জিদানের মাথায় ‘বেল’ ফাটল যেভাবে

চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে বেলের এই অবিস্মরণীয় গোলটা মনে থাকবে রিয়াল সমর্থকদের।ফাইল ছবি

কথায় আছে, ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়। কিন্তু জিনেদিন জিদান গিয়েছিলেন দুবার। প্রথম দফায় যখন রিয়াল মাদ্রিদের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখনো গ্যারেথ বেল ক্লাবেই ছিলেন। ক্লাব ছেড়ে ছুটিতে গিয়েছিলেন এবং আবার ফিরেও আসেন বেলের কাছে, দুঃখিত রিয়ালে। কথাটা তাই এখন রসিকতার ছলে উঠতেই পারে—একবার নয় দু-দুবার বেলতলায় গেলে দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে!

তবে ফুটবলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তা মোটেও দুর্ঘটনা নয়। বোঝাপড়ায় ঘাটতি, বনিবনা না হওয়া কিংবা ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ—এসব কথা বলা যায়। এসব কারণেই বেল পড়েছে জিদানের মাথায়? এমন কদাকার বর্ণনায় বিরক্তি জাগলেও বিষয়টি এক অর্থে তেমনই। দুজনের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল না, তা বেশ আগেই ‘ওপেন সিক্রেট’। রিয়াল কোচের ওপর রাগে ফেটে থাকা বেল কিন্তু জিদানের মাথাব্যথা হয়েই ছিলেন। সে ব্যথা আপাতত দূর হয়েছে। তাঁকে ধারে টটেনহাম হটস্পার্সে ফেরত পাঠিয়েছে রিয়াল।

সম্পর্কের চরম অবনতি কোনো পক্ষ কখনো সরাসরি স্বীকার করেনি। পাশাপাশি এটাও সত্য, গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে কোনো পক্ষই একে-অপরের চোখে চোখ রেখে হাসিমুখে কথা বলেননি। বিষাদ, বিচ্ছিন্নতা, বিরাগভাজন—আর যা যা হতে পারে সব ছিল দুজনের মধ্যে। জিদানের সঙ্গে আর থাকতে চাননি বেল। একই ইচ্ছা ছিল রিয়াল কোচেরও। দুই পক্ষের এ মুক্তি প্রার্থনার বীজ পোঁতা কিন্তু কিয়েভে। ২৬ মার্চ, ২০১৮—চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল। সেদিন রিয়ালের মূল একাদশে ‘বিবিসি’র (বেল-বেনজেমা-ক্রিস্টিয়ানো) ওপর আস্থা রাখেননি জিদান। বেলের জায়গায় নামিয়েছিলেন ইসকোকে। বেল নেমেছিলেন ৬১ মিনিটে স্প্যানিশ মিডফিল্ডারের বদলি হয়ে—সেদিন থেকেই জিদান-বেল অহিনকুল সম্পর্কের শুরু।

তবে বেল কিন্তু বলতে পারবেন না, জিদান তাঁর ওপর কখনো আস্থা রাখেননি। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুর বেঞ্চে এসেই জিদান বলেছিলেন, ‘বিবিসি-কে খেলানো নিয়ে কোনো আপস হবে না। তারা ফিট থাকলে একসঙ্গে খেলবে।’ জিদান তাঁর কথা রেখেছিলেন। তাঁর প্রথম মেয়াদে রিয়ালের আক্রমণভাগে ‘বিবিসি’-ই প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু বেলের কপাল খারাপ। ক্রমাগত চোট আর অফ ফর্মে ধারটা হারিয়ে ফেলেছিলেন। জিদানকে তাই বিকল্প সমাধান খুঁজে বের করতে হয়। বেলের দীর্ঘদিনের গোড়ালির চোট আর ওদিকে জিদানের ৪-৪-২ ফরমেশনের প্রেমে পড়া মিলিয়ে ফাটল শুরু করে দুজনের সম্পর্কে। জিদানের এই পছন্দের ফরমেশনে আবার ইসকোর সুবিধা—মাঝমাঠে নিজের জাত চেনানোর সুযোগ।

জিনেদিন জিদান ও গ্যারেথ বেল। বনিবনা হয়নি দুজনের।
ছবি: টুইটার

এমনকি তার আগের বছর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালেও মূল একাদশে ইসকোকে রেখেছিলেন জিদান। ওয়েলশ তারকা তখন চোট থেকে মাত্র সেরে উঠেছেন তবু ফাইনালটা ছিল তাঁর এলাকা কার্ডিফে। তাই অনেকে ভেবেছিল ফাইনালে দেখা যাবে বেলকে। কিন্তু ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়ে যাওয়ার পরই ওয়েলশ উইঙ্গারকে নামিয়েছিলেন জিদান। তবে পরের বছর (২০১৮) ফাইনালেও বদলি হয়ে মাঠে নামায় জিদানকে সম্ভবত কখনো ক্ষমা করতে পারবেন না বেল। বদলি হয়ে মাঠে নামার দুই মিনিটের মাথায় বাইসাইকেল কিকে করেছিলেন অবিস্মরণীয় এক গোল, এরপর দূরপাল্লার শটে আরেকবার লক্ষ্যভেদ। বেল বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, খেলার মাঠে প্রেম-ভালোবাসার তুলনায় সামর্থ্যকে প্রাধান্য দেওয়াই শ্রেয়।

ক্ষোভ উগরে দিতেও কার্পণ্য করেননি বেল। ফাইনালের পর বলেছিলেন, ‘খেলার সুযোগ না পেলে আমি চলে যাব।’ সে বছর ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর রিয়াল ছাড়ার ধাক্কা সামলাতে সবাই ব্যস্ত থাকায় বেলের ক্ষোভ প্রশমনের কথা কেউ ভাবেনি। তবে মজার বিষয় হলো, রাগটা যেহেতু বেলের, তাঁর-ই তো আগে রিয়াল ছাড়ার কথা। তাঁর বদলে জিদানই রিয়াল ছেড়ে যান বেলের ওই মন্তব্যের তিন দিন পর। এরপর ভাবা হচ্ছিল, দুই পক্ষ আর কখনোই একসঙ্গে হবেন না। জিদানের অধীনে বেলকে আর কখনোই দেখা যাবে না।

কিন্তু পাশার দান উল্টে যায় গত বছরের ১০ মার্চ। দ্বিতীয় মেয়াদে রিয়ালের ডাগ আউটে ফিরে আসেন জিদান। ওদিকে চলে যাওয়ার ঘণ্টাধ্বনি শুনতে পান বেল। সে বছরের এপ্রিলে রায়ো ভায়োকানোর কাছে হারের পর জিদানই বলে দেন, ‘বেলের মন এখন মাদ্রিদে আছে কি না ঠিক নিশ্চিত নই।’ এরপর ওয়েলশ তারকা সতীর্থদের সঙ্গে অনুশীলন কেন্দ্রে না ফিরে চলে যান বিমানবন্দরে ব্যক্তিগত ফ্লাইট ধরতে।

তুষের আগুনটা তারপর আর ধিকিধিকি করে জ্বলেনি। ধরে উঠেছে দপ করে। জিদান সে মৌসুমে এক প্রীতি ম্যাচের আগে বলে বসেন, ‘বেল কাল গেলেই সেটা সবার জন্য ভালো।’ অর্থাৎ বেলকে রিয়াল ছাড়া করতে বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠেন জিদান। তাতে বেলের যে সায় ছিল না তা নয়। চীনের এক ক্লাবে যেতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু তাঁকে মুফতে ছাড়তে রাজি হয়নি রিয়াল। অতএব যাত্রাভঙ্গ কিন্তু সম্পর্কের বরফ অগলিত। জিদান এরপর কী ভেবে যেন সুযোগ দিয়েছিলেন বেলকে। কিন্তু বেল আর সেভাবে ফেরেননি—মানে উইং পোড়ানো সেই দৌড়, শক্তি আর লক্ষ্যভেদের ক্ষমতাটা সেভাবে আর দেখা যায়নি। মৌসুমজুড়ে করলেন মাত্র ২ গোল। রিয়াল যখন মাঠে গলফ খেলে বেড়িয়েছেন বেল। বেঞ্চে বসে থাকলে বাইনোকুলার দিয়ে দেখার ভঙ্গিতে তাকিয়ে থেকেছেন সতীর্থদের খেলায়।

জিদান কোচ হয়ে আসার পর স্বস্তিতে থাকেননি বেল।
ছবি: টুইটার


ওদিকে জিদানও এক কাঠি সরেস। নিজের ভাবনা থেকে তিনি একচুল নড়েননি। বেলকে ছেঁটে ফেলেন স্কোয়াড থেকে। অভিমান আর ক্ষোভ থেকেই সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নস লিগ শেষ ষোলোয় দলের সঙ্গে ইংল্যান্ডে যেতে আপত্তি জানান বেল। দুজনের সম্পর্কের কফিনে ওটা ছিল শেষ পেরেক। বাকি ছিল শুধু বিচ্ছেদের তারিখ নির্ধারণ। টটেনহাম এসে তা নির্ধারণ করে দিল।