জমজমাট লিগের আশা বাড়াল ফেডারেশন কাপ

যোগ্যতর দল হিসেবেই ফেডারেশন কাপ জিতেছে বসুন্ধরা কিংস।ছবি: প্রথম আলো

বসুন্ধরা কিংস ও সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের ৯০ মিনিটের লড়াই শেষে ফেডারেশন কাপের শিরোপা শেষমেশ উঠেছে গতবারের চ্যাম্পিয়ন বসুন্ধরার হাতেই। শক্তিমত্তা ও ফর্মের বিচার করলে যোগ্যতম দুটি দলই উঠেছিল ফাইনালে। আর ফাইনালে বসুন্ধরা নিজেদের শ্রেয়তর প্রমাণ করেই শিরোপা জিতেছে। গোটা টুর্নামেন্টেই ভালো খেলেছে বসুন্ধরা কিংস। সে হিসাবে শিরোপা নিয়ে কোনো অঘটন ঘটেনি। খেলোয়াড়দের মধ্যেও যাঁদের কাছ থেকে ভালো খেলা দেখার প্রত্যাশা ছিল, মোটামুটি সবাই আলো ছড়িয়েছেন। নিজেদের চিনিয়েছেন। সবচেয়ে বড় কথা, সদ্য শেষ হওয়া ফেডারেশন কাপ জমজমাট এক লিগেরই ইঙ্গিত দিয়ে গেছে।

ফাইনালটা ছিল ছোট ছোট কিছু লড়াইয়ের উপলক্ষ। এই লড়াইগুলোয় যে জিতবে, শেষে জয়ের হাসিটা তারাই হাসবে। প্রথমেই আসে মাঝমাঠের কথা। নিয়মিত অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়াবিহীন ৪-৩-৩ ছকে সাইফের তিন মিডফিল্ডারের সঙ্গে দুই উইঙ্গার, আর ৪-১-৪-১ ছকে বসুন্ধরার চার আক্রমণাত্মক মিডফিল্ডারের সঙ্গে একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার। লড়াই ছিল বিদেশিদেরও। বসুন্ধরার চার হাইপ্রোফাইল বিদেশি, না সাইফের চারজন—আসল দিনে কে বাজিমাত করবেন? দেখার উপলক্ষ একটা ছিলই। সাইফের পাঁচ গোল করা বিদেশি স্ট্রাইকার কেনেথ এনগোকে, না বসুন্ধরার চার গোল করা আর্জেন্টাইন তারকা রাউল বেসেরা—এটা কম মুখরোচক লড়াই ছিল না। প্রতিক্ষেত্রেই বসুন্ধরা জিতেছে হেসেখেলে।

সাইফও এবারের মৌসুমের বড় প্রতিপক্ষ।
ছবি: প্রথম আলো

যত ভালো খেলোয়াড়ই হোক না কেন, আসল দিনে জ্বলে উঠতে না পারলে যে কিছুই হয় না, সেটারই আরেকটা উদাহরণ হয়ে থাকবে সাইফের খেলা। সাইফের খেলার সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল তাদের দুর্দান্ত বাঁ দিক—যেখানে তর্কযোগ্যভাবে দেশসেরা লেফটব্যাক ইয়াসিন আরাফাতের সামনে নাইজেরিয়ান বক্স-টু-বক্স মিডফিল্ডার জন ওকোলি ও প্রতিভাবান লেফট উইঙ্গার ফয়সাল আহমেদ ফাহিম মিলে বেশ ভালোই ত্রাস সৃষ্টি করেছিলেন গোটা টুর্নামেন্টে। সেদিক ভালোভাবে সামাল দিতে পারলেই যে শিরোপা বসুন্ধরার, সেটা বেশ ভালোই বুঝেছিলেন দলটার স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোন। রাইটব্যাক বিশ্বনাথ, ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার মাসুক মিয়া জনি, জোনাথন ফার্নান্দেজ ও রাইট উইঙ্গার মতিন মিয়া মিলে বেশ ভালোই নিষ্ক্রিয় রেখেছিলেন সাইফের ওদিকটা। এতটাই যে লেফটব্যাক ইয়াসিন তেমন ওপরে উঠতেই পারেননি, করতে পারেননি ফলদায়ক কোনো আক্রমণ।

বিশেষ করে মাসুক মিয়া জনির খেলা আবারও আশা জাগিয়েছে। দেশীয় এই ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডারের মান নিয়ে কখনোই তেমন প্রশ্ন তোলার অবকাশ ছিল না, কিন্তু এ ম্যাচে আবারও জানিয়েছেন, কেন নিজের পজিশনে তাঁকে দেশের অন্যতম সেরা মানা হয়। জামালের সঙ্গে নিয়মিত মাঝমাঠে জনির জুটি নামানোর জন্য জাতীয় দলের কোচ জেমি ডের হাত নিশপিশ না করে যায়ই না!

আবাহনীর বড় ভরসা হয়ে উঠেছেন বেলফোর্ট ও তোরেস।
ছবি: প্রথম আলো

সাইফের মিডফিল্ডে টুর্নামেন্টজুড়ে জামাল ছিলেন না, আগের কথা। জামালের জায়গায় সাইফ দলে ভিড়িয়েছিল সিরোজিদ্দিন রাখমাতুল্লেভকে। এই উজবেক এতটাই ভালো খেলছেন, অনেকের মতে, জামালের অভাব তো তিনি পূরণ করেছেনই, জামালকে ছাড়িয়েও গেছেন এর মধ্যে। ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার হওয়ার কারণে রাখমাতুল্লেভের খেলার ধরনটা স্বভাবতই সাবধানী। রক্ষণে থাকা দুই সেন্টারব্যাক রিয়াদুল-ইমানুয়েল কিংবা পাশে থাকা আরেক মিডফিল্ডার শাহেদকে বাড়তি রক্ষণ নিরাপত্তা দিয়ে তবেই ওপরে ওঠার ব্যাপারে চিন্তা করেন এই উজবেক। ফাইনালেও এই উজবেকের প্রতি আশার পারদটা অনেক বেশি ছিল সাইফের। ছিল সাইফের আরেক বিদেশি মিডফিল্ডার জন ওকোলির ওপরেও। কিন্তু যেদিন ভালো খেললে শিরোপাটাই জেতা হয়ে যাবে, সেদিনই নিষ্প্রভ থাকলেন সাইফের দুই বিদেশি মিডফিল্ডার। তাঁদের ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছেন বসুন্ধরার পাঁচ মিডফিল্ডার।

৪-১-৪-১ ছকে অন্যান্য ম্যাচের চেয়ে রবসন দে সিলভার তুলনামূলকভাবে একটু নিচে নেমে আসা, জোনাথন ও মাসুক মিয়ার সঙ্গে তাঁর রসায়নটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইফের জন্য। ওদিকে মাহবুবুর রহমান সুফিলের জায়গায় মোহাম্মদ ইব্রাহিমের নামাটাও ছিল কোচ অস্কার ব্রুজোনের আরেকটা ভালো সিদ্ধান্ত। তুলনামূলকভাবে সুফিলের চেয়ে এই ম্যাচে ইব্রাহিম রক্ষণাত্মক দায়িত্বটা বেশ ভালোই পালন করেছেন। উইঙ্গারের মতো ওপরে উঠে যাওয়া ছাড়াও দলের প্রয়োজনে সাইফের ইয়াসিন-ওকোলি-ফাহিমদের সামলাতে নেমে গেছে প্রায়ই। আর সাইফের এই ‘জোন’টা নিষ্ক্রিয় রাখলে বাকি দলও যে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়, সেটাই যেন হাতে-কলমে দেখিয়েছে বসুন্ধরা।

বসুন্ধরাদের বিদেশিরা বুঝিয়েছেন, তাঁদের ঘিরে ওঠা ‘হাইপ’ মোটেও অমূলক নয়। ওদিকে দেশীয় ফুটবলপ্রেমীদের আশা জাগিয়েছে সাইফের দেশীয় খেলোয়াড়েরা। উইঙ্গার যুগল ফাহিম ও আরিফুর, লেফটব্যাক ইয়াসিন ও সেন্টারব্যাক রিয়াদুল হাসান। বয়স হলেও যে খেলায় তেমন মরচে পড়েনি, বুঝিয়েছেন শাহেদ। নতুন কোচ পল পুটের অধীনে এক-দুই মৌসুম খেলার সুযোগ পেলেই যে রিয়াদুল-ফাহিম-ইয়াসিনরা জাতীয় দলের জন্য একেকটা রত্ন হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করবেন, না বলে দিলেও চলছে।

চট্টগ্রাম আবাহনী আর শেখ রাসেলও এ মৌসুমে ভালো দল।
ছবি: প্রথম আলো।

সেমিফাইনালে ওঠা চট্টগ্রাম আবাহনী ও ঢাকা আবাহনীও আশা জাগিয়েছে বেশ। তুলনামূলকভাবে স্বল্প বাজেটে পাওয়া দল নিয়েই সেমিতে উঠে দেখিয়েছেন চট্টগ্রাম আবাহনীর কোচ মারুফুল হক। উইঙ্গার মান্নাফ রাব্বি, লেফটব্যাক মনির আলম, উইঙ্গার রাকিব হোসেন কিংবা মিডফিল্ডার মানিক মোল্লা, আসন্ন লিগে তাঁরা কেমন করতে পারেন, সেটার জন্য দর্শকদের মনে আগ্রহ বাড়িয়ে দিয়েছেন এর মধ্যেই। কিন্তু করোনা ও চোটে জর্জরিত চট্টগ্রাম আবাহনীর বিদেশিদের আসল দাপট দেখার জন্য লিগ পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে। নিক্সন গিলের্মে, কার্লোস দিদিয়ের, শুকুরালি পুলাতভ—কেউই তেমন ঝলক দেখাতে পারেননি।

আবাহনী লিমিটেডের দেশীয় খেলোয়াড়দের মধ্যে আলাদাভাবে নিজের জাত চিনিয়েছেন উইঙ্গার সাদ উদ্দীন। আধুনিক ফুটবলে একজন উইঙ্গারের কাজ যে শুধুই আক্রমণ নয়, বরং দলের সার্বিক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার জন্য প্রতিপক্ষ দলের উইঙ্গার কিংবা স্ট্রাইকারকেও যে মাঝেমধ্যে দায়িত্ব নিয়ে সামাল দিতে হয়, সাদ উদ্দীন সেটা দেখিয়েছেন ষোলো আনা। আবাহনীর বিদেশিদের মধ্যে রাফায়েল অগুস্তোর খেলা দেখে এখনো আহামরি কিছু মনে হয়নি, ওদিকে স্ট্রাইকার ফ্রান্সিসকো তোরেস প্রথমে জ্বলে না উঠতে পারলেও আস্তে আস্তে বুঝিয়েছেন, সানডে চিজোবার ফেলে যাওয়া জায়গাটা পূরণ করতে পারবেন বেশ ভালোভাবেই।

ব্রিটিশ কোচের অধীনে মোহামেডানও চ্যালেঞ্জ জানাবে সবাইকে।
ছবি: প্রথম আলো

সাইফের মতো দেশীয় ফুটবলারদের পরিকল্পনার মূল অংশ বানিয়ে ঢাকা মোহামেডানের ইংলিশ কোচ শন লেনও যদি লিগ শিরোপার কাছাকাছি দলকে নিয়ে যান, আশ্চর্য হবেন না যেন। অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার শাহেদ ও জাফর ইকবাল, ডিফেন্ডার হাবিবুর সোহাগ, গোলরক্ষক আহসান হাবিব থেকে শুরু করে আমির ফাহিম বাপ্পী, কামরুল হাসান—কোয়ার্টারে ওঠা দলটার প্রাণ এই দেশি তারকারাই। সঙ্গে আবিওলা নুরাত, মুনাজির কুলদিয়াতি কিংবা সোলেমানে দিয়াবাতের মতো বিদেশি খেলোয়াড়েরাও যে সময় সময় জ্বলে উঠতে পারেন বেশ, সেটাও বোঝা গেছে মৌসুমসূচক এই টুর্নামেন্টে।

অপেক্ষা এখন জাঁকজমকপূর্ণ এক লিগের!