‘ঝরঝরে শরীর পেতে এত কষ্টের পর দেখাতে লজ্জা কিসের’

শুধু গোল করেই যে খালি গায়ে উদ্‌যাপন করেন, এমন নয়। ছুটিতে গেলেও লিভারপুলের মিশরীয় ফরোয়ার্ডকে উদোম গায়ে দেখা যায় নিয়মিতইছবি: সংগৃহীত

মোহাম্মদ সালাহর যেন এখন পায়ের চেয়ে মুখই বেশি চলে!

গত কিছুদিনে একের পর এক ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথা বলেই চলেছেন লিভারপুলের মিসরীয় ফরোয়ার্ড, যদিও মাঠে সেটির ছাপ আর থাকছে না। চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালের আগে রিয়াল মাদ্রিদকে দেখিয়ে দিতে চাওয়ার হুংকার ছেড়েছিলেন বটে, কিন্তু ফাইনালে একের পর এক সুযোগ হারিয়ে ম্যাচই হেরে যাওয়া লিভারপুলের হয়ে সবচেয়ে বেশি সুযোগ নষ্ট করেছেন সালাহই। ফাইনালের আগে-পরে সুযোগ পেলেই নিজেকে ‘বিশ্বসেরা’ও দাবি করে বসছেন।

ফাইনালে হারের পরও সালাহর কথার তুবড়ি ফোটানো শেষ হয়নি। তাঁর চোখে, এবারের চ্যাম্পিয়নস লিগ লিভারপুলেরই প্রাপ্য ছিল। আগামী মৌসুমে লিভারপুলের চ্যাম্পিয়নস লিগের স্বপ্ন ঠিকই দেখাচ্ছেন। পাশাপাশি চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পারায় তাঁর ব্যালন ডি’অর জেতার স্বপ্নে ধাক্কা লাগলেও এখনো আশা ছাড়ছেন না সালাহ।

ফ্রান্স ফুটবলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ব্যক্তিগত অনেক কিছু নিয়েও কথা বলেছেন সালাহ। নিজের বাসায় ব্যায়ামাগারের অবস্থা, তাঁর ডায়েট...এসব তো ছিলই, পাশাপাশি জার্সি খুলে গোল উদ্‌যাপন নিয়েও কথা বলেছেন সালাহ। সোজাসুজিই জানিয়ে দিলেন, এমন নিখুঁত শরীর থাকলে সেটি দেখানোয় লজ্জা থাকতে নেই!

আরও পড়ুন

গোল উদ্‌যাপনে কত ভঙ্গিই তো করে দেখিয়েছেন সালাহ। গোল তিনি কম করেন না, সে কারণে গোলের উদ্‌যাপনেও বিচিত্র ঢঙের দেখা মেলে। কখনো ধ্যানের ভঙ্গি, তো কখনো কানে হাত দিয়ে নিজের নাম শোনার ভঙ্গি, কখনো উত্তেজনায় জার্সিই খুলে বাতাসে ভাসান সালাহ।

এ নিয়েই ফ্রান্স ফুটবল ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন হয়েছে। তাতে লিভারপুলের মিসরীয় ফরোয়ার্ডের উত্তর, ‘আপনি যখন একটা ঝরঝরে শরীর পেতে এত কষ্ট করবেন, তখন এ (শরীর দেখানো) নিয়ে আর লজ্জা কিসের!’

কী কষ্ট করেন, সেটিরও বিশদ জানিয়েছেন সালাহ। তাঁর ঘরে ব্যায়ামাগারের অবস্থা বোঝাতে কৌতুকের সুরে স্ত্রীর বিরক্তির কথাই টেনে এনেছেন সালাহ, ‘আমার স্ত্রী তো বলে আমি ওর চেয়েও আমার মেশিনের সঙ্গে বেশি সময় কাটাই।’

কেন এমন মনে হয় সালাহর স্ত্রীর, সেটি বোঝা যাবে নিজ বাসায় সালাহর ব্যায়ামাগারের বর্ণনা থেকে, ‘ঘরে দুটি কক্ষ বরাদ্দ ফিটনেস মেশিনগুলোর জন্য। বাসায় আমি ক্রাইওথেরাপি (ভীষণ ঠান্ডার মাধ্যমে ক্লান্তির ধকল সামলাতে) নিতে পারি, একটা হাইপারবারিক চেম্বারও আছে (সাধারণ অবস্থার চেয়ে বাতাসের চাপ ২-৩ ডিগ্রি বাড়িয়ে ফুসফুসে বাড়তি অক্সিজেন জোগানোর ব্যবস্থা)। আমি সব সময়ই আমার শরীরের অবস্থা আরও ভালো করার চেষ্টা করে যাই।’

এখানেই শেষ নয়। সালাহর বর্ণনা চলে, ‘আমি প্রতিদিন যোগব্যায়ামের চেষ্টা করি, ঘরে একা একা ১০-২০ মিনিটের মতো। এটা সত্যি যে আমার ঘরটাকে মাঝেমধ্যে হাসপাতাল মনে হয়। আমার স্ত্রী এটা একেবারেই পছন্দ করে না।’

সে জন্য শুধু ব্যায়ামেই তো হয় না, খাবারদাবারেও যত্নশীল হতে হয় পেশাদার খেলোয়াড়দের, কিছু ত্যাগও স্বীকার করতে হয়। সালাহও ব্যতিক্রম নন। তিনি কী কী করেন, কী খান, সেসবেরও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন, ‘আমার ব্রকোলি পছন্দ। মিষ্টি আলু, মাছ, মুরগি আর সব সময় সালাদ খাই। আর লন্ডনে বড় রেস্টুরেন্টে নিজেকে ভালো কিছুর স্বাদ দিতে চাইলে সুশি খাই। মাসে সর্বোচ্চ একবার পিৎজা খাই। বার্গারও আমার পছন্দের, তবে সেটা বলতে গেলে খাই-ই না। কারণ, ওটা খাওয়ার পর পেট ভারী লাগে।’

আরও পড়ুন

এ তো গেল সালাহর ব্যক্তিগত যত বিষয়, সাক্ষাৎকারে লিভারপুল, চ্যাম্পিয়নস লিগ, রিয়াল মাদ্রিদ নিয়েও প্রশ্ন ছিল। এবার চার শিরোপার চারটিই জেতার জন্য মৌসুমের শেষ পর্যন্ত লড়েছে লিভারপুল। কিন্তু লিগের শেষ দিনে আশা জাগিয়েও লিগ জেতা হয়নি, চ্যাম্পিয়নস লিগে ফাইনালে হেরেছে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে। শুধু ঘরোয়া দুই কাপ—লিগ কাপ ও এফএ কাপ নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হচ্ছে ইয়ুর্গেন ক্লপের দলকে।

তবে সালাহর মতে, লিভারপুলের চ্যাম্পিয়নস লিগও জেতা উচিত ছিল, ‘জয়টা আমাদের প্রাপ্য ছিল, ফাইনালে আমরাই বেশি সুযোগ পেয়েছি। আমি নিজেই দু-তিনটি পরিষ্কার সুযোগ পেয়েছি, কিন্তু (রিয়াল গোলকিপার) থিবো কোর্তোয়া অসাধারণ কিছু সেভ করেছে। ওর কাজই অবশ্য এটা, রিয়াল মাদ্রিদ এ জন্যই ওকে দলে নিয়েছে। রাতটা ওর ছিল।’

চ্যাম্পিয়নস লিগ জিততে না পেরে হতাশ সালাহ
ছবি: টুইটার

এবার না জিতলেও আগামী মৌসুমে আবার চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার স্বপ্ন সালাহর। সে পথে তাঁর প্রেরণা রিয়াল মাদ্রিদের কাছে আরেকটি হারই, ‘এখানে আমি আবারও অতীত থেকে প্রেরণা নিই। ২০১৮ সালে আমরা চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে হেরেছিলাম, সেবারও রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষে। এর পরের মৌসুমে আমরা ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন হয়েছি। এবারও তেমন কিছুরই আশা দেখি। আমাদের অতীত নিয়ে অনুযোগ না করে সামনের দিকে তাকানো উচিত।’

চোখ সামনের দিকে থাকে বলেই হয়তো, নিয়মিত নিজের উন্নতির কথা ভেবে যান সালাহ। কীভাবে নিজের খেলায় নিয়মিত উন্নতি আনছেন, সে নিয়ে প্রশ্নে তাঁর উত্তর, ‘গত বছর গ্রিসে ছুটি কাটানোর সময় সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে শুয়ে ছিলাম। নিজেকে প্রশ্ন করছিলাম, কীভাবে আরও ভালো ফুটবলার হতে পারি। দিন দিন সেটা আরও কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ, এখন আমার আশপাশে সব সময় ২-৩ জন ডিফেন্ডার থাকে। আমাকে তাই গোলের পথ খোলার জন্য, সতীর্থদের জন্য জায়গা বের করতে নতুন নতুন উপায় বের করতে হবে। এই উপলব্ধি কাজেও দিয়েছে, আমার পরিসংখ্যান আগের চেয়ে ভালো হয়েছে।’

আরও পড়ুন

আরও ভালো ফুটবলার হতে একটা প্রেরণার কথাও জানিয়েছেন সালাহ, ‘আমার প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার যেন নিজেকে নিজে বলে, “ওহ! আবার ও সামনে চলে এসেছে!” আমার লক্ষ্য হচ্ছে ও (প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডার) যাতে দম ফিরে পাওয়ার সময়ও না পায়। ৯০ মিনিটের প্রতিটি মিনিটেই যাতে ও বিপদের ভয়ে থাকে।’ নিজেকে বিশ্বসেরা দেখতে চাওয়ার ইচ্ছাও আরেকবার জানিয়ে দিয়েছেন, ‘অন্য যে কারও মতো আমি চাই বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের মঞ্চে নিজেকে দেখতে।’

এবারের ব্যালন ডি’অর যে বেনজেমাই জিততে যাচ্ছেন, তা নিয়ে সংশয় নেই বললেই চলে
ফাইল ছবি

বিশ্বসেরা খেলোয়াড়ের প্রসঙ্গ যখন এসেছেই, ফ্রান্স ফুটবলেরই দেওয়া বর্ষসেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার ব্যালন ডি’অরের প্রসঙ্গ আর বাদ থাকে কী করে! এই মৌসুমে ডিসেম্বর-জানুয়ারি পর্যন্ত দারুণ ছন্দে থাকা সালাহকেই বিশ্বসেরা মেনেছেন অনেকে, কিন্তু এরপর ছন্দ হারিয়ে ফেলেন সালাহ।

অন্যদিকে রিয়াল মাদ্রিদের জার্সিতে মৌসুমজুড়েই অসাধারণ খেলেছেন করিম বেনজেমা। রিয়ালকে লিগ আর চ্যাম্পিয়নস লিগও জিতিয়েছেন। চ্যাম্পিয়নস লিগ জেতার পথে হারিয়েছেন সালাহর লিভারপুলকেই। এবারের ব্যালন ডি’অর যে বেনজেমার হাতেই উঠতে যাচ্ছে, সে নিয়ে সংশয় সম্ভবত তেমন কারও নেই।

সালাহর কথায় বোঝা যায়, তিনিও এবারের ব্যালন ডি’অরের সম্ভাবনা আর দেখেন না। তবে আশাও ছেড়ে দিচ্ছেন না, ‘আমি এই পুরস্কার জিতে জর্জ উইয়াহর পাশে বসতে চাই, যিনি কিনা (ব্যালন ডি’অর বিজয়ী) একমাত্র আফ্রিকান। এটা সত্যি যে ২০২১ সালে নিজের র‍্যাঙ্কিং (ব্যালন ডি’অরের ভোটে সপ্তম হয়েছিলেন সালাহ) দেখে বেশ অবাক হয়েছিলাম। এই বছরে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে হারটা একটু পিছিয়ে দিয়েছে, যদিও ফাইনালে আমি ভালোই খেলেছি। তবে এই হারের কারণে তো আগের এত মাসের অর্জন মিথ্যা হয়ে যাবে না।’

এবার না পেলে? সালাহর প্রতিশ্রুতি, ‘যদি ২০২২ ব্যালন ডি’অর না-ও জিতি, আমি পরেরবার জেতার জন্য সম্ভাব্য সবকিছুই করব।’

আরও পড়ুন