ভাই খেলতেন। এটা তাঁকেই বেশি মানাত। ওনার অবসরের পর আসলাম ভাই, চুন্নু ভাইরা থাকলেও তাঁরা ক্লাবের নম্বরে খেলতেই পছন্দ করতেন।’ ওয়াসিমের ১০ নম্বর জার্সিতে ম্যাচ খেলা হয়েছে আনুমানিক ৯টি। বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে থাইল্যান্ডের বিপক্ষে ৩-১ গোলে জয়ের ম্যাচে তাঁর একটি গোলও ছিল।

ওয়াসিমের পরবর্তী সময়ে জাতীয় দলে ১০ নাম্বার জার্সি পরে খেলা তিন ফরোয়ার্ড বর্তমানে কানাডাপ্রবাসী। তাঁরা হলেন রিজভী করিম রুমি, মামুন জোয়ার্দ্দার ও মিজানুর রহমান। আশির দশকের শেষ থেকে নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত রুমি আলো ছড়ান বাংলাদেশের ফুটবলে। পোশাক, চাল-চলনে ছিল আভিজাত্যের ছোঁয়া। ১৯৮৮ সালে আবুধাবিতে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে বাংলাদেশের জার্সিতে অভিষেক, খেলেন ১৯৯৪ পর্যন্ত। চোট বাধা হয়ে দাঁড়ানোয় আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। তবে ক্লাব ফুটবলে আবাহনী ও মুক্তিযোদ্ধার হয়ে অনেক বছর খেলেছেন।

১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের অধিনায়ক আশীষ ভদ্র (লাল জার্সি)। ছবি: আশীষ ভদ্রের সংগ্রহ থেকে
১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের অধিনায়ক আশীষ ভদ্র (লাল জার্সি)। ছবি: আশীষ ভদ্রের সংগ্রহ থেকে

১৯৯২ সালে থাইল্যান্ডে এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বে ১০ নম্বর জার্সি গায়ে বাংলাদেশ দলকে নেতৃত্ব দেন রুমি। মুঠোফোনে টরেন্টো থেকে শোনালেন সেই গল্প, ‘জাতীয় দলের হয়ে আমি সম্ভবত ওই একটি টুর্নামেন্টেই ১০ নম্বর জার্সি পরে খেলেছিলাম। এছাড়া আমার আর সৌভাগ্য হয়নি। সত্যি কথা বলতে ১০ নাম্বার জার্সির প্রতি আমার তেমন আগ্রহও ছিল না।’

তবে ১৯৯১ কলম্বো সাফ গেমসেও তাঁর গায়ে ছিল ১০ নম্বর জার্সি। সে হিসেবে রুমি জাতীয় দলের ১০ নম্বর জার্সিতে ম্যাচ খেলেছেন আনুমানিক পাঁচটি। জাতীয় দলে ১৭ নম্বর জার্সিতেই বেশি খেলতে দেখা গেছে কলকাতা লিগে মোনেম মুন্না ও শেখ মোহাম্মাদ আসলামের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলে খেলা রুমিকে।

১৯৯৪ বিশ্বকাপ বাছাইপর্বেও রুমির গায়েই ওঠার কথা ছিল ১০ নম্বর জার্সি। দেশে এই জার্সিও জন্য ঘোষণা করা হয়েছিল তাঁর নামই। কিন্তু জাপানে অনুষ্ঠিত বাছাইপর্বে গিয়ে দেখা যায় জার্সির পেছনে লেখা মামুন জোয়ার্দ্দারের নাম! ব্যস, পুরো বাছাইপর্ব ১০ নম্বর নিয়েই খেললেন মামুন। সেই হিসেবে ১০ নম্বর জার্সিতে তাঁর খেলা হয়েছে আটটি ম্যাচ। তবে ১০ নম্বও সৌভাগ্যক্রমে পেয়েছিলেন বলে জানান মামুন, ‘জার্সিটি আমার ভাগ্যে পড়ে গিয়েছিল। ১০ নম্বর মানে বিরাট ব্যাপার। যখন পেলামই , তখন ভাবলাম এর মান আমাকে রাখতে হবে।’

বাছাইয়ে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জয়ী হওয়া দুটি ম্যাচেই গোল করেছিলেন মামুন। আর জাপানের বিপক্ষে ৪-১ গোলে হারা ম্যাচে বাংলাদেশের হয়ে একমাত্র গোলটি করেছিলেন রুমি। পুরো বাছাইপর্বে জাপান ওই একটি গোলই হজম করেছিল।

১০ নম্বর প্রসঙ্গে এর পরেই আসে আরেক কানাডা প্রবাসী সাবেক ফরোয়ার্ড মিজানুর রহমানের কথা। বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক ট্রফি জয়ের সঙ্গে জড়িয়ে তাঁর নাম। ১৯৯৫ সালে অটো ফিস্টারের অধীনে মোনেম মুন্নার নেতৃত্বে মিয়ানমারে যে টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল বাংলাদেশ, তাতে মিজানের গায়েই ছিল ১০ নম্বর। ১৯৮৯ সালে ইসলামাবাদ সাফ গেমসে অভিষেকের পর জাতীয় দলের হয়ে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত খেলা মিজানকে ১০ নম্বর জার্সি দিয়ে অবাকই করে দিয়েছিলেন অটো ফিস্টার। মিজান বলছিলেন, ‘মিয়ানমারে কোচ অটো ফিস্টার আমাকে বললেন, তুমি ১০ নম্বর পরবে। আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। জাতীয় দলের হয়ে সম্ভবত ওই একটা টুর্নামেন্টেই ১০ নাম্বার পরে খেলেছি।’

আলফাজ অধ্যায় শুরু হওয়ার আগে জার্সিটি উঠেছিল ইমতিয়াজ আহমেদ নকিবের গায়েও। ১৯৯৭ সালের সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে ১০ নাম্বার জার্সিতে খেলেন নকিব। যদিও এখন আর তাঁর সেটি মনে নেই। ১০ নম্বর জার্সিটি উঠতে পারত ‘বাংলার ম্যারাডোনা’খ্যাত সাব্বিরের গায়েও! ১৯৯৩ সালে কাতারের একটি ক্লাবের বিপক্ষে বাংলাদেশের প্রীতি ম্যাচে ১০ নম্বর নিয়ে খেললেও আন্তর্জাতিক ম্যাচে এই জার্সি পরে কখনোই খেলা হয়নি তাঁর। এর পেছনে রাজনীতিকেই দায়ী করেছেন সাব্বির, ‘আমি অনূর্ধ্ব– ১৬, ১৯ ও ২৩ দলের হয়ে ১০ নাম্বার জার্সিতে খেলেছি। জাতীয় দলের হয়ে যখন খেলব, তখন কোচের (কাজী সালাউদ্দিন) সঙ্গে ঝামেলার জন্য তিনি আমাকে ১০ নাম্বার পরতে দেননি। অধিনায়কত্বও দেননি। এর পরে তো চোটেই পড়ে গেলাম।’